রেকর্ড উৎপাদন, বেড়েছে মজুত, তবুও চালের বাজারে উত্তাপ
Published: 6th, July 2025 GMT
ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামে উপচে পড়ছে চালের মজুত। বাজারে সরবরাহেও ঘাটতি নেই। তারপরও চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। প্রশ্ন উঠেছে সরবরাহ ও মজুত থাকার পরও হঠাৎ চালের মূল্য বৃদ্ধির নেপথ্যে কারা?
চাষির ঘাম, সিন্ডিকেটের ফায়দা
সরকারি তথ্য বলছে, চলতি বোরো মৌসুমে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ১৪ লাখ টন। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগের বছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে ১৫ লাখ টন। অথচ এই অর্জনের ফল ভোগ করছেন না প্রকৃত উৎপাদক।
নোয়াখালী জেলার কৃষক কালাম হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘ধান বিক্রি করছি মণপ্রতি ১১০০ টাকা। অথচ সেই ধানের চাল এখন কিনতে হচ্ছে ৮৫ টাকায়! আমরা দাম পাই না, আবার বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। লাভ করছে কারা?’’
আরো পড়ুন:
প্রশিক্ষণ শুধু পেশাগত জ্ঞান নয়, দায়িত্ববোধও বাড়ায়
খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি শুরু হলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে: আলী ইমাম
ঝালকাঠির কৃষক জহর আলীরও একই প্রশ্ন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘ফসল ফলাই আমরা, কিন্তু বাজার চালায় অন্যেরা। আমাদের কথা কেউ শোনে না, ভাবেও না।’’
কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.
গুদামে রেকর্ড মজুত
খাদ্য অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সরকারি গুদামে বর্তমানে ১৫ লাখ ৭২ হাজার টন চাল মজুত রয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ৩ লাখ টন বেশি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘মজুত পরিস্থিতি সন্তোষজনক। সরকার বাজারে নজরদারি বাড়িয়েছে। কেউ সিন্ডিকেট করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
দাম বৃদ্ধি মিলগেটেই
অধিকাংশ জায়গায় চালের মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে মিলগেট থেকেই। জেলা খাদ্য কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,‘‘গুদামে চাল আছে, বাজারেও সরবরাহ আছে। কিন্তু মিল পর্যায় থেকেই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। যেহেতু ৮৫ শতাংশ চালকলের দীর্ঘমেয়াদি মজুত ক্ষমতা নেই, তাই দায় বর্তায় করপোরেট চালকলগুলোর ওপর। এসব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে বিপুল ধান কিনে বাজারে প্রভাব ফেলে।’’
নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘‘প্যাকেটিং, পরিবহন, শ্রমিক মজুরিসহসব খাতে খরচ বেড়েছে। কম দামে চাল বিক্রি করা কঠিন।’’ তবে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির প্রচার সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘‘বড় করপোরেট মিলগুলোই মাঠ পর্যায় থেকে আগাম টাকা দিয়ে ধান কিনে নেয়। এতে স্থানীয় ছোট মিলগুলো পিছিয়ে পড়ে।’’
চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বলেন, ‘‘এক শ্রেণির কোম্পানি একসঙ্গে বিপুল ধান কিনে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করছে।’’
অভিযান শুধুই খুচরা বাজারে
মূল নিয়ন্ত্রকরা যেখানে ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেখানে অভিযান চলছে কেবল খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাজারে অভিযান চালানো হলেও মিল পর্যায়ে কোনো দৃশ্যমান তদারকি নেই।’’
কুষ্টিয়ায় চালের বস্তায় ২০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি
খাজানগর মোকামে সরু চালের ২৫ কেজির বস্তা ঈদের আগে বিক্রি হয়েছে ১৭২০ টাকায়, যা এখন ১৯২০ টাকা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা একে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বলে আখ্যা দিয়েছেন।
কুষ্টিয়া চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘‘এটা অস্বাভাবিক। দাম বৃদ্ধির পেছনে গভীর সিন্ডিকেট তৎপরতা থাকতে পারে। তদন্ত হওয়া দরকার।’’
ভোক্তার কষ্ট
রবিবার রাজধানীর কাপ্তান বাজারে মিনিকেট কিনতে আসা চাকরিজীবী মনির আহমেদ বলেন, ‘‘আগে মিনিকেট কিনতাম ৭৫-৭৮ টাকায়। এখন কিনছি ৮০-৮৩ টাকায়। প্রতিদিনের খরচের হিসাব কষেই বাজারে যেতে হয়।’’
সাম্প্রতিক চালের বাজার পরিস্থিতি বলছে, খাদ্য উৎপাদন নয় বাজার ব্যবস্থাপনাই এখন প্রধান সংকট। কৃষক ও ভোক্তা দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। লাভবান গুটিকয়েক মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীর। এই ব্যবস্থার সংস্কার না হলে বাম্পার ফলনেও জনগণের কষ্ট কমবে না।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘যখন ফসল কৃষকের হাতে থাকে, তখন দাম পড়ে। আর ফসল যখন যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে, তখনই মূল্য বাড়ে। পুরো ব্যবস্থাই এক ধরনের জিম্মি দশায় আছে।’’
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘‘দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রয়েছে। খুব দ্রুতই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে। চলতি মৌসুমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে।’’
তারপরও বাজারে চালের দাম কমছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘‘চালের দাম বাড়াতে বাজারে কোনো সিন্ডিকেট থাকলে তা ভেঙে দিতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। দক্ষিণাঞ্চলে সরু জাতের ধান চাষের কারণে ধান সংগ্রহে কিছু সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এবং সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।’’
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস থ সরবর হ পর য য় ন বল ন সরক র চ লকল
এছাড়াও পড়ুন:
চড়া মাছ-সবজি, দাম কমেছে ডিম-মুরগির
বাড়ছে চাল, সবজি ও মাছের দাম। গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে মাছ ও সবজির গড়ে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
শুক্রবার (৪ জুলাই) রাজধানীর নিউমার্কেট রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন বাজারে মানভেদে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৮২ থেকে ৮৪ টাকা। যা গত সপ্তাহ বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়। সে হিসেবে মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে দুই টাকা। ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৮ থেকে ৬২ টাকা। সেই হিসেবে এই জাতের চালের দাম বেড়েছে দুই থেকে তিন টাকা।
এছাড়া এখন বাজারে নাজিরশাইল চাল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, কাটারিভোগ ৭০ থেকে ৭৬ টাকা, স্বর্ণা গুটি চাল ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা এবং চিনি গুঁড়া পোলাও চাল মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়।
আরো পড়ুন:
চাল-মাছের দাম বেড়েছে, কমেছে ডিম-মুরগির দাম
ট্যানারি মালিকদের অপেক্ষায় নাটোরের চামড়া ব্যবসায়ীরা
বেড়েছে সবজি ও মাছের দাম
গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে সবজির দাম বেড়েছে। এখন বাজারে বেগুন মানভেদে প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০টাকা, করলা ৮০ টাকা, গাজর (দেশি) ১২০ টাকা, কাঁচামরিচ ১২০টাকা, প্রতিটি পিস লাউ ৫০, টমেটো ১৪০ টাকা, চিচিঙ্গা ৪০, দেশি শশা ৬০, বরবটি ৮০, ঢেড়শ ৫০, জালি কুমড়া ৫০ টাকা পিস, মিষ্টি কুমড়া কেজি ৩০ টাকা, পটোল ৫০ টাকা, কাঁকরোল ৭০ টাকা, কচুরমুখী ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে এখন প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬০, রসুন ১৮০ ও দেশি আদা ১২০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে, গত সপ্তাহের তুলনায় মাছের দামও বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ ভালো থাকলেও বাজারে মাছ কম থাকায় দাম বেড়েছে। বাজারে এখন এখন মাঝারি সাইজের চাষের রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে থেকে ৩৫০ টাকা। চাষের পাঙাস কেজি ১৯০ থেকে ২০০টাকা, তেলাপিয়া ২০০ থেকে ২২০, কৈ ২২০ থেকে ২৫০, দেশি শিং ৫০০ থেকে ৫৫০টাকা, বড় সাইজের পাবদা ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, চিংড়ি ৭০০ থেকে ৮০০টাকা, দেশি পাঁচমিশালি ছোট মাছ ৫০০ থেকে ৬০০টাকা, এক কেজি ওজনের ওপরে ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকা।
কমেছে ডিম ও মুরগির দাম
বিক্রেতারা বলছেন, সরবরাহ ভালো থাকার কারণে গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে ডিম ও মুরগির দাম কমেছে। এখন বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা। সোনালি মুরগির এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। এছাড়া বাজারে ফার্মের মুরগির ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়।
রাজধানীর রায়েরবাজার কেনাকাটা করতে আসা চাকরিজীবী রাজিব সিকদার রাইজিংবিডিকে বলেন, “এখন বাজারের চালসহ সবজি ও মাছের দাম বেড়েছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, সাধারণ মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।”
নিউমার্কেটের সবজি বিক্রেতা আজাদ হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, “দেশে বিভিন্ন স্থানে টানা বৃষ্টির জন্য কৃষকরা ঠিকমত সবজি সরবরাহ করতে পারছেন না। গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে সবজি দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরবরাহ বাড়লে আবার সবজি দাম স্বাভাবিক হবে।”
ঢাকা/রায়হান/সাইফ