গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হইয়াছে। শুক্রবার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃতকার্যের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হইয়াছে– সংখ্যার হিসাবে যাহা ছয় লক্ষাধিক। ইংরেজিতে প্রবচন রহিয়াছে ‘উইনার টেকস অল’– পাদপ্রদীপের সকল আলো কৃতকার্যেরাই কাড়িয়া লয়; অকৃতকার্যদের ভাগ্যে থাকে কেবলই অন্ধকার।
আমাদের সমাজও এই ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যবশত ব্যতিক্রম নহে; তাই এসএসসি পরীক্ষায় যাহারা সাফল্য লাভ করিয়াছে তাহাদেরই জয়জয়কার সর্বত্র। সকল প্রকার সংবাদমাধ্যমেও ইহারই প্রতিফলন ঘটিয়াছে। অথচ যাহারা অকৃতকার্য হইল, তাহারা এই কৃতকার্যদেরই সহপাঠী, উক্ত উদযাপনের সময় তাহাদের কথা কাহারও মনে থাকিল না। আবারও প্রমাণিত হইল, এই সমাজে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হইবার অর্থ প্রত্যাখ্যাত হওয়া। আর প্রত্যাখ্যান মানেই বিষাদ ও হতাশা।
প্রতি বৎসর পরীক্ষায় অকৃতকার্যতাজনিত হতাশা হইতে বহু শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যা করিতে দেখা যায়, দুঃখজনকভাবে এইবারও সেই প্রবণতা দৃশ্যমান। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে এই বৎসরের এসএসসি পরীক্ষায় ব্যর্থতার কারণে অদ্যাবধি অন্তত ৫ জন শিক্ষার্থীর বিভিন্ন উপায়ে আত্মহননের ঘটনা জানা গিয়াছে। জীবনের শুরুতে এতগুলি কোমল প্রাণ ঝরিয়া যাইবার ফলে শুধু সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলি নহে, রাষ্ট্রও যে ক্ষতিগ্রস্ত হইল তাহা কি আমরা বুঝি? অস্বীকার করা যাইবে না, উপযুক্ত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাইলে এই আপাত ব্যর্থ শিক্ষার্থীরাই এক সময়ে দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও এমন নজির বিরল নহে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছকবাঁধা পরিসরে ব্যর্থতার পরিচয় দানকারী বহু মানুষ শিল্প-সাহিত্য-ক্রীড়ায় বিপুল সাফল্য অর্জন করিয়াছেন। এমনও উদাহরণ কম নাই যে, এসএসসিতে একবার বা দুইবার অকৃতকার্য শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবনের পরবর্তী ধাপগুলিতে সাফল্যের শীর্ষে উঠিয়াছেন।
জীবনের প্রথম পরীক্ষায় অকৃতকার্য হইবার অর্থ সকল কিছুর সমাপ্তি নহে এই কথা আমরা প্রায়শই বলিয়া থাকি। তবে ইহা দৃশ্যত সমাজের বেশির ভাগ মানুষের নিকট নিছক আপ্তবাক্যের অধিক নহে। তাহা না হইলে সংবাদমাধ্যমে কৃতকার্যদের উদযাপনের খবরের পাশাপাশি এই কথাও প্রাধান্য পাইত যে, জীবনের শুরুর এই ব্যর্থতা হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিয়া জীবনের বাকি অংশকে সাফল্যমণ্ডিত করা যায়। ব্যর্থতাই সাফল্যের স্তম্ভস্বরূপ– কথাটা তো অহেতুক প্রচলিত হয় নাই। এত ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থী যে এইবার অকৃতকার্য হইল তাহার প্রাতিষ্ঠানিক বা আর্থসামাজিক কারণও কি অনুসন্ধান করা হইয়াছে? সমকালের প্রতিবেদনে এই বিষয়ে সরকারি কিছু বক্তব্য রহিয়াছে, যেইগুলি গুরুত্বপূর্ণ হইলেও প্রকৃত কারণ নহে। বলা হইয়াছে, বিগত আমলের ন্যায় এইবার শিক্ষার্থীদের উদারভাবে নম্বর প্রদান করা হয় নাই, কোনো গ্রেস নম্বরও ছিল না। তাই পরীক্ষার ফলে এমন বিপর্যয় ঘটিয়াছে। কিন্তু এই কথা তো সত্য যে, সমাজে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য ক্রমবর্ধমান, শহর-পল্লির বৈষম্যও দৃষ্টিকটুভাবে প্রকট। তদুপরি, উপযুক্ত শিক্ষকের ঘাটতি, শ্রেণিকক্ষের সহিত শিক্ষা উপকরণের অভাবও কম নহে। আর এইগুলির কারণে বিশেষত পল্লি অঞ্চলের এবং নিম্নবিত্ত পরিবারভুক্ত শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠনে ভয়াবহ বাধা মোকাবিলা করতে হয়। এই সকল কিছু বিবেচনায় লইয়া যদি কেহ বলে যে শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য হইবার পশ্চাতে তাহাদের দায় যতটা রাষ্ট্র ও সমাজের উহা অপেক্ষা কয়েক গুণ বেশি তাহা হইলে কি অত্যুক্তি হইবে?
আমরা বলিতে চাহিতেছি, শিক্ষার কাঠামোগত ব্যর্থতার দায়, তাহার উৎস আর্থসামাজিক বা অন্য কিছু হউক, শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানো যাইবে না। অনুরূপভাবে, কৃতকার্যদের উৎসাহ দিতে গিয়া অকৃতকার্যদের মধ্যে বিষাদের কারণ ঘটাইবারও কোনো যুক্তি নাই। সর্বোপরি, অকৃতকার্যতার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করিয়া সরকারকে উহা দূর করিবার দিকেই মনোযোগ নিবদ্ধ করিতে হইবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ বন র স ফল য হইয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
শারীরিক সীমাবদ্ধতা জয় করে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে তানিশা
জন্মের পর থেকেই কথা বলতে পারে না জাইমা জারনাস তানিশা। কানেও শোনে খুব কম। তবে শারীরিক সীমাবদ্ধতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।
তানিশা টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা সদরের সালেহা ইউসুফজাই বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ভোকেশনাল শাখার নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। বাড়ি ঘাটাইল সদর ইউনিয়নের কমলাপাড়া গ্রামে।
বাবা মো. জয়নাল আবেদীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রকৌশলী। বর্তমানে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। মা মাফুজুন নাহার ঘাটাইলের কমলাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। মেয়ের এমন সাফল্যে বাবা-মা দুজনই খুশি।
তানিশার মা মাফুজুন নাহার বলেন, জন্মের পর থেকে তানিশা কথা বলতে পারে না। কানেও শোনে কম। ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে। লেখাপড়ার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ। ঘাটাইলের শহীদ সালাউদ্দিন সেনানিবাসে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘প্রয়াসে’ শিশু শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সে। এরপর ঘাটাইল সদরের সালেহা ইউসুফজাই বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে এবার এসএসসি ভোকেশনাল শাখায় পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
মাফুজুন নাহার বলেন, ‘পড়াশোনার ব্যাপারে স্কুলের শিক্ষকদের পাশাপাশি আমিও সহযোগিতা করতাম। সবার সহযোগিতার কারণে তার ভালো ফলাফল করা সম্ভব হয়েছে। তানিশার একমাত্র ভাই প্রবাসী। তানিশার ইচ্ছা ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নেবে।’
তানিশার সাফল্যে বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সবাই আনন্দিত। ইংরেজির শিক্ষক বাসুদেব পাল জানান, তানিশা পরিশ্রমী ও মেধাবী শিক্ষার্থী। বাক্প্রতিবন্ধিতা তার লেখাপড়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তাকে এ সাফল্য এনে দিয়েছে। ভবিষ্যতে সে আরও সাফল্য অর্জন করবে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন।
ঘাটাইল উপজেলা প্রশাসন শুক্রবার তানিশাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু সাঈদ তানিশাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।