‘আমার ছেলেকে হত্যা করা এসআই এখনো কীভাবে চাকরি করে?’
Published: 6th, August 2025 GMT
কুষ্টিয়া মডেল থানার সামনে গত বছরের ৫ আগস্ট বিকালে আন্দোলনের মধ্যে গুলিতে নিহত কিশোর আব্দুল্লাহর বাবার জিজ্ঞাসা- তার ছেলের হত্যাকারী এসআই সাহেব আলী এখনো কীভাবে চাকরি করছেন; এক বছর হয়ে গেলেও এখনো কেন আসামিদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি; কেন পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারে আগ্রহী নয়।
কুষ্টিয়া শহরের চর থানাপাড়া এলাকার লোকমান হোসনের ছেলে আব্দুল্লাহ। ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয়ের গেটের কাছে চায়ের দোকানে বাবার সঙ্গে কাজ করত আব্দুল্লাহ।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিন বিকালের সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে কাতর হয়ে পড়েন লোকমান হোসেন। মঙ্গলবার জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে নিজ বাড়িতে ছেলেকে হারানোর কষ্টের সঙ্গে এখনো বিচার না পাওয়ার বেদনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আব্দুল্লাহর বাবা।
আরো পড়ুন:
খুলনায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ ও উন্মুক্ত আলোচনা
‘আমার ছেলেকে গোসল করাতেও দেয়নি ওরা’
লোকমান হোসেন হত্যাকারী হিসেবে কুষ্টিয়া মডেল থানার সাবেক এসআই সাহেব আলীর নাম বলেছেন।
তিনি বলেন, “সাহেব আলী প্রকাশ্যে নিজে হাতে আমার ছেলেকে টেনে নিয়ে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে। বুকের এক পাশে গুলি করে, বুক ভেদ করে অন্য পাশ দিয়ে সেটি বেরিয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষের সামনে এসআই সাহেব আলী আমার ছেলেকে হত্যা করেছে।”
আব্দুল্লাহ ছিল ১৩ বছরের কিশোর। ৫ আগস্ট কুষ্টিয়া শহরের থানার মোড়ে আন্দোলনের সময় আব্দুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
আব্দুল্লাহর বাবা আক্ষেপ করে বলেন, “আমার ছেলেকে হত্যার ঘটনার এক বছর হলো কিন্তু আমার ছেলে হত্যার বিচার পাচ্ছি না। এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা একেবারেই নিরব। পুলিশের কোনো আগ্রহ নেই, জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় না। আমার ছেলে জুলাই আন্দোলনে জীবন আত্মত্যাগ করল, আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার পাইলাম না।”
প্রশ্ন রেখে লোকমান হোসেন বলেন, “এসআই সাহেব আলী প্রকাশ্যে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যার পরও চাকরি করে কীভাবে? আমি তার ফাঁসি চাই। প্রকাশ্যে মার্ডার করে এখনো কীভাবে সাহেব আলী ও মুস্তাফিজ চাকরি করে?”
তিনি আরো বলেন, “আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। আমার ছেলে আব্দুল্লাহও হাসপাতালে আমার কাছে ছিল। সে ভাত খাওয়ার কথা বলে হাসপাতাল থেকে বের হয়। এরপর কুষ্টিয়া মডেল থানার সামনে আন্দোলনে যুক্ত হয়। আন্দোলনরত অবস্থায় আমার ছেলেকে ধরে দুই হাত ভেঙে দিয়েছিল এসআই সাহেব আলী। এরপর বুকে গুলি করে হত্যা করে।”
“আওয়ামী লীগের হানিফ এমপি ও তার ভাই আতার নির্দেশে এসআই সাহেব আলী আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি, দ্রুত যেন এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়,” বলেন লোকমান হোসেন।
তিনি বলেন, “সাহেব আলী আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। তার গুলিতে অনেকে আহত এবং নিহত হয়েছেন।”
আব্দুল্লাহ হত্যার ঘটনায় ১৫ আগস্ট রাতে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি মামলা হয়। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিসহ মোট ১৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এই মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ১০-২০ জনকে।
মামলার বাদি আব্দুল্লাহর বাবা লোকমান হোসেন। এই মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। দলীয়ভাবে মামলাটা করা হয়েছিল। যে কারণে কাদের আসামি করা হয়েছিল, আমি জানতাম না। তবে শুরুতে আসামি হিসেবে সাহেব আলীর দিতে দেয়নি পুলিশ।”
“এরপর ট্রাইব্যুনাল থেকে লোক এসেছিল। ওদের কাছে চারজনকে আসামি করে মামলা করেছি। সাহেব আলী, আওয়ামী লীগের সদরের এমপি হানিফ, তার ভাই আতা ও মানব চাকির নামে অভিযোগ দিয়েছি,” যোগ করেন তিনি।
এসআই সাহেব আলী কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই ছিল জানিয়ে লোকমান হোসেন অভিযোগ করেন, “সে আওয়ামী লীগের দোসর। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাহেব আলী মাদক ব্যবসা, হত্যা, গুম, ঘুষ বাণিজ্য, মামলা বাণিজ্য, নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে চাঁদাবাজি করাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল।”
“তার আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ড ছিল বেপরোয়া। জুলাই আন্দোলন শুরু থেকেই সাহেব আলী আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের হুমকি-ধামকি দিত। শুধু তাই নয়, আন্দোলনকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, মারপিট করা, গুলি করাসহ বিভিন্নভাবে স্বৈরাচারী, উগ্র ও খুনির মতো আচরণ করেছে। সাহেব আলীর গুলিতে অনেক আন্দোলনকারী আহত ও নিহত হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।
এসআই সাহেব আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “সাহেব আলী আন্দোলনকারীদের ওপর নিজে গুলি চালিয়েছে। আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গুলি চালিয়েছে। নারী ও পুরুষদের মারপিট করেছে। আমার ছেলের মতো কয়েকজনকে হত্যা করেছে। এটা সবাই জানে, সবাই দেখেছে। সেই খুনি সাহেব আলী কীভাবে এখনো পুলিশে চাকরি করে?”
এসআই সাহেব আলী বর্তমানে খাগড়াছড়িতে কর্মরত আছেন বলে জানিয়ে আব্দুল্লাহর বাবা বলেন, “কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই মুস্তাফিজও সাহেব আলীর সঙ্গে থেকে সব অপরাধ করেছে। সাহেব আলী ও মুস্তাফিজ দুজনে মিলেই এ সমস্ত সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড করেছে। তাদের শাস্তি চাই। তারা কীভাবে এখনো চাকরি করে?”
গতবছরের সেদিনের ঘটনার কথা স্মরণ করে জুলাই শহীদ আব্দুল্লাহর বোন রিনা খাতুন বলেন, “৫ আগস্ট আমার ভাই থানার সামনে আন্দোলন করছিল। এসময় সাহেব আলী আমার ভাইয়ের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। প্রথমে ধরে মারধর করে এবং আমার ভাইয়ের দুই হাত মুচড়ে ভেঙে দেয়। এরপর গুলি করে হত্যা করে।”
সাহেব আলী ও মুস্তাফিজসহ এই ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসির দাবি তুলে আব্দুল্লাহর বোন বলেন, “হত্যার এক বছর হতে চলছে, কিন্তু তাদের (আসামি) আইনের আওতায় আনা হয়নি। তাদের চাকরিও বহাল রয়েছে। তারা এখনো চাকরিরত অবস্থায় আছে। তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া হোক।”
আব্দুল্লাহর ফুফাতো বোন মোমেনা খাতুনও হত্যার একই ধরনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, “আব্দুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবার শাস্তি চাই, ফাঁসি চাই।”
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য এসআই সাহেব আলীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও রাইজিংবিডি ডটকম তার বক্তব্য নিতে পারেনি।
কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি মোশাররফ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আব্দুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে, যার তদন্ত চলমান রয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকা/কাঞ্চন/রাসেল
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ল ই গণঅভ য ত থ ন ল কম ন হ স ন ই স হ ব আল আম র ছ ল ক স হ ব আল র ৫ আগস ট হত য র র স মন য গ কর ই ঘটন আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
রাবির সাবেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা মামলা’র অভিযোগ
অনুমতি ছাড়াই বহুতল ভবন নির্মাণ, বাড়িতে ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলামের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে এক বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে।
রবিবার (৩ আগস্ট) দুপুর ১২টায় রাবির পরিবহন মার্কেটে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী রাশেদুল ইসলামের বড় ভাই তরিকুল ইসলাম। অভিযুক্ত বাড়ির মালিক রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারী এলাকার বাসিন্দা ছানোয়ারুল ইসলাম রাঙা।
লিখিত বক্তব্যে তরিকুল ইসলাম বলেন, “ছানোয়ারুল ইসলাম রাঙা বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনের কর্মকর্তা এবং ডায়মন্ড টাওয়ার নামক একটি ভবনের মালিক। তিনি আমাদের বাড়ির পাশের জমিতে অনুমতি ছাড়াই একটি আটতলা ভবন নির্মাণ করেন। অথচ ওই স্থানে ছয়তলা পর্যন্ত নির্মাণের অনুমোদন ছিল। নির্মাণের সময় তিনি কোনো ফাঁকা জায়গা রাখেননি। ফলে আশপাশের বাসিন্দারা ঝুঁকিতে রয়েছেন।”
আরো পড়ুন:
শ্বাসরোধে ইবি শিক্ষার্থী সাজিদের মৃত্যু: ভিসেরা রিপোর্ট
ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে আমাদের আজীবন সংগ্রাম করতে হবে; ইবি উপাচার্য
তিনি বলেন, “ভবনটি বর্তমানে একটি ছাত্রীনিবাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ছাত্রীনিবাসের জানালা ও বারান্দা থেকে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনাসহ ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন আমাদের বাড়ির ছাদ, বারান্দা ও আঙিনায় ছুঁড়ে ফেলা হয়। এনিয়ে একাধিকবার ভবন মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তা বন্ধ না করে আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়।”
তিনি আরো বলেন, “বিশেষ করে ভবন মালিকের স্ত্রী প্রায়ই আমাদের পরিবারের সদস্যদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এর প্রতিকার চেয়ে রাশেদুল বোয়ালিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। পরে তাদের অনুরোধে জিডি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।”
তরিকুল জানান, এরপর তারা রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)-এর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। আরডিএ তদন্ত শেষে ২৬ জুন ছানোয়ারুল ইসলামের নামে একটি চিঠি ইস্যু করে এবং তাকে গত ৯ জুলাই শুনানির জন্য ডেকে পাঠালে তিনি সেখানে উপস্থিত হননি। আরডিএর চিঠি পাওয়ার পর ভবনের মালিক ও তার স্ত্রী আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তারা রাশেদুলকে আর্থিক সমঝোতার প্রস্তাব দেন, নানা রকম ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেন, এমনকি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মিথ্যা মামলার হুমকি দেন।
“সম্প্রতি ভবন মালিকের স্ত্রী হুমকি দিয়েছেন, ‘তোর নামে আমার ম্যানেজারের টাকা চুরির মামলা দেবো, জেলে পচবি।’ এরপর তারা রাশেদুলের বিরুদ্ধে ৩ লাখ টাকা চাঁদাবাজির একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। এতে করেও সন্তুষ্ট না হয়ে আরেকটি পুরাতন চাঁদাবাজির মামলায় যেখানে ৩৬ জনের নাম রয়েছে, সেখানে কৌশলে রাশেদুলের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে—যার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই,” বলেন তরিকুল।
এই মামলার জেরে গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৮টার দিকে তালাইমারির নিজ বাড়ি থেকে পুলিশ রাশেদুলকে আটক করে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ছানোয়ারুল ইসলাম রাঙা বলেন, “তাহলে আমারও একটা সংবাদ সম্মেলন করা দরকার। রাশেদ ২০২৩ সালে প্রথমবার আমার কাছে ৬ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এটা শুধু আমি না, এলাকাবাসী সবাই জানে। সে আবারো একই ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে গেলে তাকে বারবার অনুরোধ করেছি, কিন্তু সে থামেনি। সে আমার কাছে চাঁদা চেয়েছে—এ সম্পর্কিত প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “আমার বাসায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ছাত্রীরা ভাড়া থাকেন। মেয়েরা যখন রুমে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকে, হালকা পোশাক পরে থাকে, তখন রাতের অন্ধকারে তারা ছাদ থেকে জানালা দিয়ে ভিডিও করার চেষ্টা করে। এমনকি এসব ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেয়। এসব ঘটনার রেকর্ড আমার কাছে রয়েছে।”
ঢাকা/ফাহিম/মেহেদী