নদী রক্ষায় সব মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে হবে
Published: 22nd, June 2025 GMT
নদীর দখল-দূষণ বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য আশানুরূপ নয়। তবে বিগত সরকারগুলোর তুলনায় নদী রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার নিঃসন্দেহে এগিয়ে আছে। নদী রক্ষায় সব মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে হবে। একটি মন্ত্রণালয় দিয়ে নদী রক্ষা সম্ভব হবে না।
আজ রোববার রাজধানীর সিরডাপে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) আয়োজিত ‘নদী, হাওর, বন, কৃষিজমি ও পাহাড়: পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, পরিবেশ ও উন্নয়ন নিয়ে একটা বাইনারি (বিভাজনমূলক দ্বিকেন্দ্রিক বিন্যাস) তৈরি করা হয়েছে। অথচ জুলাইয়ের চেতনা হচ্ছে এ বাইনারির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। উন্নয়ন কখনো প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে হতে পারে না। উন্নয়ন সেটিই, যেটি প্রকৃতি-পরিবেশকে সুরক্ষা দেয়।
পাভেল পার্থ বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীতে ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের অংশ, যা প্রমাণ করে এখানকার জীববৈচিত্র্যের অপরিসীম গুরুত্ব। তাই সব বনের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাণিজ্যিক স্থাপনা নিষিদ্ধ করতে হবে।
পাভেল পার্থ আরও বলেন, ‘আমাদের নদীগুলোকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে হবে। শুধু একটা মন্ত্রণালয় দিয়ে নদী রক্ষা হবে না। পাশাপাশি আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় জোরদার করতে হবে।’
এর উদাহরণ হিসেবে বননির্ভর জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনে বন অধিকার আইন করা এবং বন ও পাহাড় রক্ষায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকায়ত জ্ঞানকে রাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণ নীতির অংশ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন পাভেল পার্থ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম বলেন, ‘নদীসহ সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইন মানার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সূচকে আমাদের অবস্থান হলো ১৪২টি দেশের মধ্যে ১২৭। আর পরিবেশ রক্ষার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৯তম অবস্থান।’ আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, যে হারে দখল-দূষণ হচ্ছে, তাতে সামনের সময়ে এসব সূচকে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকবে না। বাংলাদেশে নদীর ক্ষেত্রে সমস্যা হলো দখল, দূষণ, বালু ও পাথর উত্তোলন। দেশের কোনো আইনেই নদীকে নদী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।
কোনো কোনো আইনে নদীকে জলাশয় হিসেবে দেখানো হয়েছে মন্তব্য করে তাসলিমা ইসলাম বলেন, দেশে ১৫টি আইন আছে, যা নদীকেন্দ্রিক। এ ছাড়া আদালতের নির্দেশনা আছে। এসব আইন ও আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন হবে, সে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো সুফিয়া খানম বলেন, পৃথিবীতে যে ১০টি নদী ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণের শিকার, সেগুলোর মধ্যে ৮টি হচ্ছে এশিয়ায়। ভাটির দেশ হিসেবে এ দেশের নদীতে ওই প্লাস্টিক দূষণ এসে জমা হচ্ছে। আঞ্চলিক সংলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরতে পারে।
সুফিয়া খানম সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘ফ্লাই অ্যাশবাহী’ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ২২ কোটি ৪৪ লাখ টন ‘ফ্লাই অ্যাশ’ এসেছে ভারত থেকে। এগুলো পরিবহন করতে গিয়ে সুন্দরবনের ভেতরে নিয়মিত দুর্ঘটনা হচ্ছে। তিনি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এসব জাহাজ চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপের আহ্বান জানান।
সভা পরিচালনা করেন বেসরকারি সংস্থা ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নে প্রকৃতির যে অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে তা নয়, এর সঙ্গে মানুষ ও তার জীবন-জীবিকাও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। তিনি বিদ্যমান আইন, নীতিমালা বাস্তবায়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সভায় সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা যোগ দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার নদ-নদী, বন, হাওর-জলাশয়ের অবস্থা তুলে ধরেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব শ রক ষ য় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বাঘ ও তিমির গল্প
গত ১৮ মে সিঙ্গাপুর যাচ্ছিলাম। ইউসুফ এস আহমেদ লিখিত এবং ইশতিয়াক হাসান অনূদিত উইথ দ্য ওয়াইল্ড অ্যানিমেলস অব বেঙ্গল বইটি অবসরে পড়ার জন্য সঙ্গে নিলাম। ইউসুফ এস আহমেদ একসময় পাকিস্তানের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব ফরেস্ট ছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি বন বিভাগে যোগ দেন এবং ১৯৫৯ সালে অবসরে যান। তাঁর ৩৩ বছরের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ বইটির ৪১ পৃষ্ঠায় লিখিত বক্তব্যটি আমার নজর কাড়ে। ততক্ষণে বিমান সিঙ্গাপুরের মাটি ছুঁয়েছে, যে দেশটি তার শেষ বাঘটি হারিয়েছে ১৯৩০ সালে।
ইউসুফ এস আহমেদ ১৯২৯ সালে সুন্দরবন ডিভিশনের দায়িত্ব পান। বন্য প্রাণীর প্রতি আগ্রহের কারণে শিগগিরই ‘ওয়াইল্ড ম্যান অব ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট’ নামে পরিচিতি পেলেন। তিনি লিখেছেন, ‘ভোলা নদীর ওপারে ধানসাগর গ্রাম সুন্দরবনের এই অংশে পুবের সীমানা হিসেবে কাজ করছে। ১৯২৯/১৯৩০ সালের শীতকাল। বাঘের চামড়া এবং মাথাসহ পুরস্কার দাবি করে একটি চিঠি এল স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্প থেকে।’
বাঘটি ধানসাগর গ্রামে ঢুকে পড়লে স্থানীয় শিকারিদের সহায়তায় পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টরের গুলিতে মারা পড়ে। ধানসাগর শরণখোলা উপজেলার অধীন বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের অন্তর্গত। এটি প্রায় ১০০ বছর আগের ঘটনা।
শত বছর পর ইদানীং বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব একটি পর্যায়ে এসেছে। বাংলাদেশ বন বিভাগের সহযোগিতায় ওয়াইল্ডটিম নামক সংগঠনটি সুন্দরবনের চারপাশে ‘ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম’ গঠন করেছে। সুন্দরবনের প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামে এখন ৩৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক ৪৯টি দলে ভাগ হয়ে প্রায় ১৮ বছর ধরে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। কোনো বাঘ গ্রামে ঢুকলেই এই দলের সদস্যরা বন বিভাগের সহযোগিতায় বাঘটিকে বনে ফিরিয়ে দেন।
দেশের কোথাও বন্য প্রাণী, বিশেষ করে বাঘ মারলে একসময় এলাকায় তিনি ‘হিরো’ হয়ে যেতেন। এটি ছিল সামাজিক স্বীকৃতি। কিন্তু ব্রিটিশরা ভাবলেন, সুন্দরবনের যেসব এলাকা থেকে রাজস্ব বেশি আয় হয়, সেখানকার বনকর্মীদের পুরস্কৃত করলে ওই সব এলাকা বাঘশূন্য করা যাবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রঞ্জন চক্রবর্তী লিখেছেন, ১৬ নভেম্বর ১৮৮৩ সালে সরকার ‘ক্যালকাটা গেজেট’–এর মাধ্যমে ঘোষণা করলেন: একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ মারলে ৫০ রুপি এবং বাচ্চা মারলে ১০ রুপি পাওয়া যাবে। অবশ্য চামড়া ও মাথার খুলি জমা দিতে হবে। ১৯০৬ সালে এটি বাড়িয়ে ১০০ রুপি এবং ১৯০৯ সালে ২০০ রুপি করা হলো। ১৮৮১ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ৪০০টি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ মারা পড়েছে। যদিও এটি সরকারি হিসাব, বেসরকারি হিসাব কখনো জানা যায়নি। বাংলাদেশে একসময় প্রায় সর্বত্রই বাঘ ছিল, কিন্তু সুন্দরবনই আজ আমাদের ১২৫টি বাঘের শেষ আশ্রয়স্থল।
সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লি কং চিয়ান প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরে প্রদর্শিত তিমির কঙ্কাল