‘কাকের পুচ্ছে ময়ূর পালক’ বহুল প্রচলিত এ প্রবচনটির মর্মার্থ হলো—অযোগ্য ব্যক্তির মূল্যবান বা আকর্ষণীয় কিছু জোরপূর্বক ব্যবহার করে নিজেকে মহৎ বা অভিজাত প্রমাণ করার বৃথা চেষ্টা। হীনম্মন্যতায় ভোগা অথবা অতি-আড়ম্বরপ্রিয় ব্যক্তিরা সমাজে প্রায়ই এমন ‘পালক’ পরিধান করে নিজেদের মর্যাদা বাড়াতে চান।

এমন চর্চা দেখা যায় অনেকের ক্ষেত্রে নামের আগে ডক্টরেট লাগানো নিয়ে। একটু অর্থবিত্তের মালিক আর একটা অনার্স-মাস্টার্স থাকলেই জনগণের কাছে নিজেকে জাহির করার জন্য নানা উপায়ে এই ‘ডক্টর’ শব্দটির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন কিছু ব্যক্তি। এ তালিকায় রয়েছেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ নানা পদধারী লোকজন। তাদের মধ্যেও অনেক যোগ্য ব্যক্তি আছেন নিশ্চয়ই, তাঁদের বাদ দিয়ে বাকিদের ক্ষেত্রে এ আলোচনা।

আরও পড়ুনজালিয়াতির পিএইচডি লইয়া আমরা কী করিব২৫ মার্চ ২০২১

বিখ্যাত মনোবিদ আব্রাহাম মাসলোর তত্ত্বমতে, মানুষের যখন মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়ে যায়, তখন সে খোঁজে নিরাপত্তা, এরপর সঙ্গ ও ভালোবাসা এবং এরপর খ্যাতি। পিএইচডি জিনিসটার সঙ্গে খ্যাতির কোনো সম্পর্ক নেই; অন্তত একাডেমিক দিক থেকে। এর সঙ্গে আসলে মাসলোর থিওরির আরও উচ্চপর্যায়ের সম্পর্ক। যেটিকে বলা হয় ‘সেলফ অ্যাকচুয়ালাইজেশন’। এ শব্দের অনুবাদ প্রায় অসম্ভব। তবে কাছাকাছি বললে এর অর্থ কিছুটা দাঁড়ায়, আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে নিজেকে এমন স্তরে পৌঁছানো, যার মাধ্যমে ব্যক্তি এমন এক ফিলোসফিক্যাল বা দার্শনিক স্তরে পৌঁছান, যে জায়গায় তিনি চিন্তাগত দিক থেকে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে অর্থবহভাবে প্রকাশ ও চর্চা করেন; খ্যাতি যেখানে গৌণ। মুখ্য হলো আত্মসাধনা, আত্মোপলব্ধি।

পিএইচডির পুরো অর্থ হলো ‘ডক্টর অব ফিলোসফি’। কোনো ব্যক্তি যে বিষয়েই পিএইচডি অর্জন করুক না কেন, ডিগ্রির নাম ডক্টর অব ফিলোসফি! ডক্টর অব ফিজিকস বা ডক্টর অব ইকোনমিকস নয়। এর কারণ পিএইচডি কেবল ডিগ্রি নয়; এটি জ্ঞানের এমন স্তর, যেটি সম্পন্ন করার মাধ্যমে তিনি তাঁর বিশেষজ্ঞ এলাকায় নতুন জ্ঞান উৎপাদন করার সক্ষমতা অর্জন করেন। উন্নত দেশে কেবল যাঁরা একাডেমিয়াতে উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের জগতে অবদান রাখতে চান, তারাই কেবল পিএইচডির মতো জটিল, সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য পথে হেঁটে থাকেন। বাকিরা যাঁর যাঁর ফিল্ডে অনার্স বা বড়জোর মাস্টার্স করে চাকরির জগতে প্রবেশ করে নিজেকে অল্প বয়সে প্রতিষ্ঠিত করে নেন।

ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০২৩ সালে উন্নত দেশের জনগণের ২৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারীর শতকরা সংখ্যার তথ্য প্রকাশ করেছে। হিসাবে দেখা যায়, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ ও স্লোভেনিয়া সর্বোচ্চ পিএইচডিধারী জনসংখ্যায় এগিয়ে, যা ৩ শতাংশ। এ সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে ২ শতাংশ এবং ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়ামসহ অন্যান্য দেশে এ হার ১ শতাংশ। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় এ সংখ্যা যথাক্রমে সর্বমোট ১৬ হাজার ও ১৩ হাজার। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো জনবহুল বিশাল দেশে এ সংখ্যা মাত্র ২৪ হাজারের মতো। বাংলাদেশে এ সংখ্যা ৫১ হাজার ৭০৪ (বিবিএস, ২০২২)।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির ভয়াবহ চিত্র। সরকারি হিসাবে যে সংখ্যক পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশই যেখানে মৌলিকত্বের প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে এই পুচ্ছশোভিত ভুয়া পিএইচডির ভার জাতিকে সইতে হচ্ছে করুণভাবে। এই ভুয়া পিএইচডি-পুচ্ছধারীদের ক্রমাগত বাহাদুরি প্রদর্শন, গণমানুষকে ধোঁকা দেওয়া, নানা ধরনের সামাজিক সুবিধা নেওয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে ঠকিয়ে চলেছেন জাতিকে।

আরও পড়ুনআজিজ-বেনজীরকে এমন পিএইচডি কীভাবে দিল বিশ্ববিদ্যালয় ২৩ জুন ২০২৪

এই পুচ্ছধারীদের অনেকে প্রায়ই এই ডিগ্রি ব্যবহার করে কোনো আর্থিক বা পদের সুবিধা নিচ্ছেন না বলে জায়েজ করে থাকেন। আপাতদৃষ্টে দেশের প্রচলিত আইনেও এর প্রতিকার নেই বলেই ব্যাপক মতামত প্রচলিত রয়েছে। এর বিপক্ষে দুটি কথা বলা জরুরি।

যদি আমরা আইনের দার্শনিকতার (জুরিসপ্রুডেন্স) দিক থেকে এটিকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে আইনের দর্শনের দুটি দিক থেকে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথমত, প্রতিশোধমূলক বা ন্যায়বিচারমূলক যুক্তির (রিট্রিবিউটিভিজম) দিক থেকে এটি নৈতিকতা ভঙ্গ করা, যা একাডেমিক মূল্যবোধ ও সমাজের প্রতি করা একটি নৈতিক অপরাধ, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যাঁরা পিএইচডি অর্জন করেন, তাঁদের অর্জিত মর্যাদার অপব্যবহার ও অবমাননা এবং প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পবিত্রতা নষ্ট করা, যা আইনের দার্শিনকতার দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অন্যদিকে ফলবাদী বা উপযোগবাদী যুক্তির (ইউটিলিটারিয়ানিজম ) আলোকে এ ধরনের অপরাধের বিচার নিশ্চিত হলে তা ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা ঠেকানো (ডিটারেন্স), অন্য অপরাধীদের ভীতি তৈরি করা (জেনারেল ডিটারেন্স) এবং সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে এ ধরনের কাজ করা থেকে বিরত রাখা (স্পেসেফিক ডিটারেন্স), জনসাধারণের বিশ্বাস রক্ষা, মিথ্যা বিশেষজ্ঞদের থেকে সুরক্ষিত রাখা, যাতে যোগ্য ব্যক্তিদের ওপর মানুষের বিশ্বাস বজায় থাকে ইত্যাদি একাডেমিক নৈতিকতাকে সুরক্ষিত করবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতারণা বন্ধ করা বিচারব্যবস্থার একধরনের সহজাত কর্তব্যও বটে।

ভুয়া পিএইচডি রোধকল্পে বারবার হাইকোর্ট বিভাগ নানা ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী ইউজিসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে আইন ও বিধি প্রণয়নে। যুগান্তকারী এই কর্মযজ্ঞে যেন আইনের উল্লিখিত দার্শনিক দিক বিবেচনায় ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করে যেকোনো ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে ধরনের সুবিধাই নিক না কেন, তার যথাযথ শাস্তি যাতে নিশ্চিত করা হয়, এটিই পরম প্রত্যাশা। অন্যথায় ভুয়া পিএইচডি ব্যবহার করে প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগীদের ফেরানো গেলেও পুচ্ছধারীরা পতপত করে জাতির সামনে উড়িয়ে চলবেন পিএইচডির চকচকে নকল পুচ্ছ; বিভ্রান্ত করবেন জাতিকে, হেয় করবেন শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক দর্শন।

ইমদাদুল হক তালুকদার মানসিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর প এইচড র প রচল ত ব যবস থ এক ড ম হ র কর ধরন র অপর ধ আইন র

এছাড়াও পড়ুন:

একবারে কতটা বাদাম খাওয়া নিরাপদ

বাদামে যা আছে

প্রতি ১০০ গ্রাম বাদাম থেকে সাড়ে ৫০০ ক্যালরির বেশি শক্তি পাবেন আপনি। বাদামের ধরন অনুযায়ী ক্যালরির পরিমাণে কিছুটা তফাত হয়। এ পরিমাণ সাড়ে ৬০০ ক্যালরি বা তার একটু বেশিও হতে পারে।

বাদামে আছে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড। এই ফ্যাটি অ্যাসিড দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দেহে এইচডিএল অর্থাৎ ভালো চর্বির মাত্রা বাড়ানোর জন্য রোজ বাদাম খাওয়া উচিত। এইচডিএল আমাদের দেহের বিভিন্ন স্থান থেকে কোলেস্টেরলকে বয়ে নিয়ে যায় লিভারে।

লিভারে পৌঁছানো সেই কোলেস্টেরল নানান ধাপ পেরিয়ে একসময় শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের মতো মারাত্মক সব রোগের ঝুঁকি কমে।

বাদামে আরও আছে প্রোটিন বা আমিষ। ভিটামিন ই, থায়ামিন, নায়াসিন, ভিটামিন বি৬, ফলিক অ্যাসিড, জিংক, কপার, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, সেলেনিয়ামসহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাবেন বাদামে। বুঝতেই পারছেন, সুস্থতা ও সৌন্দর্যের জন্য বাদাম চমৎকার এক খাবার।

আরও পড়ুনকখন কোন বাদাম খাবেন, বিশ্বের শীর্ষ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টের পরামর্শ২৩ জুলাই ২০২৫একবারে কতটা খাবেন

পুষ্টিগুণে বাদাম দারুণ। তবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য সারা দিনে ৩০ গ্রাম বাদাম খাওয়াই যথেষ্ট।

সাধারণভাবে খোসা ছাড়ানো এক মুঠো বাদাম বলতে যতটা বোঝায়, তাতেই হয়ে যায় ৩০ গ্রাম। এক দিনে এর বেশি বাদাম খাওয়ার প্রয়োজন নেই।

স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হিসেবে বাদাম জনপ্রিয়। সারা দিনের প্রয়োজনীয় ৩০ গ্রাম বাদাম আপনি চাইলে একবারেই খেয়ে নিতে পারেন। তাতে ক্ষতি নেই। কিংবা চাইলে ভাগ করেও খেতে পারেন সারা দিনের বিভিন্ন সময়ে।

নানা ধরনের বাদাম মিলিয়েও খেতে পছন্দ করেন অনেকে। এটিও ভালো অভ্যাস। মিশ্র বাদাম খেলেও বাদামের মোট পরিমাণের দিকে খেয়াল রাখুন একইভাবে।

রোস্টেড বা সল্টেড বাদাম এড়িয়ে চলুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • একবারে কতটা বাদাম খাওয়া নিরাপদ