ঘড়ির চাপে কি আমাদের ইবাদতের ক্ষতি হচ্ছে
Published: 22nd, May 2025 GMT
আপনার কবজির ঘড়ি বা কম্পিউটারের কোণে ঝলকানো সংখ্যাগুলোর দিকে তাকান। যদি বলা হয়, এই নিরীহ চেহারার সময়-নির্দেশক সংখ্যাগুলো আপনার জীবনকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, যা আপনি কখনো কল্পনাও করেননি? হয়তো অবাক হবেন, কিন্তু এই যান্ত্রিক ঘড়ি আমাদের আধ্যাত্মিকতা, সম্পর্ক, স্বাস্থ্য ও কাজের ধরনকে বদলে দিয়েছে। এটি কেবল সময় মাপার যন্ত্র নয়, আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক অদৃশ্য শাসক।
সময়ের প্রাকৃতিক ছন্দে যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ
কল্পনা করুন, আপনি উপনিবেশকালের আগে মুসলিম বিশ্বের কোনো গ্রামে জন্মেছেন। তখন সময় মাপা হতো মসজিদের প্রাঙ্গণে সূর্যঘড়ির মাধ্যমে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের তাল রাখত সময়। সময় ছন্দ মিলাত প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত সূর্য, চাঁদ আর নামাজের আজানের সুরে। ড.
কিন্তু ১৩ শতকে ইউরোপের মঠগুলোতে যান্ত্রিক ঘড়ির আবির্ভাব ঘটে। ঐতিহাসিক ডেভিড ল্যান্ডেস তাঁর রেভোল্যুশন ইন টাইম বইতে বলেছেন, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা যখন আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি নিয়ে এসেছিল, তখন তারা ঘড়িটাওয়ার ও হাতঘড়ি প্রবর্তন করে। এটি কেবল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ছিল না, মনন দর্শনেও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এর ফলে সময়ের ধারণা প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান্ত্রিক নির্ভুলতার দাসে পরিণত হয়।
আরও পড়ুনজীবনে একবার হলেও যে নামাজ পড়তে বলেছেন নবীজি (সা.)১৩ মার্চ ২০২৫আধ্যাত্মিকতার ওপর ঘড়ির প্রভাব
আপনি কি কখনো নামাজে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে আনন্দ অনুভব করেছেন? এটা তখনই সম্ভব, যখন আপনার ওপর সময়ের চাপ নেই। আজ মসজিদে ঢুকলেই দেয়ালে ঘড়ি আর নামাজের কাউন্টডাউন। এটি আমাদের নামাজকে তাড়াহুড়া করিয়ে দেয়। ইবনুল কাইয়্যিম তাঁর আল-ওয়াবিল আস-সায়্যিব-এ লিখেছেন, প্রাচীন মুসলিমরা ইবাদতে এত মগ্ন থাকতেন যে সময়ের অস্তিত্বই ভুলে যেতেন।
জুমার খুতবা, যা একসময় সম্প্রদায়ের জন্য প্রাণবন্ত আলোচনার মঞ্চ ছিল, এখন ১৫-২০ মিনিটের একটি সময় বাঁধা অনুষ্ঠান। রমজানের তারাবিহ নামাজও এক পারা থেকে কয়েক পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে সময়ের চাপে। এই যান্ত্রিক সময় আমাদের আধ্যাত্মিকতাকে সংকুচিত করছে।
সম্পর্কের ওপর সময়ের চাপ
‘চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে!’—এই কথাগুলো আমাদের পরিবারে অহরহ শোনা যায়। সমাজবিজ্ঞানী জুডি ওয়াজম্যান তাঁর প্রেসড ফর টাইম-এ বলেন, সময়ের এই চাপ পরিবারে উদ্বেগ ছড়ায়। ড. উইলিয়াম ডোহার্টির গবেষণা দেখায়, সময়ের তাড়ায় পিতা–মাতা-সন্তানের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা তাড়াহুড়ায় সন্তানের সঙ্গে মূল্যবান মুহূর্ত হারাই।
নৃতত্ত্ববিদ থমাস হিল্যান্ড এরিকসেন তাঁর টাইর্যানি অব দ্য মোমেন্ট-এ বলেন, পারিবারিক সমাবেশ এখন কঠোর সময়সূচির অধীন। আমাদের স্মৃতিগুলো তখনই গভীর হয়, যখন আমরা সময়ের তাড়না ছাড়াই একে অপরের সঙ্গে থাকি।
স্বাস্থ্য ও কাজের ওপর প্রভাব
যান্ত্রিক ঘড়ির চাপ আমাদের কাজের প্রবাহ নষ্ট করে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণা বলছে, সময়ের চাপ শারীরিক বিপদের মতো স্ট্রেস সৃষ্টি করে। ড. রবার্ট লেভিন তাঁর আ জিওগ্রাফি অব টাইম-এ ‘ক্লক-টাইম সিকনেস’ নামে একটি আধুনিক সমস্যার কথা বলেন, যা দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
মিহালি সিকসেন্টমিহালির গবেষণা দেখায়, সময়ের তাড়না আমাদের কাজের প্রবাহ ভেঙে ফেলে, যা আমাদের কর্মক্ষমতা ও আনন্দ নষ্ট করে। জাপানে ‘কারোশি’ বা অতিরিক্ত কাজে মৃত্যুর ঘটনা এই যান্ত্রিক সময়ের চাপেরই ফল।
আরও পড়ুনঅর্থ বুঝে নামাজ পড়ার ফজিলত১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন
যান্ত্রিক ঘড়ি একটি সরঞ্জাম, আমাদের প্রভু নয়। দার্শনিক মার্শাল ম্যাকলুহান বলেন, ‘আমরা আমাদের সরঞ্জাম গঠন করি, তারপর সেগুলো আমাদের গঠন করে।’ ঘড়ি আমাদের সময়ের অভিজ্ঞতাকে বদলে দিয়েছে। সাইয়্যেদ হোসেন নাসর তাঁর ট্র্যাডিশনাল ইসলাম ইন দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড-এ বলেন, যান্ত্রিক সময় গ্রহণ আমাদের ঐশ্বরিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
ব্যবহারিক পদক্ষেপ
১. সময়ের চাপ সম্পর্কে সচেতনতা: সময়ের চাপ কখন অনুভব করেন, তা লক্ষ করুন। এটি কি প্রয়োজনীয়? নাকি অভ্যাসগত? অপ্রয়োজনীয় চাপের সময় জিকির বা কোরআন পড়ুন। ২. ঘড়িমুক্ত সময়: সপ্তাহান্তে ঘড়ি না পরে কোরআন পড়ুন বা প্রকৃতিতে হাঁটুন। দেখুন, আপনার স্ট্রেস কমে কি না। ৩. সম্পর্কের নিরাময়: দেরির জন্য বিরক্ত হলে থামুন। এটি কি সত্যিই চাপ, ভাবুন তো? পরিবারের সঙ্গে সময়ের চাপ নিয়ে আলোচনা করুন। ৪. আল্লাহর সময়ের সঙ্গে সংযোগ: সূর্যের অবস্থান দেখে নামাজের সময় নির্ধারণ করুন। হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসরণ করুন। ৫. সীমানা নির্ধারণ: প্রয়োজনীয় কাজে ঘড়ি ব্যবহার করুন, তবে অপ্রয়োজনীয় চাপ এড়ান।
শেষ কথা
কল্পনা করুন, একটি মসজিদে কোনো ঘড়ি নেই। প্রথমে হয়তো অস্বস্তি হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে আপনি নামাজে মগ্ন হবেন। ঘড়ির চাপ ছাড়া নামাজ হবে শান্ত, মনোযোগী। বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো হবে অতুলনীয়। সময়ের চাপ এলেও ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে তা মোকাবিলা করুন। আমাদের লক্ষ্য ঘড়িকে প্রভু নয়, সেবক হিসেবে ব্যবহার করা। এভাবে আমরা সময়ের সঙ্গে সুস্থ ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারব, ইনশাআল্লাহ।
প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম অবলম্বনে
আরও পড়ুনদোয়া কুনুত: বাংলা উচ্চারণ, অর্থ, ফজিলত ও পড়ার নিয়ম১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব র আম দ র র ওপর আপন র র সময
এছাড়াও পড়ুন:
হামাস গাজার ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে: শীর্ষ কর্মকর্তা
হামাস ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির এক শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তিনি জানান, গাজায় হামাসের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা কাঠামো ভেঙে পড়ার ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করছে স্থানীয় সশস্ত্র গোত্রগুলো।
ওই কর্মকর্তা বলেন, কয়েক মাস ধরে চলা ইসরায়েলি বিমান হামলায় হামাসের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, যা সংগঠনটির রাজনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তা নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
হামাসের ওই শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধ শুরুর প্রথম সপ্তাহে ইসরায়েলি হামলায় আহত হন। এর পর থেকে স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে তিনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিবিসিকে বেশ কিছু ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছেন। ভয়েস মেসেজগুলোতে ওই কর্মকর্তা হামাসের অভ্যন্তরে ভাঙনের এবং গাজাজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রায় পুরোপুরি পতনের একটি চিত্র তুলে ধরেন। সংঘাত শুরুর আগে অঞ্চলটি হামাসের শাসনাধীন ছিল।ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘চলুন বাস্তববাদী হই — নিরাপত্তা কাঠামোর প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। নেতৃত্বের প্রায় ৯৫ শতাংশ এখন মৃত... সক্রিয় ব্যক্তিরা সবাই মারা গেছেন। তাহলে ইসরায়েলকে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া থেকে আটকাবে কিসে?’
গত সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ঘোষণা দেন যে, ‘সামরিক কাঠামো হিসেবে হামাস আর অস্তিত্ব নেই। তারা এখন গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত।’
ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তার মতে, চলতি বছরের শুরুতে ইসরায়েলের সঙ্গে ৫৭ দিনের যুদ্ধবিরতির সময় হামাস তাদের রাজনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তা পরিষদ পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মার্চে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে আবার হামাসের অবশিষ্ট নেতৃত্ব কাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এর ফলে সংগঠনটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে
আরও পড়ুনআগামী সপ্তাহেই গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে: ট্রাম্প০৫ জুলাই ২০২৫হামাসের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলি: এটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। একেবারে শেষ। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ তিনি বলেন, ‘মানুষ হামাসের সবচেয়ে শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনীর (আনসার) কার্যালয় লুট করেছে, যা হামাস গাজা শাসনের জন্য ব্যবহার করত।
ওই কর্মকর্তা জানান, নিরাপত্তা শূন্যতার ফলে গাজায় সশস্ত্র গোষ্ঠী বা গোত্র ‘সর্বত্র’ ছড়িয়ে পড়েছে। ‘তারা আপনাকে থামাতে পারে, হত্যা করতে পারে। কেউ বাধা দেবে না। কেউ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে ইসরায়েল আধ ঘণ্টার মধ্যে বোমাবর্ষণ করে।
গত ২৬ জুন ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় গাজার একটি বাজারে অন্তত ১৮ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। হামলার সময় সেখানে দাম বৃদ্ধি ও ত্রাণ লুটের অভিযোগে অভিযান চালাচ্ছিল হামাসের পোশাকবিহীন পুলিশ বাহিনী।
আরও পড়ুনমার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার নিতে এসে প্রাণ গেছে ৭৪৩ ফিলিস্তিনির১৪ ঘণ্টা আগেঅন্যদিকে গাজার দক্ষিণে ছয়টি সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা স্থানীয় ক্ষমতাসীন গোত্রের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে যাসের আবু শাবাব নামে এক নেতা পশ্চিম তীরে হামাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য স্থানীয় প্রভাবশালীদের নজর কাড়েন। ইসরায়েল তাঁকে অস্ত্র সরবরাহ করছে বলে জানা গেছে। হামাস তাঁকে হত্যার জন্য বড় অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
গাজার কয়েকটি সূত্র বিবিসিকে বলেছে, আবু শাবাব ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী একটি যৌথ পরিষদ গঠন করে হামাসকে উৎখাতের পরিকল্পনা করছে।
গাজায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতর চরম অবনতি ঘটেছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেছে। হামাসের জন্য এখন ইসরায়েলি হামলার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বীরা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুনইসরায়েলিদের হামলা-নির্যাতন: অতিষ্ঠ বেদুইন পরিবারগুলো ছাড়ছে পশ্চিম তীর০৫ জুলাই ২০২৫