গত শতকের পঞ্চাশের দশকে দু-একটি প্রবন্ধ লিখেই পাঠকদের যারপরনাই বিচলিত করেছিলেন শিবনারায়ণ রায় এবং তা হয়েছিল তাঁর চিন্তার স্বাতন্ত্র্য আর রবীন্দ্রনাথকে বিষয় করে লেখার কারণেই। যিনি নানা লক্ষ্যে ও উপলক্ষে বাঙালিদের চেতনায় আসন গেড়ে বসে আছেন, তিনি তাঁর সাহিত্যজীবনে কী করেছেন, কী করতে পারেননি বা কী করতে পারতেন, তার আলোচনা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না পাঠকেরা। প্রতিক্রিয়া কী রকম হয়েছিল, তার কিছু আলোচনা পরবর্তী সময়ে অনেকের লেখায় এসেছে, কিন্তু সেই সময়ে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী গৌরী আইয়ুবের লেখায় রয়েছে তার বিশ্বস্ত বর্ণনা: 

‘ঐ দুটি ঢিল শান্তিনিকেতনের নিস্তরঙ্গ ডোবায় পড়ে বেশ বড় বড় ঢেউ তুলেছিল। ছাত্র ও শিক্ষক মহলে খুব উত্তেজনা হয়েছিল। তাঁর প্রবন্ধের বাক্য মুখে মুখে ফিরছিল। বলাই বাহুল্য যে যতই মুখ থেকে মুখান্তরে যাচ্ছিল, ততই মূল থেকে তার আকৃতি পাল্টে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছিল।’   

এই মন্তব্যের শেষবাক্যে একটুখানি অন্য রকমের স্বর যে পাওয়া যাচ্ছে, ধারণা করি, তা আসলে পরবর্তীকালে তাঁর শিবনারায়ণ রায়ের প্রবন্ধ-পাঠেরই ফল। কারণ, পরে যখন তিনি ‘রবীন্দ্রনাথ ও গোয়েটে’ পড়লেন, তাঁর কাছে—মুখে মুখে যতটা শুনেছিলেন—ততটা ‘মারাত্মক’ মনে হয়নি। কিন্তু তখনো তিনি ছিলেন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, কিছুটা বিস্মিতও। কারণ, এর আগে শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে যখন তাঁর দেখা হয় তখন তাঁকে দেখে ভালো তো লেগেছিলই, কাঁধে ‘শানব্যাগ’ থাকায় ‘প্রায় শান্তিনিকেতনী রোমান্টিক ধরনের’ মানুষও মনে হয়েছিল। তার কিছুদিন বাদে, আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে সংসার শুরু করার কয়েক দিন পর একদিন এই মানুষটিই কোনো প্রথাদ্রোহী লেখকের বই না দিয়ে তাঁকে সলজ্জ ভঙ্গিতে একগুচ্ছ লাল ও হলুদ গ্ল্যাডিওলাস উপহার দিয়েছিলেন। এভাবে, পারিবারিকভাবে একাত্ম হয়ে যাওয়ার পরে গৌরকিশোর ঘোষও তাঁকে দেখেছিলেন পরিবারাশ্রয়ী, পত্নীপ্রেমী ও বন্ধুবৎসলরূপে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখার আগেই তাঁর সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি দেখেছিলেন, শিবনারায়ণ রায় কথা বলেন ‘চিবিয়ে চিবিয়ে’, হাঁটেন ‘ল্যাগব্যাগিয়ে’ কিন্তু ‘এই ঋজু মানুষটার মাথার উপরিভাগে কোঁকড়া কোঁকড়া চিরুনিভাঙা একরাশ চুল আর অন্তর্দেশে ক্ষুরধার প্রজ্ঞা, যা তার দুটি চোখে অবিরত উদ্ভাসিত।’ এই মানুষটিকে দেখে গৌরকিশোর ঘোষের যখন যাজ্ঞবল্ক্যের কথা মনে পড়ছে, তখনই তাঁর র‍্যাডিক্যাল বন্ধুদের বেশির ভাগই তাঁকে চিহ্নিত করছিল ‘দাম্ভিক’ হিসেবে। এই [অ]খ্যাতি অতিদ্রুত অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৯৫৬ সালে দেশ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথ ও গোয়েটে’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর, তখনই রবীন্দ্রবিরোধী হিসেবে তাঁর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু তিনি কি মূলত রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন? একবাক্যে বলতে গেলে বলতে হয়, শিবনারায়ণ রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন না, তবে রবীন্দ্রনাথকে নিজের বোধবুদ্ধিমতো মূল্যায়ন করতে চেয়েছেন।

মনে রাখা জরুরি, তখন ১৯৪৬ সাল, এর এক বছর আগে, ১৯৪৫ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে বেরিয়েছে শিবনারায়ণ রায়ের প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘প্রেক্ষিত’, যা বাংলা সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যেটি পড়লে কিছুটা অন্তত বোঝা যাবে, কেন তিনি তখনই তার্কিক এবং কেন তাঁকে দাম্ভিক বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু বইটি প্রত্যাশিত পাঠক পাওয়া দূরের কথা, সম্ভাব্য পাঠক পেয়েছে বলেও মনে হয় না। তারপর মাঝখানে আরও নানা রকম লেখা ছাপা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতি সবার দৃষ্টি পড়ল ১৯৫৬ সালে দেশ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথ ও গোয়েটে’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর, তখনই রবীন্দ্রবিরোধী হিসেবে তাঁর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। 

কিন্তু তিনি কি মূলত রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন? একবাক্যে বলতে গেলে বলতে হয়, শিবনারায়ণ রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন না, তবে রবীন্দ্রনাথকে নিজের বোধবুদ্ধিমতো মূল্যায়ন করতে চেয়েছেন। আমরা দেখব শিবনারায়ণ রায় তাঁর লেখায় সব সময়ই আত্মবিশ্বাসী এবং তাতে আত্মভাবনার এমনই এক প্রবল চাপ থাকে, যা সাধারণ মানের যুক্তিবাদীর পক্ষে সহ্য করা কঠিন। তাঁর লেখা পড়ার সময় স-চেতন ও স-তর্ক থাকতে হয়, ধারণা করি, আত্মবিশ্বাসী মনোভাব থাকা সত্ত্বেও শুরু থেকেই এ রকম তর্ক প্রত্যাশা করেই নানা লেখায় তাঁর মত প্রকাশ করে গেছেন শিবনারায়ণ। প্রথম বইয়ে যে শ্রেণি-ঐক্যের কথা বলেছিলেন, কেউ তার উল্লেখযোগ্য বিরোধিতা না করলেও পরে তিনি নিজেই সেই চিন্তা থেকে সরে এসেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় বই ‘সাহিত্য চিন্তা’র অন্তর্ভুক্ত ‘প্লেটোর সাহিত্যবিচার’ প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, সভ্যতার ইতিহাসে সমাজ কীভাবে ব্যক্তির অনন্য ভূমিকাকে খর্ব করে এবং ব্যক্তির আত্মবিকাশে সহযোগী না হয়ে আত্মবিলোপের কারণ হয়। এভাবে দেখা যায় ব্যক্তি তার স্বভাব অস্বীকার করে ‘সমাজনির্দিষ্ট ছাঁচে নিজেকে ঢালাই করার মধ্যে পরমার্থ খোঁজে।’ বোঝা যায় এমন ছাঁচে-ঢালাই-হয়ে-যাওয়া ‘ব্যক্তি’ শিবনারায়ণের অপছন্দ, তিনি সমাজে সেই বিকশিত ব্যক্তিকে চান, যে সমাজকে পুষ্ট ও গতিশীল করে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

শিবনারায়ণ রায় (জন্ম: ২০ জানুয়ারি ১৯২১—মৃত্যু: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮).

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: রব ন দ রব র ধ প রবন ধ হয় ছ ল

এছাড়াও পড়ুন:

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ‘৮টি বিমান’ ভূপাতিত করা হয়েছে: ট্রাম্পের নতুন দাবি

ভারত-পাকিস্তান সংঘাত নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল বুধবার আবার দাবি করেছেন, গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত তিনিই থামিয়েছিলেন। তবে তিনি এবার সংঘাতে যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার সংখ্যায় বদল এনেছেন। ///এবার তিনি বলেছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নাম দিয়ে পাকিস্তানের ভারতে হামলার সময় ‘আটটি বিমান’ গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, বিশ্বের সব যুদ্ধ ও সংঘাত বন্ধে তাঁর করা বাণিজ্য চুক্তি ও শুল্কের হুমকি হচ্ছে বড় হাতিয়ার।

গতকাল বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামির ‘আমেরিকান বিজনেস ফোরামে’ বক্তৃতাকালে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন শক্তির মাধ্যমে সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করছে। কারণ, কেউ তাদের সঙ্গে ‘ঝামেলা করতে আসবে না’।

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র যেসব বাণিজ্য চুক্তি করেছে, সেগুলোর উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, তাঁর প্রশাসন চীন, জাপান ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে। এরপর তিনি আবারও দাবি করেন, তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের আট মাসে তিনি ‘আটটি যুদ্ধ’শেষ করেছেন।

ভারত ও পাকিস্তানের ‘সংঘাতের অবসান’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, তিনি যখন দিল্লি ও ইসলামাবাদের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সই করার প্রায় মাঝামাঝি সময়ে ছিলেন তখনই তিনি শুনতে পান, এই দুটি প্রতিবেশী দেশ ‘যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে’। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তাঁর প্রশাসন কোনো দেশের সঙ্গেই কোনো চুক্তি করবে না।

বিজনেস ফোরামের অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি দুই দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য চুক্তি করার মাঝামাঝি জায়গায় ছিলাম। তখনই আমি একটি নির্দিষ্ট খবরের কাগজের প্রথম পাতায় পড়লাম, তারা যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। সাত বা আটটি যুদ্ধবিমান গুলি করে নামানো হয়েছিল। মূলত আটটি যুদ্ধবিমান গুলি করে নামানো হয়েছিল।’

ট্রাম্পের এই সংখ্যা তাঁর আগের দাবির সংখ্যার থেকে ভিন্ন। প্রথমে তিনি বলেছিলেন তিনটি বিমান গুলি করে নামানো হয়েছিল। এরপর জুলাই মাসে তিনি সংখ্যাটি বাড়িয়ে পাঁচ করেন। পরে আগস্টে সংখ্যাটি আরও বাড়িয়ে সাত করা হয়। আর এখন, ট্রাম্পের কাছে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় গুলি করে নামানো বিমানের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল ‘৮-এ’।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বন্ধের হুমকি দেওয়ার পরই ‘আমি একটি ফোন কল পেলাম, তারা শান্তি চায়। তারা থেমে গেল। আমি বললাম ধন্যবাদ, চলুন ব্যবসা করি। এটা দারুণ না?’

ট্রাম্প এর আগেও বারবার দাবি করেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘পুরোপুরি ও দ্রুত’ যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার কৃতিত্ব তাঁর প্রশাসনের।

তবে ভারত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারত জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইসলামাবাদের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কোনো ধরনের মধ্যস্থতার জন্য তৃতীয় পক্ষের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ‘৮টি বিমান’ ভূপাতিত করা হয়েছে: ট্রাম্পের নতুন দাবি