আ.লীগ নিষিদ্ধ, নারী সংস্কার কমিশন বাতিলসহ ১২ দফা
Published: 4th, May 2025 GMT
নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ২০১৩ এবং ২০২১ সালের সহিংসতার মামলা প্রত্যাহারে অন্তর্বর্তী সরকারকে দুই মাস সময় বেঁধে দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। গতকাল শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের মহাসমাবেশ থেকে এ আলটিমেটাম দিয়েছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি।
এক যুগ পর ঢাকায় সমাবেশ করে হেফাজত ঘোষণা করে, নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে তিন মাসের মধ্যে বিভাগীয় সম্মেলন এবং আগামী ২৩ মে বাদ জুমা চার দফা আদায়ে বিক্ষোভ মিছিল করা হবে। হেফাজত মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। মহাসমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করাসহ ১২ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নায়েবে আমির মাহফুজুল হক।
২০১০ সালে আহমদ শফীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত অরাজনৈতিক হেফাজত ২০১৩ সালে আলোচনায় আসে আল্লাহ, রাসুল (সা.
ওই বছরের ৫ মে সংগঠনটি ১৩ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকার শাপলা চত্বরে সমাবেশের পর অবস্থান নেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো উচ্ছেদ অভিযানে সরকারি হিসাবেই ৫৮ জন নিহত হয়েছিলেন। ২০২১ সালে স্বাধীনতা দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অতিথি করার প্রতিবাদে ফের আন্দোলনে নামে হেফাজত। তখন সরকারি হিসাবে ২১ জন নিহত হন। ২০১৩ এবং ২০২১ সালে হেফাজতের নেতাকর্মী এবং মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ২৪০টি মামলা হয়।
মামলা প্রত্যাহারে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালেই আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন হেফাজত নেতারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছেও একই দাবি জানিয়ে আসছে। শাপলা গণহত্যার বিচার এবং মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গত ২৮ মার্চ চট্টগ্রামে সভা করে হেফাজত নেতারা ঘোষণা করেন, ৩ মে ঢাকায় মহাসমাবেশ করবেন।
গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর একে কোরআনবিরোধী আখ্যা দিয়ে আগের দুই দাবির সঙ্গে নারী কমিশন বাতিলের দাবি যোগ করে হেফাজত। চতুর্থ দাবি হলো, ফিলিস্তিন এবং ভারতে মুসলিম গণহত্যা বন্ধ করা।
এ চার দাবিতে গতকাল সকাল ৯টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতের মহাসমাবেশ শুরু হয়। তবে ফজরের পর থেকেই হাজার হাজার নেতাকর্মী জমায়েত হন। সমাবেশে অংশ নিতে আসা নেতাকর্মীর ভিড়ে ভোর থেকে শাহবাগ ও আশপাশের এলাকায় যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সমাবেশকারীরা শাহবাগ মোড়, মৎস্য ভবন এবং রমনা পার্কেও অবস্থান নেন। সমাবেশে আগতদের বড় অংশই ছিল কিশোর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। হেফাজত নেতারা দাবি করেছেন, ৫ থেকে ৭ লাখ মানুষের জমায়েত হয়েছে।
হেফাজতের মহাসচিব সাজিদুর রহমান বলেন, দাবি আদায়ে আন্দোলন করব, সংগ্রাম করব, প্রয়োজনে জিহাদ করব।
হেফাজতের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর মোনাজাতের মাধ্যমে দুপুর সোয়া ১টায় মহাসমাবেশ শেষ হয়। তিনি সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, ফ্যাসিবাদের আমলের মিথ্যা মামলা তুলে নিতে নেতারা ড. ইউনূসের সঙ্গে অনেকবার সাক্ষাৎ করে বিনয়ের সঙ্গে আবেদন করেছেন। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। আগামী দুই মাসের মধ্যে যদি হেফাজতের মামলা প্রত্যাহার না হয়, তাহলে যা করতে হয় তাই করবে হেফাজত।
মানবিক করিডোরের নামে বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হরণের অপতৎপরতা প্রতিহতের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, চব্বিশের জুলাইয়ের স্বাধীনতার পর বলতে চাই, দিল্লির দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েছি নিউইয়র্কের গোলামি করতে নয়।
নারীবিষয়ক সংস্কারের প্রতিবেদনে কোরআন, ইসলামকে কটাক্ষ করা হয়েছে অভিযোগ করে মামুনুল বলেন, ধর্মীয় উত্তরাধিকার বিধান, পারিবারিক বিধানকে নারী-পুরুষের বৈষম্যের প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করে কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত প্রদান করেছে।
আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনের জন্য কেউ জুলাই অভ্যুত্থানে জীবন দেয়নি। হেফাজতে ইসলাম নারীবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ড. ইউনূস সরকারের প্রতি প্রশ্ন করতে চাই, কেন অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তৈরি করছেন? প্রয়োজনীয় সংস্কার করুন, অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তৈরি করবেন না।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি করে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ সরকারের উদ্দেশে বলেন, এই সংস্কার আমাদের দেশের বড় সংস্কার, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনো কিন্তু অথবা নেই। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতেই হবে। নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে যেসব আপত্তি উদ্বেগ এসেছে, তা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেখুন।
তিনি আরও বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিছুদিন আগে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নাকি আওয়ামী লীগের। আপনি ভুলে যাবেন না, আমরা আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছি। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবে কি না, নির্বাচনে আসবে কি না, এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।
জৌনপুরের সাইয়্যেদ এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে আলেম-ওলামাদের জঙ্গি তকমা দিয়ে কারাগারে রাখা হয়েছিল। তাদের মুক্তির আগে সংস্কার, নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, মানবিক করিডোরের নামে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের যুদ্ধে ঠেলে দেবেন না।
মহাসমাবেশে বিপুল জমায়েত ঘটাতে হেফাজত নেতারা গত এক মাস জেলা জেলায় যান। ময়মনসিংহ থেকে আসা জামিয়া নুরানী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ২১ বছর বয়সী দিদারুল আমিন সমকালকে জানান, ১০০ বাসে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ সমাবেশে এসেছেন। তাঁর হেফাজতের পদপদবি নেই। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের গণহত্যার বিচারের দাবিতে এসেছেন। সেবার শাপলা চত্বরে তাঁর মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিলেন। পরে র্যাব লাশ গুম করে, যা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মহাসমাবেশ থেকে নারী সংস্কারের নামে ইসলামবিদ্বেষী প্রস্তাবনা বাতিল, জাতীয় নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনার বিচার, তার আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা, ইসরায়েল ও ভারতের পণ্য বর্জন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ভিনদেশিদের অপতৎপরতা বন্ধ ও কাদিয়ানীদের তৎপরতা নিষিদ্ধ করাসহ ১২ দফা ঘোষণা পাঠ করা হয়।
হেফাজতের নায়েবে আমির আহমদ আবদুল কাদের, যুগ্ম মহাসচিব হারুন ইজহার, ঢাকা মহানগর সভাপতি জুনায়েদ আল হাবিবসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা বক্তৃতা দেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন ষ দ ধ কর ন ত কর ম সরক র র ত হয় ছ ইসল ম আওয় ম ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
সুদানে ‘গণহত্যা’ হয়েছে
সুদানের এল-ফাশের শহর ও এর আশপাশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চলছে। কৃত্রিম ভূ–উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণ করে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এমন দাবি করেছেন। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানকার পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সসের (আরএসএফ) লড়াই চলছে। গত রোববার তারা এল-ফাশের দখল করে। এর মাধ্যমে প্রায় দেড় বছরের দীর্ঘ অবরোধের পর পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটিটিও ছিনিয়ে নেয় তারা।
শহরটি পতনের পর থেকে সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যা, যৌন সহিংসতা, ত্রাণকর্মীদের ওপর হামলা, লুটপাট এবং অপহরণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেখানকার যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
এল-ফাশের থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী তাওইলা শহরে জীবিত বেঁচে ফেরা কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে এএফপির সাংবাদিক কথা বলেছেন। সেখানে গণহত্যা হয়েছে জানিয়ে তাঁরা বলেন, শহরটিতে মা-বাবার সামনেই শিশুদের গুলি করা হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে পালানোর সময় সাধারণ মানুষকে মারধর করে তাঁদের মূল্যবান সামগ্রী লুট করা হয়েছে।
পাঁচ সন্তানের মা হায়াত শহর থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের একজন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে থাকা তরুণদের আসার পথেই আধা সামরিক বাহিনী থামিয়ে দেয়। আমরা জানি না, তাদের কী হয়েছে।’
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব বলেছে, গত শুক্রবার পাওয়া কৃত্রিম উপগ্রহের ছবিতে ‘বড় ধরনের কোনো জমায়েত চোখে পড়েনি।’ এ কারণে মনে করা হচ্ছে, সেখানকার জনগণের বড় একটি অংশ হয় ‘মারা গেছে, বন্দী হয়েছে কিংবা লুকিয়ে আছে।’ সেখানে গণহত্যা অব্যাহত থাকার বিভিন্ন ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, আল-ফাশের থেকে এখন পর্যন্ত ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ পালিয়েছে। এখনো কয়েক হাজার মানুষ শহরটিতে আটকা পড়েছে। আরএসএফের সর্বশেষ হামলার আগে সেখানে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ বসবাস করত।
শনিবার বাহরাইনে এক সম্মেলনে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োহান ভাডেফুল বলেন, সুদান একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। আরএসএফ নাগরিকদের সুরক্ষার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু তাদের এই কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে।