জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সারা দেশের শুল্ক-কর কার্যালয়ে কয়েক দিন ধরে অচলাবস্থা চলেছে। মূলত এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারির প্রতিবাদে টানা চার কর্মদিবস কলমবিরতি কর্মসূচি পালন করেছেন শুল্ক-কর কর্মকর্তারা। এনবিআর ভাগ করা নিয়ে তাদের তমেন আপত্তি নেই। এনবিআর ভেঙ্গে নতুন যে দুটি বিভাগ করা হচ্ছে, সেখানে পদ–পদবি নিয়ে তাদের মূল আপত্তি।

এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি বিভাগ করে ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর পর থেকে এর প্রতিবাদ করে আসছেন রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনবিআর এখন রাজস্ব নীতি প্রণয়ন এবং আদায়—দুটি কাজ করে থাকে। নতুন অধ্যাদেশ বাস্তবায়িত হলে রাজস্ব নীতি প্রণয়ন একটি বিভাগ করবে এবং আদায় করবে আরেক বিভাগ।

এই ভাগ নিয়ে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আপত্তি নেই। তাঁদের আপত্তি পদ-পদবি নিয়ে। এ জন্য এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন করছেন শুল্ক-কর বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারির পাশাপাশি রাজস্ব নীতি বিভাগে রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার দাবি শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের। অন্যদিকে অধ্যাদেশে বলা আছে, সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে এই বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ দেবে। সেখানে রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞতার কথা বলা নেই।

রাজস্ব খাতে হয়রানি কমাতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা রাজস্ব নীতি ও আদায় কার্যক্রম—দুটি আলাদা করার দাবি জানিয়ে আসছেন।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত অক্টোবর মাসে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদের নেতৃত্বে রাজস্ব খাত সংস্কারে পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করে। তিন মাসের মাথায় গত জানুয়ারিতে এই কমিটি একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আলাদা করার সুপারিশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের শীর্ষ নেতা ও অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ড প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব খাতের নেতৃত্ব আসতে হবে রাজস্ব খাত থেকে। রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞ লোকেরাই এ খাতের ভালো-খারাপ দিকগুলো বুঝতে পারেন। শুল্ক-কর নীতি প্রণয়ন ও আদায় অন্য লোকেরা করলে বাস্তবসম্মত না–ও হতে পারে। তিনি বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে সংস্থাটির সদস্যদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। বিকল্প হিসেবে সরকার উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে পারবে। কিন্তু গত ৫০ বছরে এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে কোনো সদস্যকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে শীর্ষ কর্মকর্তা বাইরে থেকে আসায় এনবিআর ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারেনি।

পরামর্শক কমিটির সুপারিশে কী আছে

সরকার রাজস্ব খাত সংস্কারে গঠিত পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। কিন্তু দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ আলাদা করার সুপারিশ করে ওই কমিটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। কমিটি এনবিআরকে ভাগ করে রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও প্রণীত নীতি বাস্তবায়নে রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমকে আলাদা করার সুপারিশ করেছে।

পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অনুসারে, নীতি প্রণয়নের কাজটি সরকারের বিভাগের পদমর্যাদায় রাজস্ব কমিশন নামে একটি স্বাধীন সংস্থার ওপর ন্যস্ত থাকবে। অন্যদিকে এনবিআরকে পুনর্গঠন করে স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদায় উন্নীত করা হবে।

ওই দুটি বিভাগের লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপারিশ হলো এনবিআর, তথা স্বতন্ত্র বিভাগের প্রধান হিসেবে সচিব বা সিনিয়র সচিব মর্যাদায় এনবিআরের আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগের সদস্যদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এই বিভাগের কর্মকর্তারা সচিবালয়ের সমপদমর্যাদাধারীদের মতো সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

অন্যদিকে রাজস্ব কমিশন, তথা নতুন বিভাগটির প্রধান হিসেবে আয়কর, শুল্ক ও মূসক ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাকে সচিব বা সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় নিয়োগ করা হবে। অন্য পদগুলো রাজস্ব নীতি প্রণয়নে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে।

বর্তমান কাঠামোয় সাধারণত ২০-২৫ বছর শুল্ক-কর নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই এনবিআরের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। তাঁদের মধ্য থেকে নতুন বিভাগে সচিব নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে রাজস্ব খাত সংস্কারে পরামর্শক কমিটির প্রধান ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি।

অধ্যাদেশে যা হলো

পরামর্শক কমিটির সুপারিশগুলোকে কিছুটা সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করেছে। সেখানে এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)—এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে পৃথক দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দুটি বিভাগের প্রধান হবেন সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তবে নিয়োগের শর্ত কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। যেমন সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ দেবে। এখানে রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞতার শর্ত বাদ দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান হিসেবে রাজস্ব আহরণে অভিজ্ঞতা আছে, এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ছাড়া এনবিআর বিদ্যমান জনবল নতুন বিভাগে ন্যস্ত করা হবে।

এনবিআরের সাবেক সদস্য (করনীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এখন দুই বিভাগের যাঁরা সচিব হবেন, তাঁরা প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসতে পারেন, সেই পথ তৈরি হলো। এনবিআর থেকে সচিব হবেন কি না, তা বলা যায় না। তাঁর মতে, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।

পদায়ন নিয়ে জটিলতা

অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মতো অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজস্ব নীতি এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগ কাজ করবে। ফলে এনবিআর ও মাঠপর্যায়ের শুল্ক-কর প্রশাসনের পদ-পদবি কীভাবে সমন্বয় করা হবে, তা নিয়ে জটিলতা আছে। যেমন এনবিআরে কর্মকর্তা পর্যায়ে মূলত সদস্য, প্রথম সচিব ও দ্বিতীয় সচিব—এই তিনটি পদ আছে। আর মাঠপর্যায়ের আছে সহকারী কমিশনার, উপকমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার, কমিশনার—এই পাঁচটি পদ। কিন্তু রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং নীতি বিভাগ বিভাগ সরকারের প্রচলিত বিভাগ হিসেবে কাজ করবে। সেখানে সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব—এসব পদে শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের কীভাবে পদায়ন করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজস্ব খাতের কর্মকর্তারা।

কেন করল সরকার

৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এনবিআর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ; এটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলেছে, কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে এনবিআর পুনর্গঠন জরুরি। একই সংস্থা করনীতি প্রণয়ন এবং সেই নীতির বাস্তবায়ন করবে—এ অবস্থান সাংঘর্ষিক। দীর্ঘদিন ধরে দেশের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন, নীতি প্রণয়নে রাজস্ব আহরণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

প্রেস উইং বলেছে, এনবিআর ভেঙে দুটি বিভাগ গঠন করা হলে দীর্ঘদিনের এসব জটিল সমস্যা সমাধানে আরও স্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো প্রণয়ন করা যাবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত দ র র কর মকর ত শ ল ক কর ক সরক র র প রণয়ন ক জ কর ভ গ কর আপত ত সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে

অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাধা দিতে একটি গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এই আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। আজ সোমবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কার্যালয়ে প্রস্তাবিত অভিন্ন পারিবারিক আইন (ইউএফসি) বিষয়ে তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় তরুণ-তরুণীরা বলেন, ছোট থেকে নারীর প্রতি বৈষম্য দেখে আসছেন তাঁরা। ধর্মীয় বয়ানের মাধ্যমে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাধা দিতে একটি গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। হিন্দু রীতিনীতি বৈষম্যে পরিপূর্ণ। এসব রীতিনীতি আইন হিসেবে ব্যবহার করতে শেখানো হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে। বিয়ে নিবন্ধন সবার জন্য বাধ্যতামূলক থাকতে হবে। সব ধর্মের ও সব শ্রেণির নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করা হলে তা কল্যাণকর হবে।

সভায় সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রযুক্তির প্রসারের মধ্য নিয়ে নারীর যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশেও হতে হবে। অভিন্ন পারিবারিক আইনের পক্ষে জনমত তৈরি করা সহজ কাজ নয়। এ জন্য সমাজের মধ্যে ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে হবে। তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় ওয়াজে নারীবিদ্বেষী প্রচারণা বন্ধে এবং সমতা প্রতিষ্ঠায় তরুণদের সোচ্চার হতে হবে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীকেই কথা বলতে হবে। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ অনুসারে নারীকে ব্যবহার করছে। নারী অধিকার যেন কারও লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

তরুণ–তরুণীদের প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক দীপ্তি শিকদার বলেন, অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের বিষয়টি ধর্মের দোহাই দিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হয়। এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণের অভাবও লক্ষ করা যায়। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ধারাবাহিকভাবে তৃণমূল থেকে জনমত তৈরির কাজ করছে।

সভায় লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা। তরুণ প্রতিনিধির মধ্যে বক্তব্য দেন শিউলি বিশ্বাস, মুমতাহিনা, রীতা জেসমিন, জারিন চৌধুরী, ফাহমিদা নাজনীন এবং প্রজ্ঞা লাবণী সাদিয়া।

সভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল কর্মকর্তা সিননোমে মারমা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কমানোটা ভালো বার্তা নয়
  • অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে
  • সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলছে: প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান