বিদেশগামী বাংলাদেশি শ্রমিকদের পকেট কেটে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া টিকিট কেলেঙ্কারির প্রমাণ মিলেছে সরকারি তদন্তে। ১১টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স, তাদের জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) এবং অন্তত ৩০টি ট্রাভেল এজেন্সি এ সিন্ডিকেটে জড়িত বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এই সিন্ডিকেটের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আছেন গ্যালাক্সি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের (এমওসিএটি) গঠিত নয় সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিএসএ হিসেবে সৌদিয়া, কাতার এয়ারওয়েজ, সালাম এয়ার, জাজিরা এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার এবং থাই এয়ারওয়েজের টিকিটের নিয়ন্ত্রণ নেন ওয়ালিদ। তার প্রতিষ্ঠান যাত্রীদের নাম ছাড়াই গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে টিকিট মজুত করে, পরে সেগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দ্বিগুণ বা তিন গুণ দামে বিক্রি করে।

ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নির্ধারিত ৭ শতাংশ কমিশনের বাইরে বাড়তি দাম নির্ধারণ করে বাজার ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করেছে। এমনকি, কিছু প্রতিষ্ঠান সাব-এজেন্টদের মাধ্যমে ‘ব্লক টিকিট’ বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে সিন্ডিকেট চালিয়েছে।

এজেন্সিগুলোর মধ্যে আছে—কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সিটিকম ইন্টারন্যাশনাল, কিং এয়ার এভিয়েশন, আরবিসি ইন্টারন্যাশনাল, মেগা ইন্টারন্যাশনাল, মাদার লাভ এয়ার ট্রাভেলস, জেএস ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, সাদিয়া ট্রাভেলস, হাশেম এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, নারিয়া ট্রাভেলস, এলহাম কর্পোরেশন এবং আল গাজি। সবাইকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়ে শুনানিতে ডাকা হয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, কর ফাঁকির অভিযোগে ওয়ালিদ ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তাদের প্রতিষ্ঠান ইডিএস শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিদেশি মদ বাজারজাত করছে বলেও তদন্তে উঠে এসেছে। ইতোমধ্যে ডিউটি ফ্রি ব্যবসার আড়ালে চালানো এই কর্মকাণ্ডে শুল্ক গোয়েন্দারা কয়েকবার অভিযান চালিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওয়ালিদের এই উত্থান মূলত পতিত সরকারের ছত্রছায়াতেই। গত ১৭ বছরে প্রায় ৮টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের জিএসএ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন তিনি। অভিযোগ আছে, সালমান এফ রহমান তার গোপন অংশীদার। এসব ব্যবসার আয়ের একটি অংশ ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন নেতার পকেটে যায় বলেও তদন্তে উল্লেখ আছে।

এ বিষয়ে কর কমিশনার মো.

আব্দুর রকিব বলেছেন, যারা কর ফাঁকি দিয়েছে এবং বাজার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকার টিকিট ১.৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা নজিরবিহীন প্রতারণা।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বলছে, টিকিট বিক্রির নামে কোনো সিন্ডিকেট বা শোষণ সহ্য করা হবে না। প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

গত জানুয়ারিতে আটাবের (অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ) অভিযোগের পর ১১ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যাত্রীর নাম ও পাসপোর্ট অনুলিপি ছাড়া কোনো টিকিট বুক করা যাবে না।

এই নির্দেশনার ফলে অনেক মজুতকৃত টিকিট গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে (জিডিএস) ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় এয়ারলাইন্সগুলো, ফলে দাম কমে আসে এবং স্বচ্ছতা ফিরে আসে। বর্তমানে ঢাকা-সৌদি রুটে টিকিটের দাম ৪৮ থেকে ৫০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে, যা আগে ছিল প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার টাকা।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ বলেছেন, জিএসএ-দের কারণে প্রকৃত ট্রাভেল এজেন্সিগুলো টিকিট পায় না। তারা ঘুষের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কিছু সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেয়।

সরকারের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, শুধু লাভের কথা না ভেবে জনসেবার দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে এয়ারলাইন্সগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

তবে, এখনো কারসাজির হোতাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতেও এমন সিন্ডিকেট গড়ে উঠবে।

ঢাকা/হাসান/রফিক

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র ব যবস থ ট র ভ লস জ এসএ তদন ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

গণমাধ্যম সংস্কারে এক বছরেও অগ্রগতি নেই

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও সাংবাদিকদের সুরক্ষা আইন কার্যকর হয়নি, গণমাধ্যম সংস্কারেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না থাকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক নেতারা।

মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সমাবেশে সাংবাদিক নেতারা একথা বলেন।

বক্তারা বলেন, এখনো তথ্য মন্ত্রণালয় সাংবাদিকদের সঙ্গে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করছে এবং সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের অভিযোগও তুলেছেন তারা।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, ‘‘সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট সাংবাদিকদের জন্য হলেও সেখানে প্রকৃত সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে সুবিধাভোগীদের জায়গা দেওয়া হচ্ছে। আমরা এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা চাই।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘যেদিন সাংবাদিকরা রাজপথে নামবে, সেদিন কেউ রেহাই পাবে না।’’

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ বলেন, ‘‘আজ আমাদের আনন্দ ও বেদনার দিন। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটলেও এখনও গণতন্ত্র পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। ভারতীয় টিভি চ্যানেল এখনো বন্ধ হয়নি। কিছু উপদেষ্টার অজ্ঞতা দেশকে অস্থির করে তুলছে।’’

বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরি বলেন, ‘‘সাইবার সিকিউরিটি আইন এখনো বাতিল হয়নি, এটা হাসিনার সরকারের মতোই দমনমূলক। ভোটহীন ১৭ বছর পর গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের আশায় অপেক্ষা করছি, কিন্তু এখনো সংস্কারের নামে শুধু প্রতিশ্রুতি শুনছি।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা ১৭ বছর ধরে রাজপথে ছিলাম, রক্ত দিয়েছি। এবার যদি আবার প্রতারণা হয়, তাহলে সাংবাদিক সমাজ আর সহ্য করবে না।’’

সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করেন, গণমাধ্যমে যারা স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে, তারা এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। এই ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে গণমাধ্যমকে মুক্ত করতে হবে।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ মুরসালীন নোমানী, রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি আবু সালেহ আকন, সাংবাদিক নেতা আব্দুল্লাহ মজুমদার সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।

ঢাকা/এএএম//

সম্পর্কিত নিবন্ধ