আমরা প্রায়ই নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠি। নেতিবাচক চিন্তা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই ‘তুমি অবশ্যই সফল হবে’, এমন উক্তি আমাদের মধ্যে উৎসাহ জাগায়। কিন্তু এই বিশ্বাস আমাদের সীমাবদ্ধ করে ফেলতে পারে।
‘আমি মহান কিছুর জন্য নির্ধারিত’, এই চিন্তা আমাদের মধ্যে অহংকার জাগিয়ে তুলতে পারে, যা আমাদের জীবনের বরকত নষ্ট করে।
অহংকারের ক্ষতিআমাদের সম্ভাবনা কী? সাফল্যের রূপ কেমন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না থাকায় আমরা নিজেরাই সাফল্যের সংজ্ঞা তৈরি করি। আমি ভাবি, আমি একটি বড় কোম্পানির সিইও হতে পারি এবং এটি না হওয়া পর্যন্ত আমি থামব না। অথবা আমার কোনো বন্ধু, যাকে আমি নিজের চেয়ে কম প্রতিভাবান মনে করি, একটি বিশাল ব্যবসা শুরু করেছে। তাই আমি ভাবি, আমি তার চেয়ে ভালো করতে পারি।
অহংকার আত্মবিশ্বাস নয়, অহংকার একটি অস্বাস্থ্যকর বিশ্বাস, যা আমাদের কানে ফিসফিস করে যে আমরা অন্যদের চেয়ে উন্নত, নিয়ম আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।রায়ান হলিডেযখন আমি নিজেকে মহান মনে করি, আমি সেই অনুযায়ী কাজ করি। সামান্য অনৈতিক পথও বেছে নিতে পারি। কারণ, আমি ভাবি, এটি আমার ‘নির্ধারিত’ সাফল্যের জন্য প্রয়োজন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর পরিবর্তে রাতে কাজের ভেতর সর্বদা ডুবে থাকা আমাদের ন্যায্য মনে হয়। এটি আমাদের স্বার্থপর করে তোলে।
আরও পড়ুনসম্পদের অহংকার ধ্বংস করে কারুনকে১৯ মার্চ ২০২৪রায়ান হলিডে অহংকারের একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘অহংকার আত্মবিশ্বাস নয়, অহংকার একটি অস্বাস্থ্যকর বিশ্বাস, যা আমাদের নিজেদের গুরুত্বের ওপর অতিরিক্ত জোর দেয়। এটি আমাদের কানে ফিসফিস করে যে আমরা অন্যদের চেয়ে উন্নত, আমাদের চাহিদা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা এতটাই ব্যতিক্রমী যে নিয়ম আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।’
ইসলামি শিক্ষায় নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ধারণা আছে। আবু আলিয়া সুরখিল ব্যাখ্যা করেছেন যে, ‘এটা হলো আত্মার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সংগ্রাম, যেখানে একজন ব্যক্তি প্রলোভন, শারীরিক আকাঙ্ক্ষা ও শয়তানের প্রবঞ্চনা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করে।’
নফস আল–আম্মারা বা ‘মন্দের দিকে প্ররোচনাকারী আত্মা’ আমাদের সম্পদ, খ্যাতি, ক্ষমতা বা শারীরিক তৃপ্তির দিকে ঠেলে দেয়, যা আমাদের আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
‘আমি মহান কিছুর জন্য নির্ধারিত’, এই চিন্তা আমাদের মধ্যে অহংকার জাগিয়ে তুলতে পারে, যা আমাদের জীবনের বরকত নষ্ট করে।অহংকারের বিরুদ্ধে লড়াইঅহংকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে আমাদের সাফল্যের ধারণাকে পুনর্গঠন করতে হবে। এর অর্থ হলো, দুনিয়ার সাফল্যের পরিবর্তে আখিরাতের পুরস্কারকে প্রাধান্য দেওয়া এবং ফলাফলের পরিবর্তে কাজের প্রক্রিয়ায় মনোযোগ দেওয়া। ‘আমি কীভাবে ওটা অর্জন করব’, এর পরিবর্তে ‘আজ আমি কীভাবে নিজেকে উন্নত করতে পারি’, এই চিন্তা আমাদের কাজের ধরন বদলে দেয়।
আরও পড়ুনমন্দ প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের উপায়০৬ এপ্রিল ২০২৫নিজেকে কিছুর ‘প্রাপ্য’ মনে করার ধারণা থেকে মুক্ত হতে হবে। নবীজি (সা.
এই হাদিসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। প্রথমত, আল্লাহর সামনে আমাদের অবস্থান স্বীকার করা, মানে আল্লাহ আমাদের রিজিক দান করেন, কিন্তু তিনি আমাদের কিছু দিতে বাধ্য নন। দ্বিতীয়ত, প্রক্রিয়ার ওপর মনোযোগ দেওয়া—জান্নাতে প্রবেশ একটি অসাধারণ অর্জন, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন ছোট ও নিয়মিত কাজ। এটি আমাদের তাড়াহুড়ার সংস্কৃতি থেকে বরকতের সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যায়।
কর্মক্ষেত্রে বরকতের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হলে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সমালোচনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে না নিয়ে উন্নতির সুযোগ হিসেবে দেখা, দক্ষতা বাড়িয়ে অন্যদের সেবা করা এবং নিজের পরিবর্তে অন্যদের অবদানের কৃতিত্ব দেওয়া এর অন্যতম উপায় হতে পারে।
সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম
আরও পড়ুনইবলিসের কাহিনি১২ মে ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই চ ন ত স ফল য র আম দ র ম আম দ র ক আম দ র স র জন য আল ল হ
এছাড়াও পড়ুন:
ফিলিস্তিনের এই স্বীকৃতি কি নিছক প্রতীকী অর্জন
দশকের পর দশক ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি জাতিসংঘের হলগুলোতে, রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে এবং জনগণের প্রতিবাদ-সমাবেশে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তবে যে কথাটি সব সময় উপেক্ষিত থেকে গেছে, সেটি হলো স্বীকৃতি শুধু একটি প্রেস রিলিজের শব্দ বা কূটনীতির নথিতে লেখা লাইন নয়। এটি ফিলিস্তিনিদের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় আইনগত মর্যাদা দেয়, চুক্তি ও সংস্থার দরজা খুলে দেয় এবং তাদের কণ্ঠস্বরকে বিশ্বমঞ্চে শক্তিশালী করে।
প্রতিটি নতুন স্বীকৃতি একধরনের প্রতীকী ও নৈতিক অর্জন। এটি ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ লড়াইকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে দৃশ্যমান করে। তবে অভিজ্ঞ ফিলিস্তিনিরা জানেন, কথাগুলো কখনো কখনো দোষ ঢাকার জন্য ব্যবহার করা হয়। তাঁরা জানেন, কেবল স্বীকৃতি দেওয়া গাজার বোমাবর্ষণ থামায় না, পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ বন্ধ করে না বা জেরুজালেমের অবরোধ তুলে দেয় না।
এ ক্ষেত্রে এক মৌলিক প্রশ্ন সামনে আসে: স্বীকৃতির পেছনে কি সত্যিই আন্তরিক সদিচ্ছা আছে? এটি কি বাস্তব পরিবর্তন চাওয়া পদক্ষেপ, নাকি কিছু পশ্চিমা রাজধানীর দায় এড়ানোর কৌশল মাত্র?
পশ্চিমা কোনো সরকার খুব সহজেই বলতে পারে: ‘আমরা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছি।’ সংক্ষিপ্ত এই বাক্যটি জনমনের চাপ কমায়, মিডিয়াকে সন্তুষ্ট করে এবং রাজনৈতিক অগ্রগতির ছাপ দেয়। এ ক্ষেত্রে স্বীকৃতি একটি রাজনৈতিক সেফটি ভলভের মতো কাজ করে। এটি জনমনের চাপ কমায়, মিডিয়াকে সন্তুষ্ট করে, অগ্রগতির ছাপ দেয়, কিন্তু মূল নীতি অপরিবর্তিত থাকে। এটি এমন, যেন রোগীকে ব্যথা কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু মূল রোগের চিকিৎসা হচ্ছে না।
তবু এই ‘ব্যথানাশক’ ফিলিস্তিনের বৈধতার রেকর্ডে একটি পয়েন্ট যোগ করে। স্বল্পমেয়াদি হলেও, যদি ফিলিস্তিনিরা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এটি কাজে লাগায়, তবে তা দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে।
বছরের পর বছর ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের পর বহু পশ্চিমা রাজধানী আজ অদ্ভুত অবস্থায় রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতি সহমর্মিতার অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতির মুখে পড়েছে। তারা জনগণের ক্রোধের মুখোমুখি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ফিলিস্তিন স্বীকৃতি পশ্চিমাদের জন্য এমন একটি সুযোগ হিসেবে আসে, যাতে তারা নিজেদের আবার ‘সৎ মধ্যস্থতাকারী’ এবং ‘আন্তর্জাতিক আইনের রক্ষক’ হিসেবে দেখাতে পারে।
কিন্তু সমীকরণ এখানে স্পষ্ট। এখানে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমাদের বক্তব্য যতটা শক্তিশালী, তাদের কাজ ততটাই সীমিত। তারা নানা কনফারেন্সে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নিয়ে বারবার কথা বলে কিন্তু তার সঙ্গে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ (যেমন ইসরায়েলের আচরণ অনুযায়ী সামরিক সহায়তা বা অর্থনৈতিক সম্পর্ক সমন্বয়) নেওয়া হয় না। ফলে এই স্বীকৃতি কেবল একধরনের সাজানো ছবি হয়ে থাকে। এটি অনেকটা ফাটল ধরানো দেয়ালে কোনো সুন্দর ছবি ঝুলিয়ে দেওয়ার মতো। ছবিটি ফাটল ঢেকে দেয়, জায়গাটা দেখতেও সুন্দর হয়; কিন্তু দেয়ালের ফাটল সারাই করে না।
বাস্তব পার্থক্য তখনই আসে, যখন স্বীকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয় স্পষ্ট নীতি ও কর্মসূচি। ফিলিস্তিনে গড়ে ওঠা ইসরায়েলি বসতিতে উৎপাদিত পণ্যের অর্থনীতিকে ইসরায়েলি অর্থনীতির বাকি অংশ থেকে আলাদা করা, ইসরায়েলের সঙ্গে অস্ত্র চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা এবং আন্তর্জাতিক আদালতে ফিলিস্তিনের মামলা সমর্থন করার মাধ্যমে এই স্বীকৃতিকে অর্থবহ করা সম্ভব।
এই পদক্ষেপগুলো স্বীকৃতিকে কেবল কূটনৈতিক অলংকার নয়, বরং সত্যিকারের প্রভাবশালী হাতিয়ারে পরিণত করতে পারে।
অনেকে ভাবতে পারেন, ফিলিস্তিনের এই স্বীকৃতি পাওয়াকে ইসরায়েল ভয় পায়। কিন্তু বাস্তবতা জটিল। এই ধরনের অন্তঃসারশূন্য স্বীকৃতি ইসরায়েলের স্বার্থেও কাজ করতে পারে। কারণ, এগুলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ছাপ দেয়, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে। এ ধরনের স্বীকৃতির পর মনে হতে পারে, ফিলিস্তিন বুঝি রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু ইসরায়েলি বসতির সম্প্রসারণ, অবরোধ, নিপীড়ন আগের মতো চলতে থাকে।
তবে এই স্বীকৃতি ফিলিস্তিনিদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কিছু সুযোগও তৈরি করে। তার পক্ষে যত স্বীকৃতি জমা হয়, তত নতুন আইনগত ও রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়। যেমন ফিলিস্তিনিদের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া সহজ হয়, তাদের ঐতিহাসিক বর্ণনা শক্তিশালী হয়, বসতি ও অন্যান্য বিষয়ে অর্থনৈতিক ও আইনগত দাবি করার পথ খুলে যায়। ঠিক এই কারণে ইসরায়েল স্বীকৃতিকে শুধু প্রতীকী ও ঝুঁকিমুক্ত কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করে।
এ কারণে আজ খালি প্রতীকী পদক্ষেপ নয়, বাস্তব কাজ দরকার। বসতির সম্প্রসারণ বন্ধ করা, অবরোধ প্রত্যাহার ও দোষীদের দণ্ড নিশ্চিত করা দরকার। এটি করা গেলে স্বীকৃতি হয়ে উঠতে পারে ন্যায়, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার পথে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
● ড. ইব্রাহিম হামামি মিডল ইস্ট মনিটর–এর নিয়মিত কলাম লেখক
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত