হাজারো অবৈধ ফার্মেসি হুমকিতে জনস্বাস্থ্য
Published: 21st, May 2025 GMT
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অলিগলিতে গড়ে উঠেছে সহস্রাধিক ফার্মেসি। বেশির ভাগ ফার্মেসিতেই নেই ড্রাগ লাইসেন্স ও ফার্মাসিস্ট। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই চলছে এসব ওষুধের দোকান।
অভিযোগ রয়েছে, এসব ফার্মেসি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক, নিষিদ্ধ, ভারতীয় নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের নানা প্রকার ওষুধ অবাধে বিক্রি করছে। এ ছাড়া ওষুধের দোকানগুলোতে নেই কোনো প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট। ফলে রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে আরও জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে রোগী। এতে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে অনেক রোগী ও তাদের পরিবার। হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।
উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, আড়াইহাজার উপজেলার ২টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নের বাজারে গড়ে উঠেছে ড্রাগ লাইসেন্সহীন শতশত ফার্মেসি। ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ও অতিরিক্ত চিকিৎসক ফি’র কারণে এ এলাকার মানুষ উপজেলা সদরে বা নিবন্ধিত চিকিৎসকের কাছে যান না। তারা তাদের পার্শ্ববর্তী বাজারে ফার্মেসিগুলোর শরণাপন্ন হন। এ সুযোগকে কাজে লাগায় ওষুধের দোকানগুলো।
উপজেলা সদর, গোপালদী, বগাদী, রাধানগর, কালাপাহাড়িয়া, মানিকপুর, পূর্বকান্দি, জাঙ্গালিয়া, কলাগাছিয়া, রামচন্দ্রদী, কালীবাড়ি, কালীরহাট, ব্রাহ্মন্দী, মারুয়াদী, দুপ্তারা, পাঁচগাও, সাতগ্রাম বাজারসহ ৩০ থেকে ৩৫টি বাজারে কয়েকশ ফার্মেসির ড্রাগ লাইসেন্স ও ফার্মাসিস্টের প্রশিক্ষণ নেই।
এসব ফার্মেসিতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক, ঘুমের বড়ি, যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, নিষিদ্ধ, ভারতীয়, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের নানা প্রকার ওষুধ অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন ওষুধ ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা, অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন।
ওষুধ আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তি ওষুধের দোকান বা ফার্মেসি দিতে চাইলে তাকে কমপক্ষে ছয় মাসের ফার্মাসিস্ট কোর্স করে সনদ সংগ্রহ করতে হয়। পরে সংশ্লিস্ট ড্রাগ সুপারের কার্যালয়ে ফার্মাসিস্ট সনদ জমা দিয়ে ড্রাগ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হয়। ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো খুচরা বিক্রেতা বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের কোনো রেজিস্ট্রারের রেজিস্ট্রিভুক্ত ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধান ছাড়া কোনো ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না। অথচ উপজেলার বেশির ভাগ ওষুধের দোকানে এসব নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই।
গত মঙ্গলবার অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখার দায়ে উপজেলা সদর বাজারের আল আমিন ফার্মেসিকে ৩০ হাজার এবং জামাল ফার্মেসিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়সহ মুচলেকা নেওয়া হয়। সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ নঈম উদ্দিনের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত এ অভিযান চালান।
উপজেলা সদরে আল আমিন ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে আসা খাগকান্দা গ্রামের জালাল উদ্দিন জানান, এখন ফার্মেসিতে বিশেষজ্ঞ লোকের দরকার হয় না। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলে দেন কোন ওষুধ কখন ও কী কাজে লাগে। সেই অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি হয়। এ ছাড়া অনেক ওষুধের দোকানে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করেন।
গোপালদী এলাকার নিজামউদ্দিন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে ভালো মানের ওষুধের চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি কমিশন নেওয়া হচ্ছে। এতে বেশি লাভের আশায় ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে ওষুধ ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষও কোন ওষুধটি আসল কোনটি ভেজাল তা চিহ্নিত করতে পারে না। ফলে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বাণিজ্য যেমন দিন দিন জমজমাট হচ্ছে, তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ফার্মেসির মালিক বলেন, এই উপজেলায় যে যার মতো করে ওষুধের দোকান দিয়েছেন। হাতেগোনা কয়েকজনের ফার্মাসিস্ট সনদ রয়েছে। অনেকেরই ড্রাগ লাইসেন্স নেই।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, এ উপজেলায় অনেক ওষুধের দোকান রয়েছে। তবে হাতেগোনা কয়েকটি ফার্মেসিতে ডিপ্লোমাধারী ফার্মাসিস্ট রয়েছে। ১৯৪৬ সালের ওষুধ বিধিমালা অনুযায়ী ফার্মাসিস্ট ও ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া ওষুধ মজুত, প্রদর্শন ও বিক্রি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আড়াইহাজারের ইউএনও সাজ্জাত হোসেন বলেন, ফার্মেসি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এখানে ড্রাগ লাইসেন্স ও একজন প্রশিক্ষিত ব্যক্তির সার্বক্ষণিক থাকা প্রয়োজন। এসব না থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সংরক্ষণকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক ব যবস থ উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
একাই মাসে শতাধিক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে দেন তৈয়বুর
সুনামগঞ্জে জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে যাঁদের নাম প্রথমেই মনে আসে, তাঁদের একজন তৈয়বুর রহমান (২৬)। তিনি নিজে নিয়মিত রক্ত দেন, রক্ত সংগ্রহ করে দেন এবং মানুষকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করেন। রক্তের টানে মানুষের পাশে দাঁড়ানোতেই তাঁর আনন্দ।
একটি বেসরকারি ব্যাংকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রক্তদানের এই মানবিক কাজকে নিজের করে নিয়েছেন তিনি। কয়েক বছর আগে একাই মানুষের জন্য রক্ত জোগাড় করতেন। এখন তিনি ব্লাড লিংক সুনামগঞ্জ নামের স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। ফলে কাজের পরিধি বেড়েছে কয়েক গুণ। মাসে একাই শতাধিক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে দেন তিনি। সংগঠনে যুক্ত হওয়ার পর থেকে আড়াই হাজারের বেশি রোগীর জন্য রক্ত জোগাড় করে দিয়েছেন। তাঁর কাছে আছে প্রায় এক হাজার রক্তদাতার ঠিকানা, রক্তের গ্রুপ ও যোগাযোগের তালিকা। সুনামগঞ্জে স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী ও সংগঠকেরাও তাঁকে সহযোগিতা করেন।
তৈয়বুর রহমানের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। তিনি ইসলামী ব্যাংক সুনামগঞ্জ শাখায় নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। রক্তের প্রয়োজনে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, পরিবহন বা দৌড়ঝাঁপ—সবকিছুর ব্যয়ই মেটান নিজের স্বল্প বেতন থেকে।
রক্তদানের শুরুর স্মৃতি বলতে গিয়ে তৈয়বুর রহমান জানান, ২০২০ সালে তিনি তখন নারায়ণগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। এক সহকর্মীর অনুরোধে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য রক্ত দিতে ছুটে যান চাষাড়া এলাকায়। কিন্তু ওজন কম থাকায় রক্ত দিতে পারেননি। পরে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত এক শিশুর জন্য আবার হাসপাতালে যান এবং এবার রক্ত দিতে সক্ষম হন। প্রথমে কিছুটা ভয় ভয় ছিল তাঁর। পরে এটা কেটে যায়।
সুনামগঞ্জে বদলি হয়ে ফিরে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে মানুষের জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে থাকেন বলে জানান তৈয়বুর রহমান। নিজের এলাকায় রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার আয়োজন ও সচেতনতা ক্যাম্পেইনও করেছেন। এখন পর্যন্ত তিনি ১৭ বার রক্ত দিয়েছেন। অধিকাংশই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য। ঈদের দিনও রক্ত দিয়েছেন তিনি। জেলা সদর হাসপাতাল ও শহরের সব বেসরকারি ক্লিনিকেই তাঁর নম্বর আছে। কোনো রোগীর জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে সেখান থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো রোগীর জন্য উপযুক্ত রক্তদাতা খুঁজে বের করা।
তৈয়বুর রহমান বলেন, রক্তদানের পর কিছু পরিবার এখনো তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, খবর নেয়। আবার কেউ কেউ রক্ত সংগ্রহে একটু দেরি হলে মনঃক্ষুণ্ন হন। কেউ রক্ত পেয়ে ধন্যবাদ দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেন না। তবু মন খারাপ করেন না তিনি। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে তাহিরপুর উপজেলার এক প্রসূতি বোনকে রক্ত দিয়েছিলাম। এখনো ওই পরিবার যোগাযোগ রাখে। সময়-অসময় খোঁজ নেয়। এটা ভালো লাগে, এটা অন্য রকম রক্তের সম্পর্ক। এই কাজ করে আনন্দ পাই, তৃপ্তি পাই। যত দিন পারি, এই কাজ করে যাব।’
এখন পর্যন্ত ১৭ বার রক্ত দিয়েছেন তৈয়বুর রহমান