পরিবেশবান্ধব শিল্প খাত গড়ে তুলতে করণীয়
Published: 21st, May 2025 GMT
বিশ্বজুড়ে পরিবেশ নিয়ে মনোযোগ বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে, জুতা শিল্পেও এর গুরুত্ব বেড়েছে। এই খাতে ব্যবহৃত উপকরণ যেমন চামড়া, প্লাস্টিক ও নানা রাসায়নিক উপকরণ পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে। তবে, এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিকল্প উপকরণ ও পদ্ধতি গ্রহণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে– পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা উপকরণ, অর্গানিক তুলা, পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক ইত্যাদি। এর মাধ্যমে এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল পণ্যের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাবকে গুরুত্ব দিচ্ছে তা নয়, বরং আগামী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও স্থাপন করছে। এমনকি, থ্রিডি প্রিন্টিং বা ল্যাব থেকে তৈরিকৃত চামড়ার মতো নতুন প্রযুক্তি এই খাতকে আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করে তুলছে। জুতা শিল্প খাতে এ পরিবর্তন ক্রেতাদেরও পরিবেশবান্ধব পণ্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলছে।
আজকের বিশ্বে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো ব্যবসায়িক সাফল্যের অন্যতম মৌলিক উপাদান হয়ে উঠেছে। শুধু মুনাফা অর্জন করাই নয়, বরং পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করা এখনকার সময়ের প্রয়োজনীয়তা। পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতি, যেমন– পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহার, জ্বালানি অপচয় রোধ করা ও দূষণ কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আনতে সহায়তা করে না; একই সঙ্গে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকেও বৃদ্ধি করে। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হিসেবে ব্যবসায়ের টেকসই মডেল নিশ্চিত করা তাই একটি প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ সাফল্যকেই নির্ভরযোগ্য ও স্থিতিশীল করে। এমন উদ্যোগগুলো একদিকে যেমন ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে আরও লাভজনক করে তোলে, অন্যদিকে তেমনি ভোক্তা ও সমাজের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ফলে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই উচিত পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণের প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব আরোপ করা।
তৈরি পোশাক খাতে গ্রিন ফ্যাক্টরি নির্মাণসহ টেকসই নানা উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ। তবে, আরএমজি ছাড়াও চামড়া, সিরামিকস, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ইলেকট্রনিকসের মতো খাতগুলোতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জ্বালানি-সাশ্রয়ী টেকসই সাপ্লাই চেইন গড়ে তোলা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করার মতো পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ববাজারে দায়িত্বশীল উৎপাদনের চাহিদা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ সময় পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরি ও সামগ্রিকভাবে সব খাতে টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেকে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) অন্যতম প্রধান গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে পারে। পরিবেশবান্ধব ব্যবসায়িক খাত গড়ে তুলতে হলে কৌশলগত নীতিমালা সংস্কার এবং অবকাঠামোগত বিনিয়োগ অপরিহার্য। বর্তমানে বাংলাদেশের সামনে থাকা বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্রিন ফাইন্যান্সিং সুবিধার অভাব, টেকনিক্যাল দক্ষতার সীমাবদ্ধতা, রিসাইক্লিং ইকোসিস্টেমের যথেষ্ট সক্ষমতা না থাকা এবং প্রয়োজনীয় নীতিমালার সংস্কার। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের জন্য কর প্রণোদনা দেওয়া, গ্রিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন গড়ে তোলা, পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে খাতভিত্তিক সহযোগিতা উৎসাহিত করা এবং পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়ম-কানুনের মান নির্ধারণ ও কঠোর প্রয়োগের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
এখন বিশ্বজুড়েই পরিবেশের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্প খাতে পানির ব্যবহার কমিয়ে আনা বা দূষণ নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে, ‘জিরো লিকুইড ডিসচার্জ’ পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই প্রযুক্তি কারখানাগুলোতে পানির ব্যবহার কমাতে এবং প্রক্রিয়াজাত বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে সহায়তা করে। ফলে, কারখানা থেকে দূষণ কমে আসে, পানিসম্পদের অপচয় রোধ করা সম্ভব হয়।
একই সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে কাগজবিহীন পদ্ধতির দিকে সারাবিশ্বই ঝুঁকে পড়েছে। সব জায়গাতেই এখন ই-বিল ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এতে কেবল পরিবেশ সংরক্ষণের সুযোগই তৈরি হচ্ছে না; বরং সময়, খরচ ও অপচয়ও কমে আসছে। বলা চলে, এই দুই উদ্যোগ একযোগে আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করে তুলতে ভূমিকা রাখে। আমাদের চারপাশের পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে ও আগামী প্রজন্মের জন্য সম্পদ সংরক্ষণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এ উদ্যোগ দুটি।
শিল্প খাতে টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম বিশ্বজুড়েই খুব দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। তবে, কারও একার পক্ষেই এই পরিবর্তন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তাই, শিল্প খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পর্যায়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন বলা চলে, এই খাতে উদ্ভাবন বাড়াতে ও টেকসই চর্চায় দ্রুত রূপান্তর ঘটাতে হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণা ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। আর এটা সম্ভব হলেই শিল্প ও উৎপাদন খাতে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ, পুনঃপ্রক্রিয়াজাত উপকরণ ব্যবহার এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করা সহজ হবে। বলা চলে প্রযুক্তি, ব্যবসা ও গবেষণার মধ্যে সহযোগিতা, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
ফ্যাশন ও জুতাসহ উৎপাদনমুখী সব খাতে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব চর্চা নিশ্চিত করতে হলে সরকারের সহায়তার কোনো বিকল্প নেই। সরকারের প্রগতিশীল পরিবেশবাদী নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব খাতকে সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল করে তোলা যেতে পারে। টেকসই পণ্য উৎপাদনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে সরকারকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও কার্যক্রমে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করছাড় দিতে হবে। এভাবে, সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একযোগে একটি পরিবেশবান্ধব ও আগামী প্রজন্মের উপযোগী শিল্প খাত গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ব যবহ র ও ট কসই এই খ ত প রক র ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর
বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মূলে রয়েছে কৃষি। এই কৃষির বিবর্তনের গল্প, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য যেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার।
সময়ের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেই হারানো ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও তুলে ধরার প্রয়াসেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি জাদুঘর।
আরো পড়ুন:
জাপানের এনইএফ বৃত্তি পেলেন বাকৃবির ২০ শিক্ষার্থী
গোপনে বাকৃবি ছাত্রীদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে সাবেক ছাত্রকে দিতেন আরেক ছাত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ঠিক সামনেই সবুজ দেবদারু গাছে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এই কৃষি জাদুঘর। প্রকৃতির কোলে যেন কৃষির ইতিহাস কথা বলে এখানে।
২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মু. মুস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, যার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ হোসেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেন।
নানা প্রতিবন্ধকতা ও জনবল সংকটের কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, ২০০৭ সালের ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ এটি পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি দেশের কৃষি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির এক জীবন্ত সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত।
৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত এই অষ্টভুজ আকৃতির ভবনটি স্থাপত্যগত দিক থেকেও দারুণ দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম, পাশে প্রাচীন সাতটি খনার বচন। প্রবেশমুখের ঠিক পরেই দুটি অফিস কক্ষ, আর একটু ভেতরে এগোলেই দেখা যায় একটি ছাদহীন বৃত্তাকার বাগান, যা প্রাকৃতিক আলোর ছোঁয়ায় উজ্জ্বল। সেই বাগানের চারপাশেই রয়েছে সংরক্ষণশালার বিভিন্ন কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই যেন কৃষির একেকটি অধ্যায়।
জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো বীজ সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, তিসি, চিনাবাদাম, কাউনধান, ফ্রেঞ্চ বিন, ফাবা বিনসহ নানা ফল ও সবজির বীজ। দেখা মেলে বিরল প্রজাতির তৈকর ফলের বীজ, যা একসময় আচার ও জেলি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে বহুল পরিচিত ভ্যান্না বীজ, যার তৈল দিয়ে কসমেটিক ও ঔষধি পণ্য তৈরি হয়।
মাটির নানা প্রকার নমুনা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সার, এমনকি পাহাড়ি চাষাবাদের মডেলও স্থান পেয়েছে এখানে।
শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও দর্শনার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন ফসল রোগের চিত্র, আক্রান্ত বীজ, ও ব্যাকটেরিয়ার নমুনা। এ অংশের এক বিশেষ আকর্ষণ আড়াই কেজি ওজনের এক বিশাল মিষ্টি আলু, যা দর্শনার্থীদের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
জাদুঘরের আরেক অংশ যেন এক ক্ষুদ্র প্রাণিবিজ্ঞান জাদুঘর। এখানে প্রদর্শিত আছে বুনো মহিষ, হরিণের শিং, গরু, অজগর ও গোখরা সাপের কংকাল। রয়েছে সংরক্ষিত কালো মেটো ইঁদুর, ধারাই সাপ, এবং কচ্ছপের খোল ও কঙ্কাল।
উপরে তাকালে দেখা যায় এক বিশাল প্রিজার্ভড শকুন, সে যেন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। রয়েছে প্লাটিপাসের কংকালও, যা এক বিরল প্রাণীর বাস্তব নিদর্শন। প্রতিটি নমুনাই যেন দর্শনার্থীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কৃষি কেবল ফসল বা জমির নয়, এটি প্রকৃতি ও প্রাণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যও এখানে তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এক কক্ষে সাজানো আছে ঢেকি, কুলা, পানের ডাবর, হুকা, হারিকেন, কুপি বাতি, গরুর গাড়ির মডেল, এমনকি মাছ ধরার পুরোনো যন্ত্রও। রয়েছে তবলা, বেহালা, আদুরী, ক্রাম ও নাতকসহ বিভিন্ন দেশীয় বাদ্যযন্ত্র।
এক পাশে দেখা যায় ‘গিলা’, যা একসময় বর-কনের গোসল অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। এখনকার তরুণ প্রজন্ম হয়তো নামটিও জানে না, অথচ এটি ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ।
আরো রয়েছে কৃষকের বসতবাড়ির পূর্ণাঙ্গ মডেল, যা দেখতে যেন একেবারে বাস্তব কৃষকের ঘর। এখানে দেখা যায় কৃষকের হালচাষের দৃশ্য, রান্নাঘর, ধান রাখার গোলা, গরুর খোঁয়াড় এবং গৃহিণীর সাজানো রান্নার জায়গা। যেন একবারে গ্রামের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে দেয়াল আর মডেলের মধ্যে।
প্রযুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে পুরনো মাইক্রো কম্পিউটার, ডট প্রিন্টার, পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র, ঘাণি, ডিঙি নৌকা, কাঁঠের তৈরি গরুর গাড়ি, তালগাছের কুন্দা ও উপজাতিদের পোশাক। এক পাশে ঝুলছে হরিণের চামড়া, অন্য পাশে সাজানো উপজাতীয় কৃষি উপকরণ, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই উপকরণগুলো কেবল প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাস নয়, বরং কৃষির সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারার মেলবন্ধনের প্রতীক।
জাদুঘরের আরেক বিশেষ প্রদর্শনী হলো প্রাচীন থেকে আধুনিক সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এগুলো দেখে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জাদুঘরের প্রতিটি কোণ যেন বলে, কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। এখানকার প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি মডেল, প্রতিটি নমুনা কৃষির বিকাশ ও মানুষের সংগ্রামের গল্প বহন করে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে কৃষির অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমান প্রযুক্তির রূপান্তর পর্যন্ত এক নজরে দেখতে পান।
বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “এটি দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে উপকরণসমৃদ্ধ কৃষি জাদুঘর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এটিকে দোতলা ভবনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে কৃষি ভিত্তিক ১৪টি জেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি উপকরণ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে।”
তিনি আরো বলেন, “দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে টিকিট ব্যবস্থা চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।”
এই কৃষি জাদুঘর শুধু কৃষি উপকরণের প্রদর্শনী নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কৃষি সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের সম্পর্কের এক সজীব দলিল। শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের ভিড় থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এখানে আসে, তবে মুহূর্তেই যেন হারিয়ে যায় মাটির গন্ধে, কৃষকের ঘামে, বাংলার গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল সৌন্দর্যে।
জাদুঘরটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এবং প্রতি শনিবার বন্ধ থাকে। সময় সুযোগে একবার ঘুরে গেলে দেখা মিলবে বাংলাদেশের কৃষির হাজার বছরের গল্প, যা মাটি, ঘাম, বীজ আর ঐতিহ্যের বন্ধনে গাঁথা এক অনবদ্য ইতিহাস।
ঢাকা/মেহেদী