বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ইতিহাস গড়েছে। প্রথমবারের মতো এএফসি নারী এশিয়ান কাপের মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে লাল-সবুজের মেয়েরা। এই অর্জন শুধু একটি ক্রীড়াসাফল্য নয়, এটি একটি জাতীয় গর্ব। একটি সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। কিন্তু এই গৌরব উদ্‌যাপনের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে যখন সংবর্ধনার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আজ রাত আড়াইটায়, রাজধানীর হাতিরঝিল এম্ফিথিয়েটারে।

বাফুফে জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ নারী দল আজ সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবে। রাত ৯টায় দলটি পৌঁছাবে ব্যাংকক। সেখান থেকে ১১টা ৫০ মিনিটে উড়াল দিয়ে ঢাকা পৌঁছাবে রাত ১টা ২৫ মিনিটে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মেয়েরা ঢাকায় নামার সোয়া ঘণ্টা পর রাত আড়াইটায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে!

এত রাতে সংবর্ধনা কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাফুফে আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কিছু জানায়নি। তবে বাফুফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই খেলোয়াড় ঋতুপর্ণা ও মনিকা চাকমা সোমবার সকাল সাতটায় ভুটানের লিগ খেলতে রওনা হবেন ঢাকা থেকে। এ কারণেই রাত আড়াইটায় এমন অভিনব ও অবাস্তব সংবর্ধনার ভাবনা।

কিন্তু প্রশ্ন আসে—ঋতুপর্ণা-মনিকারা ভুটান থেকে ফিরে এলে সংবর্ধনা দিলে কী ক্ষতি হতো? ক্লান্ত মেয়েদের বিশ্রাম না দিয়ে এমন গভীর রাতে অনুষ্ঠান আয়োজন কতটা মানবিক? তা ছাড়া রয়েছে এত রাতে নিরাপত্তাজনিত প্রশ্নও। সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকায় নামার কয়েক ঘণ্টা পরই ভোরে আবার ফ্লাইট ধরতে হবে দুজনকে। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে সংবর্ধনার নামে তাঁদের নিয়ে টানাহেঁচড়া কি খুব দরকার ছিল? এসব প্রশ্ন জোরালোভাবেই আসছে।

২০২৩ সালে মার্চে অর্থসংকটের অজুহাত দিয়ে মেয়েদের অলিম্পিক বাছাইয়ে পাঠানো হয়নি, যেটি ছিল মিয়ানমারেই। এ বছর ৩০ জানুয়ারি কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময় তাঁরা বেতনের আওতায়ও ছিলেন না। বেতনও পেয়ে এসেছেন অনিয়মিতভাবে। এখনো শীর্ষ খেলোয়াড়দের বেতন মাত্র মাসে ৫৫ হাজার টাকা। গত সাফ জেতার পর মেয়েদের দেড় কোটি টাকা বোনাস দেওয়া হবে বলছিল বাফুফে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা দেওয়া হয়নি। বাফুফের উচিত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ও মেয়েদের সমস্যা সমাধানের দিকে নজর দেওয়া।

গত বছর সাফ শিরোপা ধরে রাখার পর বিমানবন্দর থেকে মেয়েদের ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনার সময় নানা বিশৃঙ্খলার কারণে মেয়েরা দুপুরের খাবার খেতে পারেননি। এর আগে প্রথম সাফ জেতার পর ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনা আয়োজন ছিল চরম বিশৃঙ্খল। রাস্তায় থাকা বিলবোর্ডের কোনায় খোঁচা লেগে মাথায় আঘাত পান আজকের তারকা ঋতুপর্ণা। বাস থেকে তাঁকে নামিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর মাথায় তিনটি সেলাই লেগেছে। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে এবার অযৌক্তিক সময়ের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে।

ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালেই মেয়েদের সংবর্ধনা সেরে ফেলা যেত। ফুলের মালা, একটা চেক, ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান। এসবই সম্ভব ছিল। এতে ক্লান্ত মেয়েরা বিশ্রাম পেতেন। ঋতুপর্ণা-মনিকারাও বিশ্রাম নিয়ে ভুটানের ফ্লাইট ধরতে পারতেন।

রাত আড়াইটার সংবর্ধনা এক অভিনব আয়োজন হলেও বাস্তবতা বিবেচনায়ও এটি প্রশ্নবিদ্ধ। এত রাতে সংবর্ধনায় কারা উপস্থিত থাকবেন বা কাদের উপস্থিত থাকার সুযোগ আছে, সেটারও কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি বাফুফে। মেয়েদের এত বড় সাফল্যের পর সাধারণ কোনো ফুটবলপ্রেমী সংবর্ধনায় উপস্থিত থাকতে চাইলে তিনি কী সেই সুযোগ পাবেন? এসব প্রশ্ন ছাপিয়ে একটা কথাই ঘুরেফিরে আসছে,  নারী ফুটবলারদের প্রয়োজন সম্মান, সুরক্ষা এবং স্থায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা। লোক দেখানো কিছু করা বা গ্ল্যামার নয়, বাফুফের গঠনমূলক পদক্ষেপই নারী ফুটবলের ভিত্তি শক্ত করতে পারে। আর সেদিকে নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

দেশে নারী ফুটবল লিগ সর্বশেষ হয়েছে গত বছর মে মাসে। আর এ দেশে লিগের নামে যেটা হয়, সেটা নামমাত্র। এর কোনো শক্ত কাঠামো নেই। বড় বড় ক্লাবগুলোর অনাগ্রহ নারী ফুটবল নিয়ে। আজ পর্যন্ত মেয়েদের জন্য লিগের বাইরে নেই কোনো টুর্নামেন্ট। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজনে গল্প শোনালেও বাফুফে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সুযোগ এলেও নানা অজুহাতে এএফসি নারী চ্যাম্পিয়নস লিগে কোনো দল পাঠায়নি দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। অথচ এশিয়ার স্তরের ওই লিগে খেলছে ভুটানের মতো দেশের ক্লাবও। বাফুফের উচিত আগে মেয়েদের জন্য এগুলো নিশ্চিত করা।

মেয়েদের জন্য কোচিং স্টাফে আরও বিদেশি কোচ দরকার। কোচ পিটার বাটলারের সহকারীও হতে পারেন বিদেশি, গোলরক্ষক কোচও হতে পারেন বিদেশি। সামনে আরও ভালো কিছু করতে শক্তিশালী কোচিং স্টাফের বিকল্প নেই। দরকার মেয়েদের জন্য পুষ্টিবিদ। মেয়েদের খাবারের ব্যাপারে আরও যত্নশীল হওয়ার সুযোগ রয়েছে। খাবারের মেন্যু আরও উন্নত বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া চাই।  কিন্তু এসব নিয়ে বাফুফের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো রাত আড়াইটায় সংবর্ধনার অবাস্তব চিন্তা এসেছে তাদের মাথায়।

অনেক বাধা পেরিয়ে মেয়েরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। মিয়ানমারে সাফল্য এসেছে এক দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের মাধ্যমে। ২০২৬ এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে বাংলাদেশ দল গ্রুপ পর্বে বাহরাইনকে ৭-০, মিয়ানমারকে ২-১ এবং তুর্কমেনিস্তানকে ৭-০ গোলে হারিয়ে  ‘সি’ গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বিশেষ করে ঋতুপর্ণা চাকমার জোড়া গোল মিয়ানমারের বিপক্ষে এনে দেয় ইতিহাস গড়া জয়, যারা ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ৭৩ ধাপ ওপরে ছিল।

এই সাফল্য এসেছে এমন একসময়, যখন বাংলাদেশ নারী দলটি অভ্যন্তরীণ সংকট, কোচের বিরুদ্ধে অভিযোগসহ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সেসব একপাশে রেখে কোচ পিটার বাটলারের নেতৃত্বে একটি নতুন, তরুণ দল গড়ে উঠেছে, যারা মাঠে নিজেদের প্রমাণ করেছে। বাফুফের আশু করণীয় এখন মেয়েদের এগিয়ে নিতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করা—রাত আড়াইটায় সংবর্ধনার নামে মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দেওয়া নয়। সংবর্ধনার আগে এ বিষয়গুলো ভেবেছেন কি বাফুফের কর্মকর্তারা?

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম য় দ র জন য স ফল য ফ টবল

এছাড়াও পড়ুন:

আবার ‘লাস্ট মিনিট শো’, জন্মদিনের রাতে স্লটকে জয় উপহার ফন ডাইকের

লিভারপুল ৩–২ আতলেতিকো মাদ্রিদ

জন্মদিনের রাতে এর চেয়ে ভালো উপহার আর কী হতে পারে!

রেফারি শেষ বাঁশি বাজাতেই মাঠে ঢুকে পড়লেন আর্নে স্লট। লিভারপুলের সমর্থকেরা তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে থাকলেন, দল জেতায় অভিনন্দনও জানালেন। মুখে চওড়া হাসি নিয়ে হাত নেড়ে স্লট সেই অভিবাদনের জবাব দিলেন।   

ভার্জিল ফন ডাইকের সঙ্গে আলিঙ্গনের সময় স্লটকে একটু বেশিই খুশি মনে হলো। কারণ, লিভারপুল অধিনায়ক ফন ডাইক ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত না হলে তাঁর বিশেষ রাতটা যে অনেকটাই পানসে হয়ে যেত!

২০২৫–২৬ মৌসুমে শেষ মুহূর্তে জয়সূচক গোল করাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে লিভারপুল। যেটিকে বলা হচ্ছে লাস্ট মিনিট শো, কয়েকটি সংবাদমাধ্যম নাম দিয়েছে স্লট টাইম।

এবার সেই শো–এর নায়ক ফন ডাইক। যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে তাঁর হেডারেই আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ড্রয়ের পথে থাকা ম্যাচটা ৩–২ গোলে জিতে চ্যাম্পিয়নস লিগে শুভসূচনা করল লিভারপুল।

এ নিয়ে এই মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা পাঁচ ম্যাচ জিতল লিভারপুল। সবকটি ম্যাচে অলরেডরা জয়সূচক গোল করল ৮০ মিনিটের পর; এর তিনটিই যোগ করা সময়ে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ