গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে ‘জনগণ’ কীভাবে কথা বলবে
Published: 27th, June 2025 GMT
জুলাই গণ–অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তর কীভাবে ঘটবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে যেমন নতুন ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তেমনি প্রায় প্রতিটি ইস্যুতে শুরু হয়েছে তীব্র বাহাস বা বিতর্ক; যদিও নিকট অতীতের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলে, ক্রান্তিকালীন রূপান্তরের ক্ষেত্রে বিতর্ক, সংলাপ ও নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশেও অভূতপূর্ব সক্রিয়তা দৃশ্যমান।
আরও পড়ুনগণক্ষমতাবিরোধী ধ্যানধারণা বনাম গণরাজনৈতিক ধারা১৯ জুন ২০২৫২.দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের যে আলোচনা ছোট এবং অনেকটা বিশেষায়িত পরিসরে চলেছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থান তাকে সাধারণের আলোচনার বিষয়ে পরিণত করেছে। প্রশ্ন হলো, সংস্কার কিসের হবে? কীভাবে হবে? বা এর প্রক্রিয়া কী হবে?
এসব প্রশ্ন নিয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে সংবিধানের সংস্কার নিয়ে—কেউ নতুন গঠনতন্ত্রের পক্ষে, কেউ মৌলিক কিছু সংস্কারের পক্ষে। তবে এসবের কোনোটিই যেহেতু বিভিন্ন রাজনৈতিক সত্তার ঐকমত্য ছাড়া সম্ভব নয়, তাই সমঝোতার মাধ্যমেই এর পথ তৈরি হতে হবে।
তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্ন এলেই একটি পুরোনো অভিযোগ বারবার সামনে আসছে—বাংলাদেশের গণতন্ত্রবিষয়ক সব ভাবনা কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক। এই ‘নির্বাচনমুখী’ গণতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করছেন অনেকেই। যেমন কবি, লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার দীর্ঘদিন ধরে এমন ভাবনার কড়া সমালোচক। অভ্যুত্থানের পরও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই, ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় না।
সম্প্রতি বিআইজিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক মির্জা এম হাসানও একই ধরনের সমালোচনার সুরেই বলেছেন, মূলধারার রাজনীতিবিদেরা রাজনৈতিক স্বার্থে গণতন্ত্রকে নির্বাচনী গণতন্ত্রের ‘সীমাবদ্ধ ধারণার’ মধ্যে আটকে রেখেছেন।
৩.ফরহাদ মজহার ও মির্জা এম হাসানের সমালোচনার মূল সুর—কেবল নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র কায়েম হবে না, নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু এই সমালোচনা বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতাকে আমলে নিতে প্রায়ই অপারগ।
■ ফরহাদ মজহার যখন ‘জনগণ’ এবং তাদের ‘সরাসরি অংশগ্রহণের’ কথা বলেন, সেই ‘জনগণ’কে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে, তা স্পষ্ট হয় না। ■ ‘জনগণ’-এর বিমূর্ত ধারণার বাইরে এসে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা ও প্রতিষ্ঠানের অনিবার্যতাকে স্বীকার করে নিলে একটি মূর্ত ও কার্যকর পথ খুঁজে নেওয়া সম্ভব হবে। ■ রাষ্ট্রের বিদ্যমান নানা গোষ্ঠী ও অ্যাক্টরের মধ্যে ক্রমাগত সংলাপ-বাহাস-বিতর্কের মধ্য দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি; কেননা ঐকমত্য ব্যতিরেকে যেকোনো সংস্কার বা ছেদ টেকসই হবে না।বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সংকট আদতে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিকে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। পাঁচ দশক ধরে এই জনগোষ্ঠী বেশির ভাগ সময়ই সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। অর্থাৎ যিনি বা যাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁদের ক্ষমতা থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সরানোর কোনো বন্দোবস্ত এখনো তৈরি হয়নি।
ফলস্বরূপ, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বরাবরই রক্ত ঝরাচ্ছে—অভ্যুত্থান, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন বা ক্যু ছাড়া ক্ষমতাসীন কাউকেই ক্ষমতা থেকে সরানো যায়নি। এমনকি নির্বাচনের দাবি আদায়েও লাশ পড়েছে বেশুমার। আমাদের অনেকের, যাঁদের জন্ম নব্বইয়ের দশকে, বয়স ৩০ পেরিয়ে গেলেও এখনো অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ মেলেনি।
এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রবিষয়ক যেকোনো আলোচনায় ‘নির্বাচন’ মুখ্য উপাদান হয়ে উঠবে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু উপরিউক্ত সমালোচনাগুলোয় এই কঠোর বাস্তবতার প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়।
অন্যদিকে দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের কারণে নির্বাচনী গণতন্ত্রের সমালোচনা আমাদের কাছে আচানকও নয়। বিগত শাসনামলেও আমরা দেখেছি, কীভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ‘তুলাধোনা’ করা হয়েছে বা গণতন্ত্রের বিপরীতে ‘উন্নয়ন’কে হাজির করা হয়েছে।
৪.ভুল বুঝবেন না, দাবি করছি না যে ‘কেবল নির্বাচনই গণতন্ত্র’ বা নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে স্বৈরাচার কায়েম হয়নি—এমন কথাও বলা হচ্ছে না। বরং বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রের জন্য সর্বাধিক জরুরি হলো নির্বাচনব্যবস্থা।
পাঁচ বছরের জন্য শাসক পরিবর্তনের এই ‘এক দিনের ভোটাধিকার’ই গণতন্ত্রের একেবারে প্রাথমিক ধাপ। আমরা এই প্রাথমিক ধাপই এখনো অর্জন করতে পারিনি বা এটা করার জন্য সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক কোনো বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে পারিনি। যে রাষ্ট্রে পাঁচ দশকে বেশির ভাগ সময় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়নি, সেখানে যাবতীয় আলাপ যে নির্বাচনকে ঘিরে আবর্তিত হবে, সেটা যেমন সত্য, তেমনি রাজনৈতিক বাস্তবতা–বিবর্জিত নির্বাচনী গণতন্ত্রের সমালোচনা কার্যত গণতন্ত্রবিরোধী পক্ষগুলোকেই শক্তি জোগাবে।
ফলে কীভাবে এই ‘এক দিনের’ ভোটাধিকার প্রয়োগ নির্বিঘ্নে সম্ভব, ভোটাধিকার রক্ষার টেকসই বন্দোবস্ত কীভাবে তৈরি করব এবং কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রকে আটকাবে, এটা এ মুহূর্তে জরুরি আলাপ বলেই বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো না গেলেও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন—সর্বত্রই আলোচনা চলছে, এই সংস্কার কীভাবে সম্ভব?
৫.সম্প্রতি সংস্কারবিষয়ক এ ধরনের আলাপ-আলোচনাকে ‘গণবিরোধী’ ও ‘প্রতিবিপ্লবী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ফরহাদ মজহার। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে একটি ‘বৈপ্লবিক ছেদ’ ঘটানোর তত্ত্বায়ন করে আসছেন এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে সেই ‘গঠনতান্ত্রিক মুহূর্ত’ হিসেবেই দাবি করেন।
বিখ্যাত তাত্ত্বিক আন্তোনিও নেগ্রিকে উল্লেখ করে সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, জনগণের গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতা বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের কাঠামোকে অস্বীকার করে নতুন ক্ষমতাকাঠামো ও ব্যবস্থা নির্মাণ করে। তিনি ‘প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র’ ও ‘প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার’কে ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে, এগুলোর উদ্দেশ্য হলো লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণিকে টিকিয়ে রেখে গণতন্ত্রে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করা।
লিবারেল ডেমোক্রেসি বা উদার গণতন্ত্র নিয়ে ফরহাদ মজহারের এ প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত ‘সুচিন্তিত’ ও ‘তীক্ষ্ণ’। কিন্তু রাজনৈতিক তাত্ত্বিক শান্তাল মোউফের বরাত দিয়েই এখানে একটি জরুরি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই।
আন্তোনিও নেগ্রি ও মিশেল হার্ডট তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সমালোচনা করে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যে ‘এক্সোডাস’ বা এসবের সম্পূর্ণ পরিত্যাগের কথা বলেন, তার সমালোচনা করেছিলেন শান্তাল মোউফ। তিনি নিজে একজন বামপন্থী চিন্তক ও উদার গণতন্ত্রের সমালোচক হলেও নেগ্রি ও হার্ডটদের এমন র্যাডিক্যাল অবস্থানকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
মোউফের কাছে রাজনীতি হচ্ছে ‘হেজিমোনির লড়াই’—একটি সাধারণ প্রতীকী পরিসরে সামষ্টিক ইচ্ছার গঠন ও পুনর্গঠন করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর (যদিও ত্রুটিপূর্ণ) মধ্যকার বিভিন্ন স্বার্থের দেনদরবার, জোট গঠন ও প্রভাবের জন্য প্রতিযোগিতা।
‘রাজনৈতিকতা’(অর্থাৎ রাজনীতিতে যে বন্ধু-শত্রুর বিভাজন অনিবার্যভাবে ক্রিয়াশীল থাকবে) মুছে ফেলা সম্ভব নয়। এই বিভাজন মুছে ফেলে কোনো একক ‘জনগণ’ ধারণা তৈরি করার ধারণা আদতে বাস্তবসম্মত নয়। বরং রাজনীতিতে বিদ্যমান এই অনিবার্য ‘শত্রুতা’ যেন একে অপরের প্রতি ‘ধ্বংসাত্মক’ (এন্টাগনিস্টিক) না হয়ে ‘বিরোধাত্মক’ (আগোনিস্টিক) ধারায় প্রবাহিত থাকে, সে জন্য প্রতিষ্ঠান ও হেজিমোনিক কাঠামোগুলোর প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কারণে তিনি প্রতিষ্ঠান ছাড়া ‘নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের’ ধারণাকে বিপজ্জনক ও অবাস্তব বলে মনে করেন।
মোউফের মতে, নেগ্রির এমন র্যাডিক্যাল অবস্থান ‘রাজনৈতিক’ ও প্রাতিষ্ঠানিকতার অনিবার্যতাকে খারিজ করে বলে রাজনীতির বাস্তবতাকে বুঝতে সহায়তা করে না। তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যাখ্যান না করে বরং সেগুলোকে ‘র্যাডিক্যাল’ করে তুলতে এবং আরও বেশি গণতান্ত্রিক করে তোলার ওকালতি করেন (শান্তাল মোউফ, এগোনিস্টিকস: থিঙ্কিং দ্য ওয়ার্ল্ড পলিটিক্যালি)।
এ জন্য মোউফ যে হেজিমোনিক লড়াইয়ের কথা বলেন, সেটি একটি অংশীদারত্বমূলক পরিসরের ভেতরে এবং বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়েই চালিয়ে যেতে হবে। তাঁর মতে, লক্ষ্যটা খেলার মূল কাঠামোকে ধ্বংস করা নয়; বরং এর নিয়ম পরিবর্তন করা, যাতে ফলাফল আরও গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে।
মোউফ সতর্ক করেন যে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান একটি কৌশলগত ভুল। এর ফলে এমন একটি ‘রাজনীতি-উত্তর’ বা ‘পোস্টপলিটিক্যাল’ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যেখানে প্রকৃত বিরোধিতা দমন করার আশঙ্কা তৈরি হয় এবং ডানপন্থী পপুলিজম বা জনতুষ্টিবাদের পথও প্রশস্ত হয়।
৬.মোউফকে উল্লেখ করার কারণ এটাই: ফরহাদ মজহার যখন ‘জনগণ’ এবং তাদের ‘সরাসরি অংশগ্রহণের’ কথা বলেন, সেই ‘জনগণ’কে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে, তা স্পষ্ট হয় না। সবাই এক সাধারণ ‘না’–তে একমত হয়ে যে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, সেখান থেকে একটি সুনির্দিষ্ট ‘হ্যাঁ’-তে পৌঁছানোর যাত্রা কীভাবে সম্ভব হবে, সেই স্পষ্ট দিশা এই ‘জনগণ’ ধারণার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। একে প্রায়ই একটি বিমূর্ত ধারণা হিসেবেই হাজির করা হচ্ছে।
মোউফ যে অনিবার্য ‘রাজনৈতিক’ (পলিটিক্যাল) বাস্তবতার কথা বলেন, তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রবাহিত করা না গেলে তো গণতান্ত্রিক রূপান্তরই কঠিন হয়ে উঠবে। ফলে মজহার যখন বলেন, জনগণ নিজেরাই নিজেদের গঠনতন্ত্র রচনা করবে, অর্থাৎ ‘নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের’ কথা বলেন, এতে দুটি প্রধান সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে।
প্রথমত, ‘জনগণ’কে আমরা বিশুদ্ধরূপে চিনব কীভাবে?
দ্বিতীয়ত, এই ‘রচনার প্রক্রিয়া’ কেমন হবে?
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।
৭.জুলাই গণ–অভ্যুত্থান যে বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে, সেটি কাজে লাগানোর জন্য আমাদের ‘জনগণ’-এর বিমূর্ত ধারণার বাইরে এসে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা ও প্রতিষ্ঠানের অনিবার্যতাকে স্বীকার করে নিলে একটি মূর্ত ও কার্যকর পথ খুঁজে নেওয়া সম্ভব হবে।
গত এক দশক, বিশেষত আরব বসন্তের পর আমাদের সামনে সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ার বেশ কিছু নজির রয়েছে। রাষ্ট্রের বিদ্যমান নানা গোষ্ঠী ও অ্যাক্টরের মধ্যে ক্রমাগত সংলাপ-বাহাস-বিতর্কের মধ্য দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি। কেননা ঐকমত্য ব্যতিরেকে যেকোনো সংস্কার বা ছেদ টেকসই হবে না; অন্তত বৈশ্বিক নজির আমাদের এমন সিদ্ধান্তের দিকে পৌঁছাতে সাহায্য করে।
আমাদের এই সতর্কতাও মনে রাখা দরকার, গভীরভাবে বিভাজিত ও ‘সহিংস’ সমাজে এ ধরনের প্রক্রিয়া কখনো কখনো বিভাজনকে নিরাময় না করে উল্টো আরও গভীর করে তুলতে পারে (নাথান জে ব্রাউন, কনস্টিটিউটিং কনস্টিটিউশনালিজম: লেসনস ফ্রম দ্য আরব ওয়ার্ল্ড)।
আমরা বর্তমানে এক বিশাল রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। নিঃসন্দেহে আমাদের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সাম্প্রতিক অভিযাত্রায় স্থানিক চরিত্র যুক্ত থাকবে; আবার দুনিয়ার সাম্প্রতিক নজিরগুলো থেকে আমাদের শিক্ষাও নেওয়া দরকার।
● সহুল আহমদ লেখক ও গবেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণতন ত র র স ফরহ দ মজহ র র প রক র য র প ন তর র ন র জন ত ক অন ব র য ঐকমত য র জন য ব তর ক র র জন আম দ র ক ষমত র গণত ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
আলোচনায় গণভোটসহ কয়েকটি বিকল্প পদ্ধতি
জুলাই জাতীয় সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
গতকাল রোববার প্রথম দিনের বৈঠকে ছয়জন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়ে একাধিক বিকল্প পরামর্শ এসেছে। এর মধ্যে আছে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন, জুলাই সনদকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ (রেফারেন্স), বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না, তা দেখা।
গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে আইন ও সংবিধানবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এ সময় অধ্যাদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। তবে এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও উঠে আসে। সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য কমিশন আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে জানা গেছে।
আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরনের বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন। কমিশন আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলবে। তাঁদের মতামত সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে।অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সহসভাপতি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনরাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই পর্বের আলোচনায় ৮২টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। তবে এই সনদ তথা সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এর আগে গত শুক্রবার ঐকমত্য কমিশন বলেছিল, বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ভর করবে বিশেষজ্ঞ মতামত ও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে কমিশন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শেষ হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে ঐকমত্য কমিশন।
সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে। জুলাই জাতীয় সনদের খসড়ায় বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দুই বছরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি একমত। তবে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) আরও কিছু দলের এ ক্ষেত্রে আপত্তি আছে। তারা মনে করে, শুধু অঙ্গীকার থাকলে হবে না; জুলাই সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকালের আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরনের বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেন। একটি বিষয় আলোচনায় আসে, যদি বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যে থেকে বা সংবিধান মেনে সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিকল্প ভাবার সুযোগ কম।গতকাল ঐকমত্য কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জুলাই জাতীয় সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তার উপায় খুঁজে বের করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞজনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল আলোচনায় অংশ নেন বিচারপতি (অব.) এম এ মতিন ও বিচারপতি (অব.) মইনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া, আইনজীবী তানিম হোসেইন ও আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকালের আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরনের বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেন। একটি বিষয় আলোচনায় আসে, যদি বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যে থেকে বা সংবিধান মেনে সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিকল্প ভাবার সুযোগ কম। কিন্তু বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোতে অন্তর্বর্তী সরকার নেই। এই সরকার গঠিত হয়েছে মূলত জনগণের একধরনের ক্ষমতার প্রয়োগের মাধ্যমে এবং উচ্চ আদালত থেকে রেফারেন্স নিয়ে। সুতরাং এই সরকারের সংস্কারের ম্যান্ডেট (এখতিয়ার) আছে। আলোচনায় কেউ কেউ মত দেন, জুলাই সনদকে সংবিধানের অংশ হিসেবে গণ্য করার বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নেওয়া যেতে পারে। এখন একটি বিশেষ পরিস্থিতি চলছে, এই বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এ ছাড়া প্রয়োজনে গণভোট করা যেতে পারে, এমন মতও এসেছে। জনগণ যদি ব্যাপক ভিত্তিতে জুলাই সনদের পক্ষে রায় দেন এবং সুপ্রিম কোর্ট যদি মতামত দেন, তাহলে জনগণের অভিপ্রায় হিসেবে জুলাই সনদ সংবিধানের অংশ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
এ ছাড়া প্রোক্লেমেশন, লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা যায়, এমন মতও দিয়েছেন কেউ কেউ। অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার বিষয়েও মত এসেছে। তবে এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো নিয়ে জটিলতা হবে বলেও উল্লেখ করেন কেউ কেউ। কারণ, অধ্যাদেশ জারি করে সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংস্কার প্রস্তাবগুলো কখন, কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেটাও আলোচনায় আসে। কিছু বিষয় আছে সরকার চাইলে এখনই অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো পরবর্তী সরকার যদি নির্ধারিত সময় এগুলো সংসদে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন না করে, তাহলে এসবের কার্যকারিতা আর থাকবে না। তাই পুরো সনদকে একটি আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হচ্ছে। গতকালের আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরনের বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন। কমিশন আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলবে। তাঁদের মতামত সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ছাড়াও গতকালের সভায় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
এখন এসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা চলছে। এটি ঠিক হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সই করার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পাবে জুলাই সনদ।প্রসঙ্গত, গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো প্রতিবেদন দেয়। পরে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।
পরে ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি অংশে ছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন বাদে বাকি পাঁচটি কমিশনের ১৬৫টি ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ সুপারিশ। এগুলো বাস্তবায়নে কাজ চলছে। আরেকটি অংশে ছিল ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ। এগুলো নিয়ে প্রথম পর্বে ৩৩টি দলের সঙ্গে (২০ মার্চ-১৯ মে) আলাদাভাবে আলোচনা হয়। প্রথম পর্বে ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়। প্রথম পর্বে ঐকমত্য না হওয়া ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ৩০টি দলের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বে (৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই) আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। দ্বিতীয় পর্বে ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ১১টিতে সব দলের ঐকমত্য ও ৯টিতে ভিন্নমতসহ (নোট অব ডিসেন্ট) সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন এসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা চলছে। এটি ঠিক হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সই করার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পাবে জুলাই সনদ।