গুয়ান্তানামোতে প্রত্যেক অভিবাসীর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক খরচ এক লাখ ডলার
Published: 21st, May 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসীদের রাখার জন্য কিউবায় গুয়ান্তানামো বে নৌঘাঁটি ব্যবহার করায় বন্দীপ্রতি দৈনিক এক লাখ ডলার খরচ হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার সিনেট হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গভর্নমেন্টাল অ্যাফেয়ার্স কমিটির এক শুনানিতে সিনেট সদস্য গ্যারি পিটার্স এমন দাবি করেছেন। তাঁর মতে, এ খরচ সরকারের অর্থের অপচয়ের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এ কমিটির শীর্ষস্থানীয় ডেমোক্র্যাট সদস্য গ্যারি পিটার্স হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের মন্ত্রী ক্রিস্টি নোয়েমের কাছে এ উচ্চ খরচের ব্যাখ্যা চেয়েছেন। খরচের এই পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আটককেন্দ্রে প্রতিদিনের ১৬৫ ডলার খরচের তুলনায় বহুগুণ।
মার্কিন করদাতাদের টাকায় কেন বন্দী অভিবাসীদের কিউবায় মার্কিন নৌঘাঁটি গুয়ান্তানামোয় পাঠানো হচ্ছে এবং পরে আবার তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন পিটার্স।
পিটার্স বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন গুয়ান্তানামোয় ১ জনকে রাখার জন্য ১ লাখ ডলার খরচ করছি। ওখানে কিছুদিন রাখার পর আবার তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনতে হয়। অথচ এখানে রাখলে প্রতিদিন মাত্র ১৬৫ ডলার খরচ হতো। আমি মনে করি, এটা একেবারেই অযৌক্তিক।’
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, গুয়ান্তানামোতে অভিবাসীদের প্রতিদিন অন্তত ২৩ ঘণ্টা জানালাবিহীন কক্ষে আটকে রাখা হয়, তাঁদের নগ্ন দেহ তল্লাশির মতো পদ্ধতির মুখোমুখি করা হয় এবং পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। বন্দীদের কেউ কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করেছে এসিএলইউ।অভিবাসনসংক্রান্ত আইন কার্যকর করতে ব্যাপকভাবে তহবিল বাড়ানোর অনুরোধ করেছে হোয়াইট হাউস। কারণ, অভিবাসীদের গণহারে বিতাড়িত করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যে লক্ষ্য রয়েছে, তা অর্জন করার চেষ্টা চলছে। চলতি মাসে কংগ্রেসের কাছ থেকে ২০২৬ অর্থবছরের জন্য হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগে অতিরিক্ত ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বরাদ্দ চেয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। আগামী ১ অক্টোবর থেকে নতুন অর্থবছর শুরু হচ্ছে।
আরও পড়ুন৩০ হাজার অভিবাসীকে কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বেতে আটকে রাখার পরিকল্পনা জানালেন ট্রাম্প৩০ জানুয়ারি ২০২৫বরাদ্দের অনুরোধের পক্ষে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে কমিটির সামনে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের মন্ত্রী ক্রিস্টি নোয়েম বলেন, গুয়ান্তানামো বেতে অভিবাসীদের রাখার দৈনিক খরচ কত, তা তিনি জানেন না।
এক বিবৃতিতে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের মুখপাত্র ট্রিশা ম্যাকলাফলিন বলেন, মার্কিন নাগরিকদের নিরাপদ রাখতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বদ্ধপরিকর।
কমিটির রিপাবলিকান চেয়ারম্যান ও সিনেট সদস্য র্যান্ড পলও যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে অতিরিক্ত সীমান্তপ্রাচীর নির্মাণের খরচ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কারণ, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসার চেষ্টা করা অভিবাসীর সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে গেলেও সীমান্তপ্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে গুয়ান্তানামোয় প্রায় ৭০ জন অভিবাসী আটক আছেন।
নাগরিক অধিকার সংগঠন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) গত মার্চ মাসে একটি মামলা করেছিল। এর মধ্য দিয়ে ১০ জন অভিবাসীকে গুয়ান্তানামো ঘাঁটিতে স্থানান্তরের পরিকল্পনা ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়।
আরও পড়ুনঅবৈধ অভিবাসীদের ৩০ দিনের মধ্যেই গুয়ানতানামো বেতে পাঠাতে চান ট্রাম্প০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫আরও পড়ুনঅনিবন্ধিত অবৈধ অভিবাসীদের জরিমানা ও কারাদণ্ড দেওয়ার প্রস্তাব ট্রাম্পের২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে যে গুয়ান্তানামোয় অভিবাসীদের প্রতিদিন অন্তত ২৩ ঘণ্টা জানালাবিহীন কক্ষে আটকে রাখা হয়, তাঁদের নগ্ন দেহ তল্লাশির মতো পদ্ধতির মুখোমুখি করা হয় এবং পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। বন্দীদের কেউ কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করেছে এসিএলইউ।
কমিটির রিপাবলিকান চেয়ারম্যান ও সিনেটর র্যান্ড পলও যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে অতিরিক্ত সীমান্তপ্রাচীর নির্মাণের খরচ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কারণ, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসার চেষ্টা করা অভিবাসীর সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে গেলেও সীমান্তপ্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের বাজেট পরিকল্পনায় শুধু সীমান্তপ্রাচীরের জন্যই ৪ হাজার ৬৫০ কোটি ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
র্যান্ড পল বলেন, ‘আমি বলছি না যে, নতুন করে কোনো অর্থের দরকার নেই। সীমান্তে আমাদের আরও টহল প্রয়োজন। আর এর জন্য অবশ্যই আরও অর্থ লাগবে। তবে আমি মনে করি, এটা যুক্তিসঙ্গত সীমার মধ্যে থাকা উচিত।’
আরও পড়ুনঅভিবাসীদের নিবন্ধন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন আইনের প্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র১৩ এপ্রিল ২০২৫আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রকে ‘অধিকৃত দেশ’ বললেন ট্রাম্প, ইঙ্গিত অবৈধ অভিবাসীদের দিকে০৫ নভেম্বর ২০২৪.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্প কীভাবে ‘ম্যাডম্যান তত্ত্ব’ ব্যবহার করে বিশ্ব বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গত মাসে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ইরানে হামলায় তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন কি না। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এটা করতে পারি। আবার আমি না-ও করতে পারি। আমি কী করতে যাচ্ছি, তা কেউই জানে না।’
ট্রাম্প বিশ্বকে এমনটা বিশ্বাস করতে দিয়েছিলেন যে ইরানকে আলোচনা শুরুর সুযোগ দিতে দুই সপ্তাহ হামলা স্থগিত রাখার বিষয়ে তিনি সম্মত হয়েছেন। কিন্তু পরে এ সময়ের মধ্যেই তিনি হামলা চালিয়ে বসেন।
এ ঘটনায় একটি প্রবণতা সামনে এসেছে, ট্রাম্পের সম্পর্কে সবচেয়ে অনুমেয় বিষয়টি হলো তাঁর অননুমেয় আচরণ। তিনি তাঁর চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করেন। তিনি স্ববিরোধী কাজ করেন। তাঁর কথা আর কাজে মিল নেই।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক পিটার ট্রুবোউইৎজ বলেন, ‘(ট্রাম্প) একটি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া তৈরি করেছেন, অন্তত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে। সম্ভবত (প্রেসিডেন্ট) রিচার্ড নিক্সনের পর থেকে এটিই সবচেয়ে কেন্দ্রীভূত।’ তিনি বলেন, ‘এটি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলোকে ট্রাম্পের আচরণ, তাঁর পছন্দ ও মেজাজ-মর্জির ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল করে তুলেছে।’
ট্রাম্প তাঁর এই বৈশিষ্ট্যকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে আসছেন। তিনি তাঁর নিজের অননুমেয় আচরণকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও রাজনৈতিক সম্পদে পরিণত করেছেন। তিনি এই অননুমেয় আচরণকে একটি মতবাদ বা নীতির পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আর এখন যে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য তিনি হোয়াইট হাউসে নিয়ে এসেছেন, সেটিই পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি বিশ্বব্যবস্থার বিদ্যমান কাঠামো পাল্টে দিচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এটিকে ‘ম্যাডম্যান থিওরি’ বা ‘খ্যাপাটে তত্ত্ব’ বলে থাকেন। এই তত্ত্বে একজন বিশ্বনেতা তাঁর প্রতিপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি নিজের মেজাজ-মর্জিমতো যেকোনো কিছু করতে সক্ষম, যাতে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা যায়। সফলভাবে ব্যবহার করা হলে এটি একধরনের জবরদস্তি বা চাপ প্রয়োগের কৌশল হতে পারে। ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, এটি সুফল দিচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের তাঁর পছন্দমতো অবস্থানে নিয়ে আসতে পারছেন।
কিন্তু এটি কি এমন পদ্ধতি, যা শত্রুদের বিরুদ্ধেও কাজে দেবে? আর এর ত্রুটি কি এমনটি হতে পারে যে এটি প্রতিপক্ষকে বোকা বানানোর জন্য তৈরি করা একটি কৌশল না হয়ে বরং সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুস্পষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যার ফলে তাঁর আচরণ আরও সহজে অনুমানযোগ্য হয়ে ওঠে?
কথার আক্রমণ, অপমান ও কাছে টানা
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে কাছে টেনে আর আমেরিকার মিত্রদের কথার আক্রমণের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করেন। তিনি কানাডাকে অপমান করে বলেছিলেন, দেশটির যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য হয়ে যাওয়া উচিত।
ট্রাম্প বলেছিলেন, গ্রিনল্যান্ডকে (আমেরিকার মিত্র ডেনমার্কের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত করার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগের কথা বিবেচনা করতে তিনি প্রস্তুত। তিনি আরও বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পুনরায় পানামা খালের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
সামরিক জোট ন্যাটো সনদের ৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি সদস্যদেশ অন্য দেশকে রক্ষায় এগিয়ে আসার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের এ অঙ্গীকারকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেন। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘আমি মনে করি, (ন্যাটো সনদের) ৫ অনুচ্ছেদ লাইফ সাপোর্টে আছে।’
ন্যাটো সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (প্রথম সারিতে বাঁ থেকে চতুর্থ) ও বিশ্বনেতারা