আশির দশকের কৃষি ব্যবস্থায় উৎপাদন থেকে শুরু করে সবকিছুতে কৃষক ছিল প্রায় স্বনির্ভর। গৃহস্থের বাড়িতে নতুন ধান আসার পরে মাড়াই শেষে হৃষ্ট, পুষ্ট দানা দেখে বীজ সংগ্রহ করা হতো। বিভিন্ন সিজনে বিভিন্নরকম ধান উঠতো। প্রত্যেক সিজনে ভালো ধান থেকে বীজ আলাদা করে, শুকিয়ে পরিষ্কার মাটির পাতিলে সংরক্ষণ করা হতো। পরবর্তী বীজ রোপণ করা পর্যন্ত একজন নারী দক্ষতার সঙ্গে বীজ সংরক্ষণের কাজটি করতেন। তবে পুরুষেরা এই কাজে একজন নির্দেশক হিসেবে কাজ করতেন।
বীজ বা ধান সংরক্ষণের জন্য আলাদা ঘর থাকতো। ধান রাখার ঘরকে বলা হতো গোলাঘর। মাচা তৈরি করে বাঁশের ডোল বা বেঁড়ি অথবা মাটির মটকাতেও বীজ রাখা হতো। বীজ রেখে পাত্রের মুখটা পাতলা সুতি কাপড় দিয়ে আটকে রাখা হতো। যাতে ময়লা বা পোকামাকড় না ঢোকে। একই প্রক্রিয়ায় তখন ধান, সবজি কিংবা ফলের বীজ সংগ্রহ করা হতো। তখন বাজার থেকে বীজ সংগ্রহ করতে দেখা যেত না।
সবজির ক্ষেত্রেও বীজ সংগ্রহ করার জন্য সেরা সবজিটি নির্বাচন করা হতো। যেমন লাউয়ের জাংলায় ভালো ভালো লাউ ‘বস হিসেবে’ রাখা হতো বীজের জন্য। অন্যান্য ফল বা সবজির ক্ষেত্রেও দেখা যেতো একই নিয়ম। গৃহস্থের বাড়িতে নিজস্ব বাগানের ফল, ক্ষেতের ফসল থেকে বীজ সংগ্রহ করা হতো। যেটা এখন বহুজাতিক কোম্পানি প্যাকেটজাত করে বিক্রি করে থাকে।
বাড়ির একটা কোণায় একটু গর্ত করে জৈব সার উৎপাদন করার ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেক বাড়িতে গরু থাকতো, সেই গরুর গোবর এবং রান্নার উচ্ছিষ্ট গর্তে জমা করা হতো। পঁচন ধরলে সেখান থেকে জৈব সারা উৎপাদন করা হতো। অনেক সময় পালানেও জৈব সার উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকতো।
ক্ষেতের ধান কাটার পরে যে নাড়া থাকতো সেগুলো পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে জমিতে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। যা জৈব সার হিসেবে কাজ করতো। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরণের শেওলা বা জলজ উদ্ভিদ বর্ষার মৌসুমে জমিতে জন্মাতো, সেগুলো আবার বর্ষা শেষে আগুনে পুড়িয়ে ছাই বানানো হতো। তারপর সেই ছাই জমিতে ছিটিয়ে দেওয়া হতো। এভাবে জমির উর্বরতা বাড়ানো হতো।
বর্ষায় বা বন্যায় প্রচুর পলি আসতো, এভাবেও জমিতে উর্বরতা বাড়তো। সে সময় সত্যিকার অর্থে সেভাবে রাসায়নিক সারা ব্যবহার করা হতো না। এরপরে যখন সেচভিত্তিক ইরি চাষ শুরু হলো তখন রাসায়নিক সার-ইউরিয়া, পটাশ, সালফারের ব্যবহার বাড়তে শুরু করলো। ধীরে ধীরে জৈব সার ব্যবহার কমে আসলো। চাষাবাদ ছিল গরু ও লাঙ্গলভিত্তিক। লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করা হতো। যে মাটি অনেক শক্ত ছিল সেই মাটির ঢেলা ভাঙতে ‘ইটা মুগুড়’ ব্যবহার হতো। গরু টানা লাঙল দিয়ে হাল চাষ করে পরে মই দিয়ে মাটি সমান করা হতো।
সেচভিত্তিক যে পদ্ধতি ছিল সেটা হলো ‘দোন ব্যবস্থা’। ধরা যাক, একটি পুকুর, নদী বা খাল আছে সেখানে কাঠের এক ধরণের ছোট নৌকা ডুবিয়ে সেই পানি ড্রেনের মাধমে জমিতে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। স্বাধীনতার পর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় সেচ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। রাশিয়ার সহযোগিতায় দেশে গভীর নলকূপ স্থাপিত হয়েছিল। যেগুলো পল্টন নামে ডাকা হতো। এ ছাড়া হাতের সাহায্যে ‘টিনের সেউতি’ দিয়ে জমিতে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এরপরে ধীরে ধীরে স্যালো মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকলো। ধীরে ধীরে ইলেকট্রিক পাম্পও আসলো। ফলে দোন ব্যবস্থা বা পল্টন ব্যবস্থা বিলোপ হলো।
ওই সময় সাধারণত দুই ফসল হতো। যার ফলে জমি কিছুটা বিশ্রাম পেতো। এখন কোনো কোনো জায়গায় তিনটা থেকে চারটা ফসল তোলার চেষ্টা করছি। একটা সময় মাটি তার উর্বরতা হারিয়ে ফেলতে পারে। কৃষিতে বিবর্তনের আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে ইট ভাটা। ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি দিয়ে ইট বানানো হচ্ছে। ফলে মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে প্রতি বছর কৃষি জমির পরিমাণ কমে আসছে। এই অবস্থায় আমরা যদি মাটির উর্বরতা রক্ষার দিকে মনোযোগ না দেই তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে, উৎপাদনশীলতার ক্ষমতা হারাতে পারে মাটি।
হাল চাষে এখন যান্ত্রিকীকরণ হয়ে গেছে। গরু দিয়ে হাল চাষ হয় না, এজন্য পাওয়ার টিলার আর ফসল কাটার জন্য হারভেস্টার মেশিন ব্যবহার হচ্ছে। ফসল মাড়াইয়ের জন্য প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে এতে কাজের গতি বেড়েছে। এসব প্রযুক্তি না এলে কৃষিতে অনেক রকম সংকট তৈরি হতো। যেহেতু কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। আগে পোকামাকড়ের আক্রমণে ফসল নষ্ট হয়ে যেত, কৃষক এক রকম আত্মসমর্পণ করতো। সেই অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে।
আগে কৃষক সমন্বিত ব্যবস্থায় খাদ্যশস্য, ফল, মশলা, ওষুধী উৎপাদন করতো। এখন আর এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না। এখন যে মশলা উৎপাদন করছে সে মশলা উৎপাদনই করছে, যে ফলের বাগান করছে সে ফলের বাগানই করছে এখন সমন্বিত কৃষি দেখা যায় না। এতে কৃষকের পরনির্ভরশীলতা বেড়েছে, স্বনির্ভরতা কমেছে। আমার মনে হয় সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ হওয়ার আবার সময় এসেছে।
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস থ ব যবহ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
হামাস গাজার ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে: শীর্ষ কর্মকর্তা
হামাস ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির এক শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তিনি জানান, গাজায় হামাসের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা কাঠামো ভেঙে পড়ার ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করছে স্থানীয় সশস্ত্র গোত্রগুলো।
ওই কর্মকর্তা বলেন, কয়েক মাস ধরে চলা ইসরায়েলি বিমান হামলায় হামাসের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, যা সংগঠনটির রাজনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তা নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
হামাসের ওই শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধ শুরুর প্রথম সপ্তাহে ইসরায়েলি হামলায় আহত হন। এর পর থেকে স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে তিনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিবিসিকে বেশ কিছু ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছেন। ভয়েস মেসেজগুলোতে ওই কর্মকর্তা হামাসের অভ্যন্তরে ভাঙনের এবং গাজাজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রায় পুরোপুরি পতনের একটি চিত্র তুলে ধরেন। সংঘাত শুরুর আগে অঞ্চলটি হামাসের শাসনাধীন ছিল।ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘চলুন বাস্তববাদী হই — নিরাপত্তা কাঠামোর প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। নেতৃত্বের প্রায় ৯৫ শতাংশ এখন মৃত... সক্রিয় ব্যক্তিরা সবাই মারা গেছেন। তাহলে ইসরায়েলকে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া থেকে আটকাবে কিসে?’
গত সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ঘোষণা দেন যে, ‘সামরিক কাঠামো হিসেবে হামাস আর অস্তিত্ব নেই। তারা এখন গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত।’
ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তার মতে, চলতি বছরের শুরুতে ইসরায়েলের সঙ্গে ৫৭ দিনের যুদ্ধবিরতির সময় হামাস তাদের রাজনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তা পরিষদ পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মার্চে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে আবার হামাসের অবশিষ্ট নেতৃত্ব কাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এর ফলে সংগঠনটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে
আরও পড়ুনআগামী সপ্তাহেই গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে: ট্রাম্প০৫ জুলাই ২০২৫হামাসের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলি: এটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। একেবারে শেষ। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ তিনি বলেন, ‘মানুষ হামাসের সবচেয়ে শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনীর (আনসার) কার্যালয় লুট করেছে, যা হামাস গাজা শাসনের জন্য ব্যবহার করত।
ওই কর্মকর্তা জানান, নিরাপত্তা শূন্যতার ফলে গাজায় সশস্ত্র গোষ্ঠী বা গোত্র ‘সর্বত্র’ ছড়িয়ে পড়েছে। ‘তারা আপনাকে থামাতে পারে, হত্যা করতে পারে। কেউ বাধা দেবে না। কেউ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে ইসরায়েল আধ ঘণ্টার মধ্যে বোমাবর্ষণ করে।
গত ২৬ জুন ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় গাজার একটি বাজারে অন্তত ১৮ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। হামলার সময় সেখানে দাম বৃদ্ধি ও ত্রাণ লুটের অভিযোগে অভিযান চালাচ্ছিল হামাসের পোশাকবিহীন পুলিশ বাহিনী।
আরও পড়ুনমার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার নিতে এসে প্রাণ গেছে ৭৪৩ ফিলিস্তিনির১৪ ঘণ্টা আগেঅন্যদিকে গাজার দক্ষিণে ছয়টি সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা স্থানীয় ক্ষমতাসীন গোত্রের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে যাসের আবু শাবাব নামে এক নেতা পশ্চিম তীরে হামাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য স্থানীয় প্রভাবশালীদের নজর কাড়েন। ইসরায়েল তাঁকে অস্ত্র সরবরাহ করছে বলে জানা গেছে। হামাস তাঁকে হত্যার জন্য বড় অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
গাজার কয়েকটি সূত্র বিবিসিকে বলেছে, আবু শাবাব ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী একটি যৌথ পরিষদ গঠন করে হামাসকে উৎখাতের পরিকল্পনা করছে।
গাজায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতর চরম অবনতি ঘটেছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেছে। হামাসের জন্য এখন ইসরায়েলি হামলার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বীরা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুনইসরায়েলিদের হামলা-নির্যাতন: অতিষ্ঠ বেদুইন পরিবারগুলো ছাড়ছে পশ্চিম তীর০৫ জুলাই ২০২৫