ক্ষুদ্র উদ্যোগই বাংলাদেশকে নীরবে এগিয়ে নিচ্ছে
Published: 26th, June 2025 GMT
দেশের অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠান পণ্যের ব্র্যান্ডিং, প্যাকেজিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, বাজারসাপেক্ষে দাম নির্ধারণসহ বিভিন্ন মৌলিক ব্যবসায়িক দক্ষতার ঘাটতিতে ভুগছে
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে একটি ছোট কারখানা, যেখানে কয়েকজন নারী প্রতিদিন নিজ হাতে তৈরি করছেন পাটের ব্যাগ। শহরের গলিতে তরুণ উদ্যোক্তা তাঁর ক্ষুদ্র কফিশপে বানাচ্ছেন নতুন স্বাদের পানীয়। মফস্বলের কোনো কিশোরী তার ছোট্ট টেইলারিং শপে বসে ভবিষ্যতে কোনো একদিন নিজের একটা বুটিক ব্র্যান্ড বানানোর স্বপ্নে নোটখাতায় এঁকে চলেছে নতুন সব ডিজাইন। এমন হাজারো স্বপ্ন, হাজারো ক্ষুদ্র উদ্যোগই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে নীরবে। এসব স্বপ্ন টিকিয়ে রাখতে আমাদের করণীয় কী?
আজ আন্তর্জাতিক এসএমই দিবসে আমরা যখন ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প খাতের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলছি, তখন এসব উদ্যোগের টিকে থাকা এবং লাভজনকভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কেমন সহযোগিতা প্রয়োজন, তা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। এসএমই অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। শিল্প খাতের ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। সেই সঙ্গে দেশের জিডিপিতেও ৩০ শতাংশের কাছাকাছি অবদান রেখে খাতটি বিগত বছরগুলোতে প্রমাণ করেছে, সংকট মোকাবিলা করে টিকে থাকা ও এগিয়ে চলার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও সম্ভাবনা দুটোই এর রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বাড়ন্ত দাম, বাজারে চাহিদার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে এসএমই খাতের অনেক উদ্যোক্তাই চাপের মুখে রয়েছেন। ব্যাংক ঋণের প্রবাহ কমেছে, যার বিপরীতে নতুন বিনিয়োগ হয়েছে হাতে গোনা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে ঋণ বিতরণে প্রায় ১৩ শতাংশ পতন এরই প্রমাণ দেয়। তবে ২০২৫ সাল আমাদের জন্য আবার আশার আলো নিয়ে এসেছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এসএমই খাতকে ঘিরে বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থ উপদেষ্টা ড.
শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে দেশের ১০ হাজার এসএমই উদ্যোক্তাকে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। জেলা শহরগুলোতে আঞ্চলিক এসএমই মেলার আয়োজন, নারী উদ্যোক্তাদের করপোরেট ক্রেতাদের সঙ্গে ডিজিটাল সংযোগ গঠন, কেন্দ্রীয় এসএমই তথ্যভান্ডার তৈরির পরিকল্পনাসহ অন্যান্য উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাস্তবভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এসএমই সহায়তা কাঠামো গড়ে তোলার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
তবে কেবল আর্থিক সহায়তা দিয়েই সম্ভাবনাময় খাতটি পুরোপুরি গতিশীল হতে পারবে না। দেশের অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠান পণ্যের ব্র্যান্ডিং, প্যাকেজিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, বাজারসাপেক্ষে দাম নির্ধারণসহ বিভিন্ন মৌলিক ব্যবসায়িক দক্ষতার ঘাটতিতে ভুগছে। ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা প্রথাগত ও ডিজিটাল বিপণনের পার্থক্য জানেন না। কেমনভাবে নিজেদের উন্নত মানসম্পন্ন পণ্যকে জেলা, বিভাগ এমনকি দেশের সীমার বাইরে ক্রেতার সামনে তুলে ধরা যায়, সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। ই-কমার্সের যুগেও এমন পিছিয়ে পড়া উদ্যোক্তাদের
জন্য প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ জরুরি। বাজেটে প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ থাকলেও এর বাস্তবায়নে মনোযোগ না দিলে আশানুরূপ কার্যকারিতা আসবে না।
এসএমই খাতের অবকাঠামো উন্নয়নের আলোচনায় আরও একটি বিবেচ্য বিষয় হলো, ২০১৯ সালের এসএমই নীতিমালার মেয়াদ ২০২৪ সালেই শেষ হয়ে গেছে। ‘বৈষম্যহীন টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষমতায়ন’– এই রূপকল্প সামনে রেখে সম্প্রতি খসড়া এসএমই নীতিমালা ২০২৫ প্রণীত হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৩৫ শতাংশে উন্নীতকরণ। একটি নতুন, সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী নীতিমালার অধীনে আমাদের বর্তমানের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দুটিকেই সমানভাবে আমলে নিতে হবে।
এসএমই ব্যবসা পরিচালনায় আইনি ও প্রশাসনিক শর্ত সহজ করা, কর ব্যবস্থা সহজ ও যৌক্তিক করা এবং রপ্তানিমুখী এসএমই খাতকে বিনিয়োগ, রাজস্ব ও অন্যান্য প্রণোদনা প্রদানসহ বিভিন্ন নতুন কর্মকৌশলকে আমাদের অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে। এসএমই খাতের উন্নয়নে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি জাতীয় এসএমই উন্নয়ন পরিষদ যেন দেশের লাখো তরুণ উদ্যোক্তাকে সহযোগিতা ও সমাধানের একটি নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হতে পারে, সেই আশাবাদও ব্যক্ত করি।
সিএমএসএমই খাতে ঋণ প্রদানে নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও নিজেদের অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্সিং স্কিমের আওতায় এ খাতে ঋণসুবিধা সহজলভ্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছে আইডিএলসি ফাইন্যান্স। একটি ‘ডিজিটালাইজড ও অ্যাসিস্টিভ’ মডেলে আমাদের এসএমই অর্থায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী রিলেশনশিপ ম্যানেজারের সহায়তা, বিনামূল্যের ডিজিটাল লোন স্টেটমেন্ট ইত্যাদি সুবিধাও দিয়ে থাকে আইডিএলসি। বাংলাদেশে আমরাই প্রথম লোন ওরিজিনেশন সিস্টেম ও ক্রেডিট স্কোরকার্ডের ব্যবহার শুরু করি, যা গ্রাহকদের জন্য অর্থায়ন প্রাপ্তির সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে এনেছে। এছাড়া আমরা ২০১৬ সাল থেকে ‘আইডিএলসি এসএমই পূর্ণতা’ নামে একটি বিশেষায়িত পণ্য চালু রেখেছি, যার মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৭ হাজারের বেশি নারী উদ্যোক্তা নিজেদের ব্যবসায়ের স্বপ্নকে বাস্তব রূপদানে পূর্ণাঙ্গ আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন।
বাংলাদেশের এসএমই খাতের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন টিকে থাকার শক্তিকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহসে রূপ দেওয়ার মতো পরিবেশ ও অবকাঠামো। সেই পরিবেশ যদি তৈরি করা যায়, তাহলে ছোট প্রতিটি উদ্যোগ একদিন দেশের অর্থনীতির বড় প্রভাবক হয়ে উঠবে। ধীরে ধীরে হলেও দেশের মূল্যস্ফীতি এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসছে। সুদের হার ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে। এখনই দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যথাযথ সহযোগিতা ও সময়োচিত নীতির ভিত্তিতে দেশের সম্ভাবনাময় এসএমই খাতের জন্য একটি শক্ত ভিত গড়ে তোলা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: মত মত এসএমই খ ত র ক এসএমই র এসএমই এসএমই প ব যবস য় আম দ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
১০০ ডলার দেশে পাঠালেই বাড়তি ৩০৭ টাকা বেশি পাবেন
আপনি কি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন? সেখানে উপার্জন করছেন বা সরকারি ভাতা পাচ্ছেন? বৈধ পথে, অর্থাৎ বাংলাদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার পাঠালেই সরকার আপনাকে দিচ্ছে আর্থিক প্রণোদনা। ১০০ ডলার দেশে পাঠালে আপনি পাচ্ছেন আড়াই ডলার আর্থিক প্রণোদনা।
ফলে প্রবাসে অবস্থান করা কোনো বাংলাদেশি ১০০ ডলার পাঠালে দেশে তাঁর আত্মীয় পাচ্ছেন ১২ হাজার ৩০০ টাকা (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা হিসাবে)। এর সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে এই হিসাবে দেওয়া হয় ৩০৭ টাকা ৫০ পয়সা।
কীভাবে পাঠাবেন
আপনি যে দেশেই থাকেন না কেন, সেই দেশের মুদ্রায় আয় পাঠালে তা ডলার হিসেবে দেশে আসে। ব্যাংকগুলো তা বিতরণ করে বাংলাদেশি টাকায়। যদি কোনো প্রবাসী ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অন্য মাধ্যমে দেশে আয় পাঠান, তাহলে এ প্রণোদনা পাচ্ছেন না। ফলে বৈধ পথে প্রবাসী আয় দিন দিন বাড়ছে। প্রণোদনা পেতে আপনাকে অবশ্যই বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে হবে। এ ছাড়া এখন ব্যাংকে ডলারের দামও ভালো।
বাংলাদেশে বিভিন্ন উপায়ে প্রবাসী আয়ের অর্থ গ্রহণ করা যায়। ব্যাংক হিসাব না থাকলেও প্রবাসী আয়ের অর্থ পাওয়া যায়। যাঁদের ব্যাংক হিসাব রয়েছে, তাঁরা সেই হিসাবে অর্থ নিতে পারেন। পাশাপাশি পিনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে অর্থ নেওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে প্রবাসী আয় পাঠানো ব্যক্তির স্বজনের কাছে পিন আসবে। বিদেশ থেকে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানি গ্রামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ পাঠানো যায়। সেই পিন নিয়ে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানি গ্রাম লেখা ব্যাংক বা এনজিওতে গেলেই প্রাপ্য টাকা দিয়ে দেবে। পিন অনেকটা গোপন নম্বরের মতো। এই পিন নিয়ে ওই রেমিট্যান্স হাউসগুলোয় গেলেই প্রবাসী আয়ের টাকার পাশাপাশি সরকারের প্রণোদনার বাড়তি টাকা দেবে। প্রতি ১০০ ডলারে বাড়তি ৩০৭ টাকা ৫০ পয়সা বেশি পাবেন।
এ ছাড়া মোবাইলে আর্থিক সেবা বিকাশ, রকেট, নগদ হিসাবেও সরাসরি প্রবাসী আয়ের অর্থ গ্রহণ করা যায়। এ জন্য কোনো হিসাব প্রয়োজন হয় না। সাধারণ বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানোর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে স্বজনের কাছে পৌঁছে যায়। ফলে দেশে প্রবাসী আয়ের অর্থ গ্রহণ করা আগের চেয়ে সহজ হয়েছে।
বিদেশ থেকে প্রবাসীরা প্রায় বছরখানেক ধরে বৈধ পথে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন। মূলত অর্থ পাচার কমে আসায় এবং বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানো সহজ হওয়ায় প্রবাসীরা তাঁদের আয় পাঠাতে বৈধ পথকে বেছে নিয়েছেন।
রেমিট্যান্স কত এল
দেশে চলতি জুনের প্রথম ৩ সপ্তাহে ১৯৮ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে। এর মধ্যে শেষ ৩ দিনে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। গত বছরের জুনের প্রথম ৩ সপ্তাহে এসেছিল ১৯১ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়। সে হিসাবে চলতি মাসের প্রথম ২১ দিনে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবাসী আয় বেড়েছে ৪ শতাংশ।
প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোয় ডলারের যে সংকট চলছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে বলে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান। তাঁরা বলেন, ডলারের দাম নিয়ে অস্থিরতাও কমেছে। ব্যাংকগুলো এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ দর ১২৩ টাকার মধ্যেই প্রবাসী আয় কিনছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২১ জুন পর্যন্ত ২ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ২ হাজার ৩২৯ কোটি ডলারের। তার মানে, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ।