যুদ্ধবিরতি নিয়ে ভারত–পাকিস্তানের সমঝোতার পর দুই দেশেই জনমনে স্বস্তি ফিরছে। সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোয় ফিরতে শুরু করেছেন মানুষ, খুলছে দোকানপাট। তবে পাল্টাপাল্টি হামলা থামলেও সিন্ধু পানিচুক্তি এখনো স্থগিত রেখেছে ভারত। বিষয়টি নিয়ে একটি সুরাহায় পৌঁছাতে চায় পাকিস্তান। চুক্তিটি নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনায় বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন দেশটির নেতারা।

গত ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন। তার পরপরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করে নয়াদিল্লি। তখন দুই দেশ পাল্টাপাল্টি নানা পদক্ষেপ নিলেও পানিচুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। কারণ, ১৯৬০ সালে চুক্তি হওয়ার পর এই প্রথম কোনো পক্ষ সেটি স্থগিত করল।

গতকাল শনিবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও পানিচুক্তি যে স্থগিত থাকছে—সূত্রের বরাতে এমন খবর সামনে আনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। পরে আজ রোববার পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জিও নিউজকে বলেন, সিন্ধু পানিচুক্তি, কাশ্মীর সংকট ও নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন তাঁরা। তবে ওই আলোচনার দিনক্ষণ স্পষ্ট করেননি তিনি।

সিন্ধু পানিচুক্তি নিয়ে ভারতকে চাপ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও বলছেন পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা। যুদ্ধবিরতিতে মার্কিন প্রশাসনের বড় ভূমিকার পর পাকিস্তানের পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য জাওয়াইদ লতিফ সংবাদমাধ্যম ডনকে বলেন, চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত থেকে ভারতের সরে দাঁড়ানো নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিষয়টি তোলা।

আজ ভোরে শ্রীনগরের একটি বেকারির সামনে ভিড় করেছিলেন অনেকে। সেখানে রুটি কেনার জন্য সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা শাকিলা জান বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির খবরে আমি খুব খুশি।’

পাকিস্তানের কৃষিকাজ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য সিন্ধু নদের পানি গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষিজমিতে এই নদের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়। ৫ মে ডনের খবর অনুযায়ী, চুক্তির আওতায় থাকা চেনাব নদীর পানি ভারত বন্ধ করায় নদীটির পাকিস্তান অংশে পানি সরবরাহ কমে আসে। যদিও পরদিনই আবার পানি খুলে দেয় ভারত সরকার। পরে আজ পাকিস্তানের পাঞ্জাব সরকারের এক কর্মকর্তার বরাতে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, চেনাব, ঝিলাম, সিন্ধুসহ সব নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক আছে।

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান চলমান সংঘাতে লাভবান চীন ১০ মে ২০২৫যুদ্ধবিরতির পর জম্মু অঞ্চলের পুঞ্চ জেলায় নিজ বাড়িতে ফিরছে একটি পরিবার। আজ ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত র পর

এছাড়াও পড়ুন:

হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রভাব এবং কৌশলগত করণী

বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত হরমুজ প্রণালী। একদিকে পারস্য উপসাগর, অন্যদিকে ওমান উপসাগর। সরু এই জলপথ দিয়েই বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবাহিত হয়। প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই প্রণালী দিয়ে পরিবাহিত হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ যদি একদিনের জন্যও বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়বে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে বিশ্বের তেল-গ্যাস আমদানিকারক অন্যান্য দেশেও। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল, আমদানি-নির্ভর দেশও এর ব্যতিক্রম হবে না।

হরমুজ প্রণালী ইরানের দক্ষিণ তীরে এবং ওমানের উত্তরে অবস্থিত, যার প্রশস্ততা মাত্র ৩৯ কিলোমিটার। এই জলপথ দিয়েই সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, ইরাক ও ইরানের বিশাল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস ( এলএনজি) জাহাজে করে রপ্তানি হয়। বিশ্ববাজারে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির প্রভাব এতটাই বেশি যে এই রুটে সামান্য বিঘ্ন ঘটলেও তেলের দাম আকাশচুম্বী হতে পারে।

বাংলাদেশে মোট জ্বালানি চাহিদার একটি বড় অংশ মেটানো হয় আমদানি করা তেলের মাধ্যমে। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কিছু দেশ থেকে আমরা জ্বালানি তেল আমদানি করি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই তেল আসে হরমুজ প্রণালী অতিক্রম করে। অন্যদিকে, এলএনজি আমদানির বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। অর্থাৎ হরমুজ প্রণালীতে যদি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় বা জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়, তবে তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।

হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের দামের উপর প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। সরকার হয়ত তেল-গ্যাসে ভর্তুকি বাড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দাম স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাজেটের উপর চাপ বাড়বে। দ্রব্যের পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়তে শুরু করবে। শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেবে এবং কৃষিখাতেও সেচ সমস্যার কারণে ফলন হ্রাস পেতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। এই খাতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন, পেট্রোলিয়াম-নির্ভর কৃত্রিম ফাইবার, কেমিক্যালস ইত্যাদি আমদানি হরমুজ প্রণালী অতিক্রম করে আসে। জ্বালানি সংকট দেখা দিলে উৎপাদন ব্যাহত হবে, ফলে রপ্তানি আদেশ বাতিল হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রায় আয় কমে যাবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক কাজ করেন। এই দেশগুলোর অর্থনীতিও মূলত জ্বালানি রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তেল রপ্তানি ব্যাহত হবে, ফলে ওইসব দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। ফলস্বরূপ প্রবাসী কর্মীদের ছাঁটাই, নতুন নিয়োগ বন্ধ কিংবা বেতন কমানোর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটি হবে এক আঘাত। কারণ রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে বড় অবদান রাখে।

জ্বালানি সংকটের কারণে সরকারকে বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হবে, যা হবে তুলনামূলক ব্যয়বহুল। পাশাপাশি ডলার সঙ্কট আরও প্রকট হতে পারে। আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। গরিব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে বাড়বে ভোগান্তি।

হরমুজ প্রণালী ঘিরে যে ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা আমাদের মতো আমদানি-নির্ভর দেশের জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা। ভবিষ্যতের জ্বালানি সংকট বা বৈশ্বিক সরবরাহ বিঘ্নের মতো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে এখন থেকেই কিছু বাস্তবভিত্তিক ও দূরদর্শী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব উদ্যোগ শুধু সাময়িক প্রতিকারে নয়, দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সহায়ক হবে।

প্রথমত, আমাদের জোর দিতে হবে বিকল্প জ্বালানি উৎসে বিনিয়োগে। নবায়নযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে সৌর ও বায়ু শক্তির সম্ভাবনা বাংলাদেশে যথেষ্ট বেশি। কেন্দ্রীয় ও ব্যক্তিপর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমদানিনির্ভরতা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় পর্যায়ে জ্বালানি মজুতের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে আমাদের জ্বালানি মজুত সীমিত সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম। ভবিষ্যতে যেন অন্তত এক থেকে দুই মাসের চাহিদা পূরণ করা যায়, সে অনুযায়ী রিজার্ভ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকল্পনা নিতে হবে।

তৃতীয়ত, তেল ও গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে একক উৎস নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্রয়োজন বহুমাত্রিক সরবরাহ চুক্তি। মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গেও কৌশলগত জ্বালানি চুক্তি করতে হবে, যাতে একটি অঞ্চলে অস্থিরতা দেখা দিলে অন্য উৎস দিয়ে সরবরাহ চালু রাখা যায়।

চতুর্থত, আমাদের বন্দর ও নৌবাণিজ্য অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে হবে। সম্ভাব্য সরবরাহ ব্যাঘাত বা বিকল্প আমদানি রুটের প্রয়োজন দেখা দিলে যেন দ্রুত সাড়া দেওয়া যায়, সে জন্য পায়রা, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি বিকল্প নৌপথ ও জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা জোরদার করাও গুরুত্বপূর্ণ।

হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব এতটাই বেশি যে বিশ্ব অর্থনীতিতে একে ‘জ্বালানির লাইফলাইন’ বলা হয়। এই লাইফলাইন দুই একদিনের জন্য বন্ধ হলেও বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলো কেঁপে উঠবে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। তাই এখন থেকেই কৌশলগত চিন্তা, বাস্তবভিত্তিক প্রস্তুতি এবং বহুমুখী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে আমাদের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে যে আগুন জ্বলছে, তার ধোঁয়া আমাদের ঘরেও আসতে পারে।

লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভবনে ঢুকতেই ভয় মেলে না ওষুধও
  • জ্বালানি খাতে ৮ চ্যালেঞ্জ, সমাধানের রূপরেখা নেই বাজেটে
  • নাগরপুর বাজারে ‘পলিথিনমুক্ত’ পরিবেশ গড়তে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগ
  • কারাগারে বসে এইচএসসি পরীক্ষা দিলেন মামুন
  • হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রভাব এবং কৌশলগত করণী
  • মাসল গেইন বা পেশি গঠনের জন্য কেমন খাবার খাবেন
  • জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই: ফাওজুল কবির
  • এক জাহাজেই আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৬৮ কোটি টাকা
  • জ্বালানি তেলের দাম এখন বাড়বে না: জ্বালানি উপদেষ্টা
  • তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়াতে পারে