মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে শৈশবে টিকা নেওয়ার সম্পর্ক আছে। গর্ভাবস্থায় নারীদের ব্যথানাশক টাইলেনল ওষুধ খাওয়া নিয়েও সতর্ক করেছেন তিনি। গতকাল সোমবার কোনো ধরনের বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ ছাড়াই ট্রাম্প স্বাস্থ্যবিষয়ক এসব পরামর্শ দেন।

গতকাল হোয়াইট হাউসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রিপাবলিকান এই প্রেসিডেন্ট অন্তঃসত্ত্বা নারী ও ছোট শিশুদের অভিভাবকদের উদ্দেশ করে চিকিৎসা-সংক্রান্ত এসব পরামর্শ দেন। তিনি বারবার তাঁদের বলছিলেন, ব্যথানাশক ওষুধটি ব্যবহার করা উচিত নয়। জীবনের খুব শুরুর দিকে বা একবারে একসঙ্গে শিশুকে প্রচলিত টিকাগুলো দেওয়াও ঠিক নয়।

ট্রাম্পের দেওয়া পরামর্শগুলো চিকিৎসাবিষয়ক সংগঠনগুলোর পরামর্শের বিপরীত। কারণ, বহু গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে চিকিৎসক সমাজ দাবি করেছে, টাইলেনলে ব্যবহৃত অ্যাসিটামিনোফেন নামক উপাদানটি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ।

অথচ গতকাল ট্রাম্প বলেন, ‘আমি যেমনটা ভাবছি ঠিক সেভাবেই বলতে চাই—টাইলেনল খাবেন না। একেবারেই খাবেন না।’

অভিভাবকদের তাঁদের শিশু সন্তানের শরীরে একবারে একসঙ্গে কয়েক প্রকারের টিকা প্রয়োগ না করারও পরামর্শ দেন তিনি।

ট্রাম্প প্রশাসন অটিজমের লক্ষণগুলোর চিকিৎসায় লিউকোভরিন প্রয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। লিউকোভরিন হলো ফলিক অ্যাসিডের একটি ধরন।

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস এবং আমেরিকান কলেজ অব অবস্টেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকলজিস্টসসহ চিকিৎসা, গবেষণা ও অটিজমবিষয়ক বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পের বক্তব্যের সমালোচনা করেছে।

কোয়ালিশন অব অটিজম সায়েন্টিস্টস নামক একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘উল্লিখিত তথ্যগুলোতে প্রমাণ হয় না যে টাইলেনল অটিজমের কারণ এবং লিউকোভরিন এর প্রতিষেধক। এ ধরনের কর্মকাণ্ড কেবল ভীতি তৈরি করে এবং মিথ্যা আশার সঞ্চার করে, অথচ এর কোনো সরল সমাধান নেই।’

আরও পড়ুনকরোনা টিকাকে প্রাণঘাতী বলা কেনেডিকেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন ট্রাম্প১৫ নভেম্বর ২০২৪

গতকাল ট্রাম্প যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র তাঁর পাশে ছিলেন। তিনিও টিকাবিরোধী কথা বলে থাকেন। তিনিও বলে থাকেন, কোনো টিকাই নিরাপদ নয়।

ট্রাম্প টিকা ও অটিজমের মধ্যে সম্ভাব্য সম্পর্ক খুঁজে বের করতে আবারও পরীক্ষা-নিরীক্ষার আহ্বান জানান। অথচ এ তত্ত্বটি বারবারই ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

টাইলেনলের নির্মাতা কোম্পানি কেনভু ট্রাম্পের বক্তব্যের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমরা স্বতন্ত্র ও নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিশ্বাসী। আর তাতে স্পষ্টভাবে দেখা গেছে, অ্যাসিটামিনোফেন গ্রহণের কারণে অটিজম হয় না। আমরা এর বিপরীতে কোনো দাবির সঙ্গে একমত নই। এ ধরনের দাবি যে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও অভিভাবকদের জন্য যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে, তা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’

ট্রাম্প বলে থাকেন, তিনি টিকার বড় সমর্থক। তাঁর দাবি, প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে করোনা মহামারি চলাকালে তাঁর নেতৃত্বেই কোভিড-১৯ টিকা দ্রুত তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এরপরও তিনি টিকা থেকে পারদ (মারকারি) অপসারণের আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন, ১২ বছর বয়সের আগে শিশুদের হেপাটাইটিস বি টিকা পাওয়া উচিত নয়।

ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত এই ভ্যাকসিন জন্মের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেওয়া হয়। হাম, মাম্পস ও রুবেলার টিকাটি একসঙ্গে না দিয়ে তিনটি আলাদা শটে দেওয়া উচিত।

টাইলেনল-অটিজম নিয়ে ট্রাম্পের বলা কথাগুলো করোনা মহামারির প্রথম মাসগুলোতে তাঁর নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তখন তিনি প্রায়ই এমন পরামর্শ দিতেন, যা ছিল বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন। যেমন তিনি তখন মানুষকে ইনজেকশন হিসেবে ব্লিচ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। যদিও তাঁর সমর্থকেরা পরে বলেছিলেন, কথাটি অতটা গুরুত্ব সহকারে বলা হয়নি।

ইউনিসেফ ইউএসএর প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাইকেল জে নায়েনহুইস বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, টিকা নেওয়া নিরাপদ। এতে যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের পোলিও এবং হামের মতো রোগ নির্মূল করতে সাহায্য করেছে।

ধারণা করা হয়, গত ৫০ বছরে অতি জরুরি টিকাগুলো নেওয়ার কারণে অন্তত ১ কোটি ৫৪ লাখ মানুষের জীবন বেঁচেছে।

আরও পড়ুনআমি প্রেসিডেন্ট না থাকলে টিকা আসত না: ট্রাম্প১২ মার্চ ২০২১

গবেষকেরা বলছেন, টাইলেনল ব্যবহারের সঙ্গে অটিজমের সম্পর্ক থাকার দৃঢ় কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০২৪ সালে সুইডেনে প্রায় ২৫ লাখ শিশুর ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় অ্যাসিটামিনোফেনের সংস্পর্শে থাকা এবং স্নায়বিক বিকাশজনিত সমস্যার মধ্যে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই।

২০২৫ সালে ৪৬টি পূর্ববর্তী গবেষণা নিয়ে করা এক পর্যালোচনায় বলা হয়, গর্ভাবস্থায় অ্যাসিটামিনোফেনের সংস্পর্শ এবং এসব সমস্যার বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে সম্ভাব্য সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছিল।

তবে আইকান স্কুল অব মেডিসিন, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং অন্যান্য গবেষকেরা বলছেন, এই গবেষণা এটা প্রমাণ করে না যে এই ওষুধটির কারণেই এমন হয়েছে।

তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন, গর্ভবতী নারীরা প্রয়োজনে অ্যাসিটামিনোফেন ব্যবহার করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মাত্রা ও যতটা সম্ভব কম সময়ের জন্য ব্যবহার করতে হবে।

ট্রাম্পের কর্মকর্তারা সেই পর্যালোচনাকে উল্লেখ করছেন এবং টাইলেনল কতটা নেওয়া উচিত, তা নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার সময় একই ধরনের ভাষা ব্যবহার করছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলিম বিশ্বে আধুনিকতার ধারণা এল যেভাবে

আধুনিকতা এসেছে যেন ঝড়ের মতো—শিল্পের উত্থান, যুক্তির জয়গান, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা আর বিশ্বায়নের ঢেউ নিয়ে। এই পরিবর্তনের মধ্যে মুসলিম বিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে এক ত্রিমুখী পথের সামনে: পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখা, পশ্চিমের পথ অনুসরণ করা, নাকি ঐতিহ্যের আলোকে নতুন করে পথ খোঁজা।

এই লেখায় আমরা দেখব কীভাবে মুসলিম চিন্তাবিদেরা তাঁদের বিশ্বাসের জায়গা থেকে আধুনিক জীবনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন এবং ঐতিহ্যকে নতুন রূপে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন।

আধুনিকতার ঢেউ আর ঐতিহ্যের টানাপোড়েন

আধুনিকতা মানে পুরোনো জীবনযাত্রার সঙ্গে বিচ্ছেদ। এটি যুক্তি, ব্যক্তিস্বাধীনতা আর শিল্পের উন্নতিকে তুলে ধরে, কিন্তু প্রায়ই ধর্মীয় জীবনের পবিত্রতাকে দূরে ঠেলে দেয়।

সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার আধুনিকতাকে যুক্তির জয় আর মোহভঙ্গের গল্প বলেছেন, কার্ল মার্ক্স এতে দেখেছেন পুঁজিবাদের উত্থান, আর এমিল দুর্খাইম দেখেছেন শিল্পসমাজে ব্যক্তির নতুন জায়গা।

মুসলিম চিন্তাবিদদের সামনে দাঁড়িয়েছিল তিনটি পথ: ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরা, পশ্চিমকে প্রত্যাখ্যান করা, নাকি ঐতিহ্যকে নতুন করে বোঝা।

মুসলিম বিশ্বে, যেখানে ধর্ম আর সম্প্রদায় জীবনের মূল ছিল, আধুনিকতার এই ধারণাগুলো যেন হৃদয়ে ধাক্কা দিয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, অধিকার আর শাসনের নতুন ধারণা ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলতে চায়নি।

তাই মুসলিম চিন্তাবিদদের সামনে দাঁড়িয়েছিল তিনটি পথ: ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরা, পশ্চিমকে প্রত্যাখ্যান করা, নাকি ঐতিহ্যকে নতুন করে বোঝা। (মোহাম্মদ শাতাতু, ‘মডার্নিটি অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড’, পৃ. ১৮, মরক্কো ওয়ার্ল্ড নিউজ, রাবাত, ২০২৫)

এই দ্বন্দ্ব মুসলিম হৃদয়ে গভীর প্রশ্ন জাগিয়েছে: কীভাবে আমরা আমাদের বিশ্বাস ধরে রাখব, অথচ নতুন দিনের সঙ্গে পা মেলাব? এই প্রশ্নের উত্তরে মুসলিম পণ্ডিতেরা পথ খুঁজেছেন—না পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণে, না ঐতিহ্যের জড়তায়, বরং একটি সৃজনশীল সমন্বয়ে।

আরও পড়ুনপূর্ব যুগে মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের ধরন১০ মে ২০২৫‘ইসলামি আধুনিকতাবাদ’

উনিশ শতকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার মুখে ‘ইসলামি আধুনিকতাবাদ’ জন্ম নেয়। সংস্কারকেরা বলেছিলেন, ইসলাম গণতন্ত্র, যুক্তি, অগ্রগতি আর শিক্ষার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।

তাঁরা নতুন ধরনের স্কুল চেয়েছিলেন, যেখানে ধর্মীয় আর আধুনিক শিক্ষা একসঙ্গে চলবে। সংবাদপত্রের মাধ্যমে সংলাপের পথ খুলতে চেয়েছিলেন, আর সাংবিধানিক শাসনের কথা বলেছিলেন, যা ইসলামি নীতির মধ্যে থেকে স্বৈরাচারকে সীমিত করবে।

মিসরে মুহাম্মদ আলী পাশা আর খেদিভ ইসমাইল শরিয়াকে আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা শরিয়াকে নতুন আইনি কাঠামোয় ঢেলেছিলেন, যাতে এটি আধুনিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে পা মেলায়। তাঁদের স্বপ্ন ছিল ইসলামি পরিচয় আর আধুনিক শাসনের একটি মেলবন্ধন। (মোহাম্মদ শাতাতু, ‘মডার্নিটি অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড’, পৃ. ২২, মরক্কো ওয়ার্ল্ড নিউজ, রাবাত, ২০২৫)

মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় তখনকার সেই সমন্বয় সাধনের একটি উদাহরণ। এখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান আর দর্শন পড়ানো হয়, যেন তা ইসলাম নতুন সময়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে পারে।

মিসরে মুহাম্মদ আলী পাশা আর খেদিভ ইসমাইল শরিয়াকে আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা শরিয়াকে নতুন আইনি কাঠামোয় ঢেলেছিলেন।কোরআনের নতুন ব্যাখ্যা

আধুনিকতাবাদের পাশাপাশি কিছু সংস্কারক কোরআনের নতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমে ঐতিহ্যকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও মুহাম্মদ আবদুহু পুরোনো ফিকহের শ্রেণিবিন্যাসের বদলে কোরআনের নৈতিক বার্তাকে কেন্দ্রে আনায় উদ্যোগী হন। তাঁরা স্বাধীন ইজতিহাদের মাধ্যমে আধুনিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন।

মুহাম্মদ আবদুহু বিশ্বাস করতেন, কোরআন সব যুগের জন্য প্রাসঙ্গিক, যদি এটি সময়ের প্রেক্ষিতে বোঝা যায়। তিনি শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে যুক্তি ও বিশ্বাসের মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন। (মুহাম্মদ আবদুহু, তাফসির আল-মানার, ১/৪৫, দার আল-কুতুব, কায়রো, ১৯০৫)

কিন্তু এই প্রচেষ্টা কখনো কখনো পদ্ধতিগত গভীরতার অভাবে ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। (মোহাম্মদ শাতাতু, ‘মডার্নিটি অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড’, পৃ. ২৫, মরক্কো ওয়ার্ল্ড নিউজ, রাবাত, ২০২৫)

নৈতিকতার নতুন পথ

ফজলুর রহমানের মতো নব্য-আধুনিকতাবাদী চিন্তাবিদেরা যুক্তি, নৈতিকতা আর সময়ের প্রেক্ষিতে ইসলামকে নতুন করে বুঝতে চেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, কোরআনকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আর আধুনিক জীবনের আলোকে একসঙ্গে দেখতে হবে।

তিনি নৈতিকতাকে আইনের ওপরে স্থান দিয়েছেন। ফলে দেখা যায়, তিনি শোষণমূলক সুদ নিষিদ্ধ করলেও যুক্তিসংগত সুদের অনুমোদন দেওয়ার কথা বলেছেন, যেন তা আধুনিক অর্থনীতির চাহিদা পূরণ করে। (ফজলুর রহমান, ইসলাম অ্যান্ড মডার্নিটি, পৃ. ১২৩, ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস, শিকাগো, ১৯৮২)

মরক্কোর দার্শনিক তাহা আব্দুর রাহমান ইসলামি নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে একটি মানবিক আধুনিকতার কথা বলেছেন। তিনি পশ্চিমের একমুখী মডেল প্রত্যাখ্যান করে বহুমুখী আধুনিকতার পক্ষে কথা বলেন।

তাঁর চিন্তা যুক্তি, ভাষা, নৈতিকতা আর আধ্যাত্মিকতার মিশেলে গড়া, যা আধুনিক প্রয়োজনের সঙ্গে মিলে, কিন্তু ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে। (তাহা আব্দুর রাহমান, দ্য স্পিরিট অব মডার্নিটি, পৃ. ৮৭, দার আল-ফিকর, রাবাত, ২০০৬)

কিন্তু এই প্রচেষ্টা কখনো কখনো পদ্ধতিগত গভীরতার অভাবে ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে।আরও পড়ুনভালো মুসলিম হওয়ার ১০ উপায়১০ আগস্ট ২০২৫নারীর কণ্ঠস্বর

ফাতিমা মেরনিসি ও লায়লা আহমেদের মতো নারীবাদী পণ্ডিতেরা ইসলামের মধ্যে নারীর কণ্ঠস্বরকে নতুন করে সামনে এনেছেন। মেরনিসির মতে, কোরআন–হাদিসের পবিত্র পাঠের পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যা নারীর অধিকারকে সীমিত করেছে। তিনি নারীর অভিজ্ঞতা ও অধিকারকেন্দ্রিক ব্যাখ্যার পক্ষে কথা বলেছেন। (ফাতিমা মেরনিসি, দ্য ভেইল অ্যান্ড দ্য মেল এলিট, পৃ. ৬৪, পার্সিয়াস বুকস, মাসাচুসেটস, ১৯৯১)

লায়লা আহমেদ তাঁর উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার ইন ইসলাম বইয়ে মুসলিম সমাজে লিঙ্গ ভূমিকার ঐতিহাসিক গতিপথ দেখিয়েছেন, যা পশ্চিমের সরলীকৃত চিত্রের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। (পৃ. ১০২, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউ হ্যাভেন, ১৯৯২)

এই নারীবাদী চিন্তাবিদদের যুক্তি ছিল, কোরআন সব মানুষের সমান মর্যাদার কথা বলে (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩) এবং প্রথম যুগের মুসলিম নারীরা পণ্ডিত, ব্যবসায়ী ও নেত্রী হিসেবে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন।

স্বর্ণযুগের জ্ঞানের এতিহ্য

ইসলামি স্বর্ণযুগ (অষ্টম-চতুর্দশ খ্রিষ্টাব্দ) আমাদের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইবনে সিনা আর ইবনে রুশদের মতো পণ্ডিতেরা বিশ্বাস আর যুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। বাগদাদের বাইত আল-হিকমা ছিল জ্ঞানের মিলনমেলা, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ একসঙ্গে জ্ঞান চর্চা করত।

এই যুগ দেখিয়েছে, ধর্মীয় ঐতিহ্য যখন জ্ঞান, যুক্তি আর উন্মুক্ততাকে আলিঙ্গন করে, তখন সৃজনশীলতার ফুল ফোটে। (সৈয়দ হোসাইন নসর, সায়েন্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশন ইন ইসলাম, পৃ. ৫৬, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ, ১৯৬৮)

আধুনিক সময়ে ইসলাম

আধুনিকতা আর ইসলামি ঐতিহ্য পরস্পরের বৈরি নয় বটে এবং ইসলামি স্বর্ণযুগ দেখিয়েছে, বিশ্বাস আর যুক্তি একসঙ্গে ফুল ফুটিয়ে তুলতে পারে কিন্তু ‘ইসলামি আধুনিকতাবাদ’ বহু ক্ষেত্রে আধুনিক নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ইসলামের মৌলিক ধারণাকে এড়িয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়।

ধর্মীয় ঐতিহ্য যখন জ্ঞান, যুক্তি আর উন্মুক্ততাকে আলিঙ্গন করে, তখন সৃজনশীলতার ফুল ফোটে। সৈয়দ হোসাইন নসর, সায়েন্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশন ইন ইসলাম

যেমন, সুদ যেখানে মানবজাতির জন্য ধ্বংসের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ, সেখানে আধুনিক সময়ের প্রয়োজনে সুদের অনুমোদন দেওয়ার কথা বলা কোরআনের ব্যাখ্যার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলার অবকাশ আছে।

বরং আধুনিকতা মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মঞ্চ, যেখানে ঐতিহ্য তার সবচেয়ে সুন্দর রূপে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে। পশ্চিমের অনুকরণে নয়, বরং ইসলামি মূল্যবোধে নিহিত একটি নিজস্ব আধুনিকতা দরকার। কোরআনের আলো, নবীজির শিক্ষা আর ঐতিহ্যের গভীরতা আমাদেরকে পথ দেখাতে পারে—এমন পথ যা ন্যায়, করুণা আর মানবিকতার, যা হৃদয়ে শান্তি এনে দেয়।

আরও পড়ুনআধুনিক এই প্রবণতার শিকড় ইসলামে২০ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গর্ভবতী নারীদের প্যারাসিটামল না খাওয়ার পরামর্শ ট্রাম্পের, চিকিৎসকদের তীব্র প্রতিক্রিয়া
  • প্রেমের গুঞ্জনের মধ্যেই কার বিয়েতে হাজির হচ্ছেন জায়েদ-মাহি?
  • মুসলিম বিশ্বে আধুনিকতার ধারণা এল যেভাবে