জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য মানবিক করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ও ঐকমত্য জরুরি বলে মনে করে গণতন্ত্র মঞ্চ। মানবিক সহায়তা করিডরের সঙ্গে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা জড়িত, এ কথা উল্লেখ করে গণতন্ত্র মঞ্চ আশা প্রকাশ করেছে, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার একক সিদ্ধান্ত না নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।

আজ শনিবার এক যৌথ বিবৃতিতে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা এসব কথা বলেছেন। মঞ্চভুক্ত দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু (মঞ্চের সমন্বয়ক), রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এই বিবৃতিতে সই করেছেন।

গণতন্ত্র মঞ্চের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা সংকট জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই সংকটের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ বিষয়ে আলাপ–আলোচনা ও ঐকমত্য জরুরি। মানবিক সহায়তা করিডরের সঙ্গে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা জড়িত। দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িত এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণকে জানায়নি। এমনকি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও কোনো আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেনি।

বিবৃতিতে বলা হয়, বিগত স্বৈরাচারী সরকার একক সিদ্ধান্তে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয় এবং বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছে। এ কারণে বাংলাদেশ নিরাপত্তাসহ সামাজিক নানা সমস্যায় জর্জরিত। সংবাদমাধ্যমের বরাতে আমরা জেনেছি, মিয়ানমার সরকার প্রথম দফায় ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে। তবে এরপরই ইতিমধ্যে আরও ১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা শোনা যাচ্ছে। এতে করে সমস্যা আরও বাড়বে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।

গণতন্ত্র মঞ্চ মনে করে, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে গত বছরের ৫ আগস্ট যে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে, সেটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছতার হবে। তাদের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সব সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমরা আশা করি, যেখানে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার একক সিদ্ধান্ত না নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। দেশের নিরাপত্তা সবার আগে। তাই স্পর্শকাতর এই বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বলে গণতন্ত্র মঞ্চ বিশ্বাস করে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক দল র র বর ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আর বেশিদিন টিকবে না

প্রথম আলো:

গণ–অভ্যুত্থানের পর অংশীজনদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে বলে অনেকে দাবি করছেন। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এ ধারণাকে ব্যাখ্যা করছেন। এই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রায়োগিক সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক রূপ আসলে কেমন বলে আপনি মনে করেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আমার কাছে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হলো, ক্ষমতার নতুন বিন্যাস। অর্থাৎ ক্ষমতার পুরোনো কেন্দ্র যেমন রাজনৈতিক দল, সংসদ, বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্থানীয় সরকার, আমলাতন্ত্র, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, গণমাধ্যম—এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং একই সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালনে উপযোগী সক্ষমতা গড়ে তোলা।

একটা উদহারণ হতে পারে যে সংসদের ক্ষমতা ভেঙে এক কেন্দ্রের জায়গায় একাধিক কেন্দ্র স্থাপন করা, যাকে আমরা ‘বাই ক্যামেরাল’ সংসদের কথা বলছি; ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিবর্তনে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে কোনো নির্দিষ্ট বিনিয়োগকারীদের হাত থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা; পুলিশের বর্তমান কাঠামো ভেঙে একটি স্বাধীন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনা—এগুলো হতে পারে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার প্রায়োগিক জায়গা।

একটি গণতান্ত্রিক অর্থনীতি, অর্থাৎ সবার জন্য প্রতিযোগিতার সমান সুযোগ আছে; স্বচ্ছ, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত, মালিক ও শ্রমিক-—উভয়ের অধিকার আছে, এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি নতুন বন্দোবস্তের অংশ।

প্রথম আলো:

অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা রেখেছিলাম যে তারা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজটি ভালোভাবে করতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হলো, অভ্যুত্থান–পরবর্তী যে ডিজঅর্ডার, তারা সেই জায়গা থেকে জোরালোভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর জন্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে উপদেষ্টামণ্ডলী বেছে নিয়েছেন, তাঁদের অনেকের যোগ্যতা বা দক্ষতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। আমরা দেখেছি, কোনো কোনো উপদেষ্টা কী বাজেভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমি একটি উদাহরণ দিই। অন্তর্বর্তী আমলে অরাজনৈতিক ব্যক্তি বলে কিছু শিক্ষককে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা যেমন অরাজনৈতিক নন, তেমনি সেই পদগুলোর জন্য যোগ্যও নন। তাঁরা নির্দিষ্ট ‍দু-একটি দলের সমর্থক। সিভিল সার্ভিসেও ডিসিপ্লিন ফেরত আনতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।
এরপরও কিছু জায়গায় সরকারের সাফল্যের কথা স্বীকার করতে হবে। যেমন অর্থনীতিতে একটা শৃঙ্খলা এসেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও খুব ধীরে হলেও কিছুটা স্বস্তি ও নিয়মকানুন ফিরছে। রাষ্ট্র সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো হাল ছেড়ে দেয়নি বলে মনে হচ্ছে।

প্রথম আলো:

আমরা দেখেছি, জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল। পুরোনো ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফেরত না যাওয়ার ব্যাপারে সমাজে মোটাদাগের ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু সেই ঐকমত্যের প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরে যে সংস্কারের কথাগুলো বলা হচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে আপনার মতামত কী?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আসলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর রাতারাতি করা যায় না। কিন্তু আশার কথা হলো, আমাদের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা অনেক বেড়েছে। আমাদের ১১টি সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে যেসব সংস্কার প্রস্তাব করেছে, সেগুলোর সবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি স্থানীয় সরকার কমিশনে কাজ করেছি। আমি দেখেছি, ১০ জন মানুষ কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে সুপারিশগুলো তৈরি করেছেন। একই রকম অন্য কমিশনের ক্ষেত্রেও হয়েছে। এই সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

সুপারিশগুলো তো কমিশনের সদস্যরা এককভাবে তাঁদের মাথা থেকে বের করেননি, বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ভিত্তিতে দিয়েছেন। যেকোনো কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাবে, সেখানে সমস্যা ও সমাধান চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সুপারিশের চার ভাগের একভাগও যদি বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে দেশের সার্বিক ব্যবস্থায় ও অবস্থায় বিরাট পরিবর্তন সম্ভব হতো।

তবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর কোনো সরলরৈখিক ব্যাপার নয়। এটা সব সময় এক দিকে এক গতিতে চলতে থাকবে, এমন নয়। এটা কখনো সামনে যেতে পারে, কখনো পেছনেও আসতে পারে। কিন্তু আশার ব্যাপার হলো, কিছু বিষয়ে জনগণের মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। সংস্কারের দাবিগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভবিষ্যতে এ দেশে রাজনীতি করা খুব সহজ হবে না।

প্রথম আলো:

বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর বাছাইকৃত একটি অংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই আলোচনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আমরা ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন দেখলাম। সেখানে যে ১৯টি মৌলিক সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেগুলো নিয়ে ভিন্নমত আছে। আমার ধারণা, আবার আলোচনায় বসলে সেগুলোতেও আরও একটু অগ্রগতি হবে বলে আশা করছি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় নিলে এই অগ্রগতি সামান্য নয়।

সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, সংকট হলো বাস্তবায়নে। আর বাস্তবায়নের জন্য যেহেতু আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল, তারা যদি নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষায় সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারাও অচিরেই আস্তাকুঁড়ে চলে যাবে। তবে এটা তো বলতেই হবে, এই আলোচনার প্রক্রিয়াটারও একটা মূল্য আছে। এতগুলো দল প্রতিদিন একসঙ্গে বসছে, পরস্পরের যুক্তি শুনছে, নিজেদের পাল্টা যুক্তি-প্রস্তাব দিচ্ছে। আমি মনে করি, এগুলোও ইতিবাচকতার চিহ্ন।

কাজী মারুফুল ইসলাম

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই গণ–অভ্যুত্থান কোনো দলীয় নয়, জাতীয় বিবেকের জাগরণ: আনিসুল ইসলাম ও মুজিবুল হক
  • দেশে আবার একটা অস্থিরতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে: মির্জা ফখরুল
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে আবার আলোচনা
  • ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ: সো ফার সো গুড
  • কথিত গণতন্ত্র থাকলেও আমরা বাকস্বাধীনতা হারিয়েছিলাম: তথ‌্য স‌চিব
  • সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন
  • ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ ঠেকাতে অবশ্য সচেতন থাকতে হবে
  • ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে গতি আনতে চায় কমিশন
  • রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আর বেশিদিন টিকবে না
  • হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অধ্যাপক ইউনূস একটি কথাও বলেননি: মেজর (অব.) হাফিজ