নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করেন যবিপ্রবি শিক্ষার্থী সুজা
Published: 23rd, September 2025 GMT
কেউ কেউ শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে যায়, আবার কেউ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ছুটে চলে অদম্য সাহসে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী বি এম সুজা উদ্দিন সেই অদম্য সাহসী মানুষদের একজন।
পরিবারে অভাব ছিল না, কারণ বাবা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কিন্তু সুজার মনে বাসা বেঁধেছিল ভিন্ন এক তৃষ্ণা; স্বপ্ন নিজের কিছু গড়ে তোলার, উদ্যোক্তা হওয়ার। তাই তো ২০২০ সালে অনার্স চতুর্থ বর্ষে থাকা অবস্থায় মাত্র ৩ হাজার টাকা মূলধন দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা।
আরো পড়ুন:
১০ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে অকৃতকার্য ইবি উপাচার্য
চাকসু নির্বাচনের তারিখ পেছানো নিয়ে যা জানা গেল
একজন বন্ধুর কাছে দেড় হাজার এবং এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া দেড় হাজার টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু হয় অনলাইনে ফেসবুক পেজ ও গ্রুপের মাধ্যমে, আজ অরগানিক ও স্বাস্থ্যকর খাবারের বিশ্বস্ত মাধ্যমে রূপ নিয়েছে।
গত ৪ বছর ধরে শুধু অনলাইনেই চলেছে এই পথচলা। এরপর একদিন সাহস করে ক্যাম্পাসের ভেতরে একটি টেবিলে কয়েকটি পণ্য সাজিয়ে বসেন তিনি। সেই টেবিলই হয়ে উঠল তার স্বপ্নের অফলাইন রূপ। আজ সেটা সবার কাছে পরিচিত ‘সুজাস ফুড হেভেন’ নামে।
শুরুতে তার পড়াশোনা আর ব্যবসা সামলানো ছিল অনেক কঠিন। অর্ডার হাতে পেলে ক্লাস বা পরীক্ষা না থাকলে নিজেই ডেলিভারি দিতেন যশোর শহর ও ক্যাম্পাসে। অন্য জেলায় পাঠাতেন কুরিয়ারে। ধীরে ধীরে দোকানে অংশীদার ও কর্মচারী যুক্ত হয়, তাতে কিছুটা স্বস্তি আসে তার। তবে স্বপ্ন পূরণের টানে পড়াশোনার প্রতি আগের মতো সিরিয়াস হওয়া সম্ভব না হলেও নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। কারণ তিনি জানতেন, ফলাফলে কিছুটা ঘাটতি হলেও স্বপ্ন পূরণের পথে অভিজ্ঞতা অর্জনই বড় সম্পদ।
বন্ধুদের সহযোগিতা তার পথচলায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও পেয়েছেন প্রেরণা। ক্যাম্পাসে স্টল বসানোর সুযোগ কিংবা উদ্যোক্তা মেলায় অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা তাকে করেছে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
মাসে ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করে আজ তিনি নিজের খরচ মেটাচ্ছেন, কর্মচারীর বেতন দিচ্ছেন এবং নতুন করে বিনিয়োগ করছেন ব্যবসায়। যদিও এখনো অর্থনৈতিক চাপ পুরোপুরি কাটেনি, তবে সুজা উদ্দিন দৃঢ় বিশ্বাসী- এই চাপই তাকে আরো শক্ত করবে এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সুজা বলেন, “আমার পথচলা একেবারে সহজ ছিল না। প্রথম দিকে আমার দোকানে বসতে লজ্জা লাগত, কখনো কখনো বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখিও হয়েছি। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে সবকিছু জয় করে এখন আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি- আলহামদুলিল্লাহ, আমি আমার কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট। গ্রাহকদের ভালোবাসা ও সম্মান আমার আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।”
তার স্বপ্ন নিরাপদ খাদ্যের আউটলেট গড়ে তোলা এবং ভবিষ্যতে আরো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। ইতোমধ্যে একজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরে তিনি মনে করেন, এটাই তার সবচেয়ে বড় সাফল্যের সূচনা।
অন্য শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে করে তিনি বলেন, “যদি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন থাকে, তাহলে পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে ছোট পরিসরে কাজ শুরু করুন। এমন প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করুন, যা সম্পর্কে আপনি জানেন, ভালো সোর্স রয়েছে এবং যেটা নিয়ে কাজ করতে আপনি আনন্দ পান। এতে সময় সঠিকভাবে কাজে লাগবে, অভিজ্ঞতাও বাড়বে। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর সহজেই বড় পরিসরে শুরু করতে পারবেন।”
সুজা উদ্দিন হয়তো বড় ব্যবসায়ী নন, কিন্তু তার গল্প বড়। তিনি প্রমাণ করেছেন শুধু চাকরির স্বপ্ন দেখলেই জীবন বদলায় না। স্বপ্ন দেখতে হয় ভিন্নভাবে, সাহস করে শুরু করতে হয় ছোট থেকে। এটি তার সাহসের গল্প, স্বপ্নের গল্প, নিজেকে গড়ে তোলার গল্প।
‘সুজাস ফুড হেভেন’ শুধু একটি খাবারের দোকান নয়, এটি একটি প্রমাণ। চাইলে স্বপ্ন সত্যি হয়, যদি লড়াই করার সাহস থাকে।
ঢাকা/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উদ য ক ত র গল প ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
আলব্যের কামুর দর্শন, চরিত্র ও পাঠক
আগামীর আশা নিয়েই আমাদের জীবনের বেশির ভাগ গড়া। যদিও কালকের দিনটি আমাদেরকে আমাদের সবার চরম শত্রু মৃত্যুর কাছে নিয়ে যাবে। লোকেরা এমন করে বাঁচে, যেন নিশ্চিত মরণ সম্পর্কে তাদের আদৌ কিছু জানা নেই। এর গতানুগতিক এই কল্পনাবিলাসিতা একবার খসে পড়লে, বিশ্বকে ভিনদেশি, অদ্ভুত আর অমানবিক একটি জায়গা বলে মনে হবে। সত্যিকার জ্ঞান অসম্ভব এবং যৌক্তিকতা আর বিজ্ঞান বিশ্বকে প্রকাশ করতে পারে না; এমন সব ব্যাখ্যা চূড়ান্তভাবে শূন্যগর্ভ বিমূর্ততা এবং রূপকের মাঝে গিয়ে শেষ হয়—অতিমূল্যবান এ কথাগুলোর মাধ্যমে আলব্যের কামু তাঁর দার্শনিক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘লা মিথ দ্য সিসিফ’ (দ্য মিথ অব সিসিফাস)-এর বর্ণনা শুরু করেন। এরপর তিনি জানান, যে মুহূর্ত থেকে এই নিরর্থকতা শনাক্ত হয়, তখন থেকে তা তীব্র একটি উৎসাহে পরিণত হয়। আর সবকিছুর মধ্যে এটিই সবচেয়ে মর্মন্তুদ।’
রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও দার্শনিক আলব্যের কামুর জন্ম আজ থেকে ১১২ বছর আগে ফরাসি আলজেরিয়ায়। কামুর শৈশবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গিয়ে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। বধির ও অশিক্ষিত মায়ের প্রতি তিনি গভীর অনুরক্ত ছিলেন। এসবের দ্বারা কামুর নিরভিমান শিশুবেলার দিনগুলো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। মনে করা হয়, এসব কারণে তাঁর ভেতর অন্য রকম এক বিনয় কাজ করত। অবশ্য পরে তাঁর অপ্রতিরোধ্য সাহিত্যিক খ্যাতির কাছে তা ম্লান হয়ে যায়। ১৯৫৭ সালে নোবেল বক্তৃতায় কামু তাঁর সেই বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। মর্যাদাসম্পন্ন এই পুরস্কারের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে এ সময় তিনি বলেন, ‘বাস্তবে আমি যা, সেই প্রতিধ্বনির সঙ্গে তুলনা না করে আমি আপনাদের সিদ্ধান্ত বুঝে উঠতে সক্ষম হইনি। যে লোকটি কেবল তার সন্দেহবাতিকতার দিক দিয়েই ধনী। পুরোদস্তুর একজন তরুণ এবং যার সৃষ্টিশীলতা এখনো বিকাশমান। যে তার কাজের নিরিবিলিত্যের যাপনে বা বন্ধুত্বের মধ্যে ফিরে যেতে অভ্যস্ত; কী করে সে এমন একটি ঘোষণা শুনে ভীত না হয়ে পারে, যা তাকে হঠাৎ, দীপ্যমান এক আলোক কেন্দ্রের মধ্য থেকে, সম্পূর্ণ একা এবং নিজের মাঝে চুপসে দেবে? এবং ঠিক কোন অনুভূতিসহকারে সে এমন একটি সম্মাননা গ্রহণ করতে পারে, যেখানে ইউরোপের অন্য লেখকেরা, নিজেরা খুব বিখ্যাত হওয়ার পরও, নীরবতার দোষে দুষ্ট। এমনকি এমনই একটি সময়ে যখন তার আপন জন্মভূমি অশেষ দুঃখ-দুর্গতির মাঝ দিয়ে দিনাতিপাত করছে?’
সত্যিকার জ্ঞান অসম্ভব এবং যৌক্তিকতা আর বিজ্ঞান বিশ্বকে প্রকাশ করতে পারে না; এমন সব ব্যাখ্যা চূড়ান্তভাবে শূন্যগর্ভ বিমূর্ততা এবং রূপকের মাঝে গিয়ে শেষ হয়। যে মুহূর্ত থেকে এই নিরর্থকতা শনাক্ত হয়, তখন থেকে তা তীব্র একটি উৎসাহে পরিণত হয়। আর সবকিছুর মধ্যে এটিই সবচেয়ে মর্মন্তুদ।আলব্যের কামুকামুর এই উদ্বেগের মধ্যে আরও একটি নিশ্চায়ক বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়, একটি রাজনৈতিক কার্যকলাপ হিসেবে তাঁর লিখে যাওয়ার উপলব্ধি। বামদের একজন সাংবাদিক হিসেবে এবং উপনিবেশবিরোধী সংবাদপত্রগুলোর মাধ্যমে যা তিনি শান দিচ্ছিলেন। বিশেষ করে ফরাসিবিরোধী কাগজ কম্বেট–এ ১৯৪৩ থেকে ’৪৭ পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার সময়। যুদ্ধ চলাকালীন এই বছরগুলোতে কামু তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু রচনা লিখে শেষ করেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবন্ধ ‘দ্য মিথ অব সিসিফাস’ এবং উপন্যাস ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’। এ সময় জ্যঁ পল সার্ত্রের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে সময় সার্ত্রেও কম্বেটের হয়ে লিখতেন। ঘটনাক্রমে তাঁদের এই বন্ধুত্ব তিক্ততায় মোড় নেয়। এর কারণ অংশত কমিউনিস্ট জান্তার ইঙ্গিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং যন্ত্রণাভোগ মেনে নিতে কামুর অনিচ্ছা। এর বেশ আগেই, ১৯৩৭–এ, কমিউনিজমের গোঁড়ামি মেনে নিতে অসম্মতি জানানোয় কামুকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হয়।
লেখক ও দার্শনিক আলব্যের কামুর জন্ম আজ থেকে ১১২ বছর আগে ফরাসি আলজেরিয়ায়। কামুর শৈশবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গিয়ে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। বধির ও অশিক্ষিত মায়ের প্রতি তিনি গভীর অনুরক্ত ছিলেন। এসবের দ্বারা কামুর নিরভিমান শিশুবেলার দিনগুলো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।কামু পার্টিকে জনতার ওপরে ঠাঁই দিতে পারেননি। শিল্পকে তিনি রাজনৈতিকতার ওপরে বিশেষ একটি স্তরে উন্নীত করতে পারেননি। নোবেল বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বলেন, ‘আমি আমার শিল্প ছাড়া প্রাণবন্তভাবে বেঁচে থাকতে পারি না। কিন্তু আমি কখনোই একে আমার সবকিছুর ওপরে স্থান দিই না। অপর দিকে যদি আমার শিল্পের প্রয়োজনই হয়ে থাকে, তবে তার একটিই মাত্র কারণ থাকবে। তা হলো, শিল্পকে আমার লোকেদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়নি...এটি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য নয়।’ এই শিল্পই তাঁকে সবচেয়ে বিনম্র এবং চিরন্তন সত্যপ্রবণ করে তোলে।
শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি কঠোর বিশ্বাস রেখে, কামু তাঁর লেখনীকে ‘বাতুল এক ইতিহাসের’ দৃষ্টিভঙ্গি ধারণের ‘অঙ্গীকার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই বক্তৃতায় তিনি ‘লেখকের শিল্প-কৈাশলের আভিজাত্য’ হিসেবে নিজের লেখালেখির বিশেষ এই দায়বদ্ধতার রূপরেখা তুলে ধরেন। এরপর কামু তাঁর বিনয়ী বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে ফিরে আসেন এবং লেখককে ‘তাঁর সশস্ত্র কমরেডদের’ পাশাপাশি রেখে নিজেকে তিনি তাঁর ‘সঠিক জায়গাতে’ স্থাপন করেন। কেননা তিনি এমন একজন লেখক, যিনি নিজেকে তাঁর ‘সীমাবদ্ধতা এবং সন্দেহে’র মাঝে রেখেই নির্ণয় করেন। আর এ প্রক্রিয়াতেই সৃষ্টি হয়েছে কামুর অনন্য সব সিদ্ধান্ত ও সমৃদ্ধ কর্ম। যেমন এই দলীয় রাজনীতির বাইরে এসে দাঁড়ানো। এসব লেখা তিনি এমন একটি সময় রচনা করেছেন, যখন তিনি সক্রিয়ভাবে সবচেয়ে প্রগতিবাদী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর নিজস্ব মানবিক অস্তিত্বের অসমঞ্জস্যের কারণে বা সত্ত্বেও জনতার একের অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি এসব লিখেছেন।
নোবেল বক্তৃতা-রত আলব্যের কামু। স্টকহোম, সুইডেন, ১০ ডিসেম্বর ১৯৫৭