নারী আসন নিয়ে পুরুষদের এত আপত্তি কেন
Published: 3rd, August 2025 GMT
সব সম্ভবের বাংলাদেশ। এখানে যাঁরা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ, তাঁদের সঙ্গে প্রকৃত শ্রমিকদের সম্পর্ক ক্ষীণ। যাঁরা কৃষকের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, তাঁরা কৃষকের সমস্যাটাই জানেন না। শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে তাঁরাই মাঠ গরম করেন, যাঁদের ছাত্রত্ব অনেক আগেই শেষ হয়েছে।
চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে যে নারী সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, রাষ্ট্র সংস্কারে তারাই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হলো। সরকার গঠিত ১১টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে নারী অধিকারসংক্রান্ত কমিশন ছাড়া কোনোটির প্রধান পদে নারী ছিলেন না। অন্যান্য কমিটিতে নারী বা সংখ্যালঘু ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নারীর অধিকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ম্যারাথন আলোচনা করলেও কমিশনে কোনো নারী প্রতিনিধি ছিলেন না। এ ছাড়া তারা যেসব দলের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মধ্যেও নারী প্রতিনিধি ছিলেন খুবই কম। অর্থাৎ জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনাটি হয়েছে কার্যত নারীকে বাদ দিয়ে। আর এত দীর্ঘ আলোচনার পর জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে যে সিদ্ধান্ত হলো, তা পর্বতের মূষিক প্রসব ছাড়া আর কিছু নয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, নারী আসন ১০০ করা ও সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা। বর্তমানে সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত আসন আছে, যা দলীয় আসনের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় রাজনৈতিক দলগুলো আসন বাড়ানোর বিষয়ে একমত হলেও ভোটের পদ্ধতি নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। এদের মধ্যে এমন দলও আছে, যারা নারীর প্রতিনিধিত্বেই বিশ্বাস করে না।
কিছু রাজনৈতিক দল ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে অতিরিক্ত ১০০ আসনে সরাসরি ভোট করার পক্ষে ছিল, যা অনেকটা মহিলা পরিষদের দেওয়া প্রস্তাবের কাছাকাছি। মহিলা পরিষদ বিদ্যমান ৩০০ আসনের মধ্যে ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব দিয়েছিল। সংবিধান সংস্কার কমিশন আসন বাড়িয়ে ৪০০ করার কথা বলেছে। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল এই প্রস্তাব নাকচ করে এই যুক্তিতে যে নতুন করে আসনবিন্যাস করতে হলে নির্বাচন পিছিয়ে যাবে।
শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিদ্যমান ৫০ আসনের পাশাপাশি ৫ শতাংশ হারে নারী প্রার্থী বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়, যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো খুব আপত্তি করেনি। নারী সংগঠনগুলোর মূল আপত্তিই ছিল সংরক্ষিত আসনব্যবস্থায়; যেখানে জনগণের ভোট নয়, দলীয় নেতৃত্বের কৃপায় এমপি হতে হয়।
নারী সংগঠনগুলোর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জবাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ কমিশনের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, সংসদে নারীদের জন্য আসন বাড়ানো ও সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হলেও তারা তা শোনেননি। দলগুলো ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে।
এই অভিযোগ ও আর্তি কেবল ফাতেমা খানমের নয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নেওয়া অনেক নারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছেন, হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অনেকে সামাজিকভাবে হেনস্তারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক কিংবা আন্দোলনের পুরুষ সহযাত্রীরা তাদের পাশ দাঁড়িয়েছেন, এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। বরং আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সভাসমাবেশে একশ্রেণির লোক নারীদের হেনস্তা ও অসম্মান করতে পারলেই পুলকিত হন।তাঁর ভাষ্য থেকে আমরা আরও জানতে পারি, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন ১০০ আসন বাড়িয়ে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এটাকে নতুনভাবে নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ করে নির্বাচন পেছানোর অজুহাত বলা শুরু করে। আমরা এমনও বলেছি, সংরক্ষিত আসন বাতিল করে দেন। দল থেকে ৩৩ শতাংশ নারীকে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়ন দেন। তাতেও দলগুলো রাজি হয়নি।’
আসলে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের সংস্কার না হলে নারীর ক্ষমতায়ন যে সম্ভব নয়, তা আবারও তারা প্রমাণ করল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তে নারী সংগঠনগুলো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। শনিবার ব্র্যাক সেন্টারে ‘নারীকে বাদ দিয়ে নারীর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় নারী অধিকারকর্মীরা কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোনো সুপারিশ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গ্রহণ করেনি। নারী অধিকারকর্মীদের দেওয়া প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয়েছে।’
তাঁদের মতে, নারী অধিকারকর্মী ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন এই সুপারিশ গ্রহণ করেনি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী নারী হলেও ঐকমত্য কমিশনে নারীর কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কমিশন নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। তারা শুধু রাজনৈতিক দলের কথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রশ্ন আসে সরকার যদি নারীদের ক্ষমতায়নে এত দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, তাহলে ঢাকঢোল পিটিয়ে কমিশন গঠন করল কেন? সংসদে নারীদের জন্য আসন বাড়িয়ে ১০০ করে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল নারীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সংসদের আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে ৩০০টি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল।
ঐকমত্য কমিশন যেসব দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে, সেসব দল নারীর প্রতিনিধিত্ব করে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন নারী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, ‘যেসব রাজনৈতিক দল সেখানে আলোচনা করেছে, তারা কোনোভাবে নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। নারীদের বাদ দিয়ে সংস্কার হলে আগামী নির্বাচনে নারীরা ভোট দেবেন না।’
অন্যদিকে মহিলা পরিষদ এক বিবৃতিতে ২০৪৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে মনোনয়নের মাধ্যমে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বহাল রাখার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তকে ‘পশ্চাৎপদ’ বলে অভিহিত করে।
জাতীয় সংসদে নারীর আসনসংখ্যা ও নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে, তখন চট্টগ্রাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের সাবেক মুখপাত্র ফাতেমা খানমের ফেসবুকে দেওয়া বার্তাটি চোখে পড়ল। তিনি বলেছেন, ‘চট্টগ্রামে যাঁদের সঙ্গে জুলাই আন্দোলন করেছি, তাঁরাই আজ নারীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বয়ান (ন্যারেটিভ) তৈরির চেষ্টা করছেন। নারীদের ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন। এগুলো নেওয়া যায় না।’
গত শুক্রবার রাত ১০টা ৪৪ মিনিটে নিজের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে আসেন ফাতেমা খানম। এ সময় তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের কিছুসংখ্যক মানুষের স্বার্থের কাছে, তাঁদের চাওয়া-পাওয়ার কাছে আমাদের রাজনীতি হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছেন আন্দোলনের সম্মুখসারিতে থাকা অনেকে। এখন বলতে গেলে কেউই নেই। এই সবকিছুর জন্য কিছুসংখ্যক ভাই-ব্রাদার দায়ী। তাঁরা কেন্দ্রের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চট্টগ্রামে একটার পর এক কোরাম বানিয়েছেন। এর দায় আপনাদের নিতে হবে।’
এই অভিযোগ ও আর্তি কেবল ফাতেমা খানমের নয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নেওয়া অনেক নারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছেন, হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অনেকে সামাজিকভাবে হেনস্তারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক কিংবা আন্দোলনের পুরুষ সহযাত্রীরা তাদের পাশ দাঁড়িয়েছেন, এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। বরং আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সভাসমাবেশে একশ্রেণির লোক নারীদের হেনস্তা ও অসম্মান করতে পারলেই পুলকিত হন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংসদে নারীর আসন ও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যে উপসংহারে এল, তা কোনোভাবে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সোহরাব হাসান, কবি ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র প রস ত ব দ য় ন র প রস ত ব আসন ব ড় য় স গঠনগ ল স রক ষ ত র জন য সরক র আসন র
এছাড়াও পড়ুন:
২৭০ দিন আলোচনার পর অনৈক্যে হতাশ উপদেষ্টা
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানে হতাশা প্রকাশ করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। ২৭০ দিন আলোচনার পরও ঐকমত্য না হওয়ায় তিনি বলেন, সরকার কীভাবে কাজ করবে, তা বোঝা কঠিন। গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ চরমে পৌঁছেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গণভোট অথবা নির্বাচিত সংসদের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ঐকমত্যের সরকারের ধারণাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।