পুতিনের হাত থেকে যেভাবে ফসকে যাচ্ছে মধ্য এশিয়া
Published: 13th, July 2025 GMT
রাশিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা কূটনৈতিক বিভেদের চেয়েও বড় কিছু। এই ঘটনা দক্ষিণ ককেশাসে শক্তির ভারসাম্যে সম্ভাব্য বাঁকবদলের ইঙ্গিত দেয়।
গত ২৭ জুন রাশিয়ার উরাল অঞ্চলের শিল্পনগরী ইয়েকাতেরিনবুর্গে রাশিয়ার বিশেষ বাহিনী জাতিগত আজারবাইজানিদের ওপর সহিংস অভিযান চালায়। প্রায় ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই অভিযানে বেশ কয়েকজন আহত হন। নিরাপত্তা হেফাজতে দুই ভাই জিয়াদ্দিন ও হুসেইন সাফারভ মারা যান।
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন বলছে, জাতিগত আজারবাইজানি দুই ভাইয়ের শরীরে আঘাতের গুরুতর চিহ্ন ও পাঁজরে ভাঙা হাড়ের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অথচ রুশ কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, তাঁরা হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। বেঁচে ফেরা ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, তাঁদের মারধর করা হয়েছে ও ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুনপুতিন একটা মহাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন?২৬ এপ্রিল ২০২৫আজারবাইজানে এই অভিযানকে একটি সাধারণ আইনি অভিযান হিসেবে নয় বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযান হিসেবে দেখা হয়েছে। তারা মনে করছে, এর উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখানো। আজারবাইজানের সরকারি কর্তৃপক্ষ এ অভিযানের তীব্র নিন্দা জানায় এবং জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়।
১ জুলাই রাশিয়ায় নিযুক্ত আজারবাইজানের রাষ্ট্রদূত রহমান মুস্তাফায়েভ মস্কোর কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানান। রাশিয়ায় আজারবাইজানি নাগরিকেরা (এর মধ্যে দ্বৈত নাগরিকও রয়েছেন) বেআইনি হত্যাকাণ্ড ও অমানবিক আচরণের শিকার হয়েছেন বলে নিন্দা জানান তিনি।
এই কূটনৈতিক টানাপোড়েন এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন আজারবাইজানে সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে উঁচু মাত্রার অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযানে কয়েকজন রুশ নাগরিকও গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ ক্রেমলিনের তহবিলে চলা গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত; আবার কেউ কেউ সাইবার প্রতারণা ও মাদক চোরাচালানের মামলায় অভিযুক্ত। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা স্পুটনিকের আজারবাইজানের স্থানীয় কর্মীরাও।
এই বাড়তে থাকা উত্তেজনা আজারবাইজানের সামনে একটি বিরল কৌশলগত সুযোগ এনে দিয়েছে। পরিস্থিতিকে যদি বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করা যায়, তাহলে আজারবাইজান এটিকে কাজে লাগিয়ে তুর্কি বিশ্বে (তুর্কিভাষী জনগোষ্ঠীদের রাষ্ট্রগুলো) নিজেদের নেতৃত্বের ভূমিকা আরও শক্ত করতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে আরও সমতাভিত্তিক করতে পারে।যদিও এই দুই ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু সময়কাল বিবেচনায় নিলে এটা বলা যায়, আজারবাইজান এর মাধ্যমে এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তারা বাইরের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করছে এবং নতুন মাত্রায় জোরালোভাবে নিজেদের সার্বভৌমত্বের দাবি জানাচ্ছে।
এই ঘটনাপ্রবাহ একটি গভীরতর ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। সোভিয়েত–পরবর্তী বাস্তবতায় সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের প্রচলিত পথগুলো হচ্ছে, সামরিক জোট, জ্বালানির ওপর নির্ভরতা এবং রুশ ভাষাভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে সফট পাওয়ারের প্রদর্শনী। এই হাতিয়ারগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
আরও পড়ুনপুতিন পাঁচ বছরের মধ্যে পশ্চিমের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করবেন২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে চাপে থাকা ক্রেমলিন এখন ক্রমেই প্রবাসী রুশদের ওপর নজরদারি, প্রতীকী শক্তি প্রদর্শন এবং জাতীয়তাবাদী বাগাড়ম্বরের ওপর নির্ভর করে তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করছে। ইয়েকাতেরিনবুর্গে অভিযানটি তারই একটি উদাহরণ। এটি ছিল সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র আজারবাইজান, যে দেশটি এখন স্বাধীনভাবে চলার চেষ্টা করছে, তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার প্রদর্শনী।
আজারবাইজান ঐতিহ্যগতভাবে ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখে আসছে। বর্তমানে দেশটি পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আরও আত্মপ্রত্যয়ী অবস্থান নিয়েছে। অনেক বছর ধরে, আজারবাইজান খুব সতর্কতার সঙ্গে রাশিয়া, পশ্চিমা বিশ্ব এবং তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ আজারবাইজানের পররাষ্ট্রনীতি বদলের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। আজারবাইজান এখন ক্রেমলিনের চাপের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিচ্ছে এবং একই সঙ্গে আঙ্কারার সঙ্গে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা আরও জোরদার করছে।
তুরস্কের সঙ্গে এই ক্রমবর্ধমান মৈত্রী কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কই মজবুত করছে না, বরং অর্গানাইজেশন অব তুর্কি স্টেটস–এর মতো সংস্থার মাধ্যমে আঞ্চলিক সম্পর্ককে মজবুত করছে।
আরও পড়ুনট্রাম্পের যে বিশ্বাসঘাতকতায় পুতিন এখন আরও সাহসী১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫এর প্রভাব শুধু আজারবাইজানেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। আজারবাইজানের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক অবনতির প্রভাব মধ্য এশিয়ায় জোটের সমীকরণ ব্যাপকভাবে পাল্টে দিতে পারে। কাজাখস্তান ইতিমধ্যেই রুশ প্রভাব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের অধীন আর্মেনিয়া প্রকাশ্যে রুশ নিরাপত্তা গ্যারান্টির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
কিরগিজস্তান ও উজবেকিস্তান তুরস্ক ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। এই প্রেক্ষাপটে আজারবাইজানের রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান কোনো বিচ্ছিন্ন কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং সাবেক সোভিয়েত বলয়জুড়ে মস্কোর সফট পাওয়ার যে ধারাবাহিকভাবে ক্ষয় হচ্ছে, তারই প্রতীক।
এদিকে সংবাদমাধ্যম নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে কেউ কেউ খোলাখুলিভাবে আজারবাইজানবিরোধী বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছেন। এই ধরনের উগ্র বক্তব্য জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা উসকে দিচ্ছে।
এসব আক্রমণ সাংবাদিকতা ও রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডার মধ্যে পার্থক্যরেখাটাকে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ছে। প্রথাগত কূটনৈতিক সমাধানের পথটাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এই বাড়তে থাকা উত্তেজনা আজারবাইজানের সামনে একটি বিরল কৌশলগত সুযোগ এনে দিয়েছে। পরিস্থিতিকে যদি বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করা যায়, তাহলে আজারবাইজান এটিকে কাজে লাগিয়ে তুর্কি বিশ্বে (তুর্কিভাষী জনগোষ্ঠীদের রাষ্ট্রগুলো) নিজেদের নেতৃত্বের ভূমিকা আরও শক্ত করতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে আরও সমতাভিত্তিক করতে পারে।
সামনের বছরগুলোতে আজারবাইজান কেবল একটি প্রধান জ্বালানি কেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং দক্ষিণ ককেশাস এবং এর বাইরেও একটি কেন্দ্রীয় ভূরাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
রুস্তাম তাগিজাদে আজারবাইজানের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ক টন ত ক র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
কুমিল্লায় হত্যা মামলার পলাতক আসামি শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার
কুমিল্লার তিতাস উপজেলার কৃষক জহিরুল ইসলাম হত্যা মামলার আলোচিত পলাতক আসামি মো. ডালিম বাবার নাম পরিবর্তন করেও রক্ষা পাননি। গতকাল শনিবার সকালে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে যাচাইয়ের সময় ডালিমের আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাঁকে বিমানবন্দর থানা–পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ বিষয়টি তিতাস থানাকে জানায়।
গ্রেপ্তার ডালিম কুমিল্লার তিতাস উপজেলার মানিককান্দি গ্রামের বাসিন্দা এবং ওই গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু মোল্লার ছেলে। ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে কৃষক জহিরুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর থেকেই ডালিম পলাতক।
তিতাস থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহীদ উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার ডালিমকে আজ রোববার সকালে কুমিল্লা আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ছিল। বাবার নাম নিয়ে বিভ্রান্তি থাকায় যাচাই–বাছাই করে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।