শিবনারায়ণ রায়ের রবীন্দ্রমূল্যায়ন
Published: 6th, August 2025 GMT
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে দু-একটি প্রবন্ধ লিখেই পাঠকদের যারপরনাই বিচলিত করেছিলেন শিবনারায়ণ রায় এবং তা হয়েছিল তাঁর চিন্তার স্বাতন্ত্র্য আর রবীন্দ্রনাথকে বিষয় করে লেখার কারণেই। যিনি নানা লক্ষ্যে ও উপলক্ষে বাঙালিদের চেতনায় আসন গেড়ে বসে আছেন, তিনি তাঁর সাহিত্যজীবনে কী করেছেন, কী করতে পারেননি বা কী করতে পারতেন, তার আলোচনা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না পাঠকেরা। প্রতিক্রিয়া কী রকম হয়েছিল, তার কিছু আলোচনা পরবর্তী সময়ে অনেকের লেখায় এসেছে, কিন্তু সেই সময়ে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী গৌরী আইয়ুবের লেখায় রয়েছে তার বিশ্বস্ত বর্ণনা:
‘ঐ দুটি ঢিল শান্তিনিকেতনের নিস্তরঙ্গ ডোবায় পড়ে বেশ বড় বড় ঢেউ তুলেছিল। ছাত্র ও শিক্ষক মহলে খুব উত্তেজনা হয়েছিল। তাঁর প্রবন্ধের বাক্য মুখে মুখে ফিরছিল। বলাই বাহুল্য যে যতই মুখ থেকে মুখান্তরে যাচ্ছিল, ততই মূল থেকে তার আকৃতি পাল্টে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছিল।’
এই মন্তব্যের শেষবাক্যে একটুখানি অন্য রকমের স্বর যে পাওয়া যাচ্ছে, ধারণা করি, তা আসলে পরবর্তীকালে তাঁর শিবনারায়ণ রায়ের প্রবন্ধ-পাঠেরই ফল। কারণ, পরে যখন তিনি ‘রবীন্দ্রনাথ ও গোয়েটে’ পড়লেন, তাঁর কাছে—মুখে মুখে যতটা শুনেছিলেন—ততটা ‘মারাত্মক’ মনে হয়নি। কিন্তু তখনো তিনি ছিলেন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, কিছুটা বিস্মিতও। কারণ, এর আগে শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে যখন তাঁর দেখা হয় তখন তাঁকে দেখে ভালো তো লেগেছিলই, কাঁধে ‘শানব্যাগ’ থাকায় ‘প্রায় শান্তিনিকেতনী রোমান্টিক ধরনের’ মানুষও মনে হয়েছিল। তার কিছুদিন বাদে, আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে সংসার শুরু করার কয়েক দিন পর একদিন এই মানুষটিই কোনো প্রথাদ্রোহী লেখকের বই না দিয়ে তাঁকে সলজ্জ ভঙ্গিতে একগুচ্ছ লাল ও হলুদ গ্ল্যাডিওলাস উপহার দিয়েছিলেন। এভাবে, পারিবারিকভাবে একাত্ম হয়ে যাওয়ার পরে গৌরকিশোর ঘোষও তাঁকে দেখেছিলেন পরিবারাশ্রয়ী, পত্নীপ্রেমী ও বন্ধুবৎসলরূপে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখার আগেই তাঁর সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি দেখেছিলেন, শিবনারায়ণ রায় কথা বলেন ‘চিবিয়ে চিবিয়ে’, হাঁটেন ‘ল্যাগব্যাগিয়ে’ কিন্তু ‘এই ঋজু মানুষটার মাথার উপরিভাগে কোঁকড়া কোঁকড়া চিরুনিভাঙা একরাশ চুল আর অন্তর্দেশে ক্ষুরধার প্রজ্ঞা, যা তার দুটি চোখে অবিরত উদ্ভাসিত।’ এই মানুষটিকে দেখে গৌরকিশোর ঘোষের যখন যাজ্ঞবল্ক্যের কথা মনে পড়ছে, তখনই তাঁর র্যাডিক্যাল বন্ধুদের বেশির ভাগই তাঁকে চিহ্নিত করছিল ‘দাম্ভিক’ হিসেবে। এই [অ]খ্যাতি অতিদ্রুত অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছিল।
১৯৫৬ সালে দেশ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথ ও গোয়েটে’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর, তখনই রবীন্দ্রবিরোধী হিসেবে তাঁর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু তিনি কি মূলত রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন? একবাক্যে বলতে গেলে বলতে হয়, শিবনারায়ণ রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন না, তবে রবীন্দ্রনাথকে নিজের বোধবুদ্ধিমতো মূল্যায়ন করতে চেয়েছেন।মনে রাখা জরুরি, তখন ১৯৪৬ সাল, এর এক বছর আগে, ১৯৪৫ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে বেরিয়েছে শিবনারায়ণ রায়ের প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘প্রেক্ষিত’, যা বাংলা সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যেটি পড়লে কিছুটা অন্তত বোঝা যাবে, কেন তিনি তখনই তার্কিক এবং কেন তাঁকে দাম্ভিক বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু বইটি প্রত্যাশিত পাঠক পাওয়া দূরের কথা, সম্ভাব্য পাঠক পেয়েছে বলেও মনে হয় না। তারপর মাঝখানে আরও নানা রকম লেখা ছাপা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতি সবার দৃষ্টি পড়ল ১৯৫৬ সালে দেশ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথ ও গোয়েটে’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর, তখনই রবীন্দ্রবিরোধী হিসেবে তাঁর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু তিনি কি মূলত রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন? একবাক্যে বলতে গেলে বলতে হয়, শিবনারায়ণ রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন না, তবে রবীন্দ্রনাথকে নিজের বোধবুদ্ধিমতো মূল্যায়ন করতে চেয়েছেন। আমরা দেখব শিবনারায়ণ রায় তাঁর লেখায় সব সময়ই আত্মবিশ্বাসী এবং তাতে আত্মভাবনার এমনই এক প্রবল চাপ থাকে, যা সাধারণ মানের যুক্তিবাদীর পক্ষে সহ্য করা কঠিন। তাঁর লেখা পড়ার সময় স-চেতন ও স-তর্ক থাকতে হয়, ধারণা করি, আত্মবিশ্বাসী মনোভাব থাকা সত্ত্বেও শুরু থেকেই এ রকম তর্ক প্রত্যাশা করেই নানা লেখায় তাঁর মত প্রকাশ করে গেছেন শিবনারায়ণ। প্রথম বইয়ে যে শ্রেণি-ঐক্যের কথা বলেছিলেন, কেউ তার উল্লেখযোগ্য বিরোধিতা না করলেও পরে তিনি নিজেই সেই চিন্তা থেকে সরে এসেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় বই ‘সাহিত্য চিন্তা’র অন্তর্ভুক্ত ‘প্লেটোর সাহিত্যবিচার’ প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, সভ্যতার ইতিহাসে সমাজ কীভাবে ব্যক্তির অনন্য ভূমিকাকে খর্ব করে এবং ব্যক্তির আত্মবিকাশে সহযোগী না হয়ে আত্মবিলোপের কারণ হয়। এভাবে দেখা যায় ব্যক্তি তার স্বভাব অস্বীকার করে ‘সমাজনির্দিষ্ট ছাঁচে নিজেকে ঢালাই করার মধ্যে পরমার্থ খোঁজে।’ বোঝা যায় এমন ছাঁচে-ঢালাই-হয়ে-যাওয়া ‘ব্যক্তি’ শিবনারায়ণের অপছন্দ, তিনি সমাজে সেই বিকশিত ব্যক্তিকে চান, যে সমাজকে পুষ্ট ও গতিশীল করে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
শিবনারায়ণ রায় (জন্ম: ২০ জানুয়ারি ১৯২১—মৃত্যু: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮).উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: রব ন দ রব র ধ প রবন ধ হয় ছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
‘নেতা হইছোস? সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করো?’
‘নেতা হইছোস? সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করো?’ অপারেশন টেবিলে শুয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক চিকিৎসকের মুখে তারেক শাহরিয়ার তন্ময়কে শুনতে হয়েছিল এমন কটূক্তি।
তন্ময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল দিনে পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) শিক্ষার্থী। তার কাছে হাসপাতালের সেই অপমান আজো দগদগে ক্ষত।
গত বছর ১৬ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে তন্ময়ও অংশ নেন। রাজধানীর ভাটারা থানা ও নতুন বাজারের রাস্তায় দিনভর চলতে থাকে স্লোগান ও মিছিল। ১৭ জুলাই আন্দোলনে সাময়িক বিরতি এলেও পরদিন সকালেই ফের রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা।
আরো পড়ুন:
ফ্যাসিবাদ পতনের বর্ষপূর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা আয়োজন
বাকৃবি ২ ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ ১৫৪ জনকে শাস্তি
তন্ময় বলেন, “বন্ধুর ফোনে খবর পেয়ে বের হওয়ার আগে বেলকনি থেকে দেখি আওয়ামী লীগের কিছু লোক বস্তা থেকে অস্ত্র-ছুরি বের করছে। তখনই ভয় পেয়ে আইডি কার্ড গলায় ঝুলাইনি।”
তিনি বলেন, “সেদিন নতুন বাজার থেকে শুরু হওয়া মিছিল বাঁশতলা পেরিয়ে উত্তর বাড্ডার দিকে এগোতে থাকলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। পুলিশও টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। ঠিক তখনই পুলিশের শর্টগানের গুলি এসে লাগে আমার বাম চোখে।”
রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে প্রথমে এএমজেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। চিকিৎসকরা জানান, চোখ ফেরানো সম্ভব নয়।
তন্ময় বলেন, “অপারেশনের আগে এক চিকিৎসক এসে বলেছিলেন, ‘নেতা হইছোস? সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করো?’ তখন আমি দুর্বল অবস্থায় অপারেশন টেবিলে শুয়ে কিছু বলতে পারিনি।”
অপারেশনের পরও তাকে অন্য রোগীর সঙ্গে একই বেডে রাখা হয়। বাইরে ছাত্রলীগের হামলার চেষ্টা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসে পাশে দাঁড়ান ও খরচ বহন করেন। খবর পেয়ে রংপুর থেকে ছুটে আসেন তার মা-বাবা। ছেলেকে দেখে ভেঙে পড়েন তারা।
পরে বিদেশে চিকিৎসার চেষ্টা হলেও ভারতীয় ভিসা বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহায়তা, শিক্ষক ও জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তা পেয়েও উন্নত চিকিৎসা হয়নি। এখন বিদেশে গেলেও তেমন লাভ নেই বলেও জানিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় চিকিৎসকরা।
স্বৈরাচার পতনের এক বছর পর দেশ নতুন আশা দেখলেও তন্ময়ের চোখে আলো ফেরেনি। তিনি বলেন, “১৮ জুলাই শুধু আমার চোখে গুলি লাগেনি, সেদিন আমার স্বপ্নেও গুলি লেগেছিল। আমি শুধু একটা চোখ হারাইনি, হারিয়েছি জীবনের ছন্দও।”
তন্ময়ের জীবনে যে অন্ধকারের দাগ লেগেছে, তা দেশের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসে এক বেদনাদায়ক স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। স্বৈরাচার বিদায়ের ১ বছর পূর্ণ হলো আজ। কিন্তু সেই ক্ষতগুলো পুরোপুরি সেরে ওঠার জন্য সময় প্রয়োজন।
তন্ময়ের মতো অসংখ্য তরুণের ত্যাগ ও বেদনায় আজকের মুক্তি সম্ভব হয়েছে, যা আমাদের সবার কাছে চিরস্মরণীয়।
ঢাকা/রাকিবুল/মেহেদী