চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কুসুমপুরা গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৪৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন চেমন আরা। বিয়ে হয় পটিয়ার নাইখাইন গ্রামের উপ-কর কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহর সাথে। তাদের সংসারে জন্ম নেয় ১১ সন্তান। আর্থিকভাবে মোটামুটি সচ্ছল থাকলেও ১১ সন্তানকে আলোচিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বহু কাটখড় পোহাড়ে হয় তাকে। স্বামী শহরে চাকরি করায় স্ত্রীর উপরই সন্তানদের দেখভাল করার গুরু দায়িত্ব ছিল। গৃহিণী হওয়ায় একে একে সব সন্তানকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্কুলে পাঠানো থেকে শুরু করে সংসার সবকিছুই এক হাতে সামলাতে হয়েছে তাকে। কাজটি খুবই কঠিন হলেও তা সফলভাবেই শেষ করতে পেরেছেন। মায়ের কঠোর পরিশ্রমের ফসল হিসেবে সন্তানেরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সুপ্রিতিষ্ঠত।
সমাজে সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছেন লক্ষীপুর জেলার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো.
শুধু শাহীন নন; চেমন আরার প্রথম শহীদ উদ্দিন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক। চট্টগ্রাম বিশ্বিবিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। দ্বিতীয় সন্তান সেলিম উদ্দিন সাতকানিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায় থেকে বিকম (অনার্স) ও এমকম পাস করেছেন। এভাবেই চেমন আরা ১১ সন্তানকে তিলে তিলে সমাজের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। আট ছেলে ও তিন মেয়ের সবাই কর্মক্ষেত্রেও সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে একজন জেলা ও দায়রা জজ, দুই জন ডাক্তার, চার জন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কলেজ ও স্কুলের অধ্যাপক-শিক্ষক, চার জন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। সন্তানদের সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে জননী চেমন আরা ছিলেন নেপথ্যের নায়ক। করেছেন অনেক ত্যাগ স্বীকার।
৭৭ বছরের সফল মা চেমন আরা বেগম বলেন, ‘আমার যখন বিয়ে হয়, তখন এলাকায় মাটির রাস্তাই ছিল বেশি। দুয়েকটি ইটের রাস্তা থাকলেও পিচ ঢালাই কোনো রাস্তা ছিল না। বর্ষায় মাটির রাস্তায় কাঁদা মাড়িয়েই স্কুলে আসা-যাওয়া করত সন্তানরা। মফস্বল এলাকায় আমার সন্তানদের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। আমার স্বামীর সীমিত আয়ের মধ্যে অনেক ত্যাগ, মিতব্যায়িতা ও আর্থিক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সন্তানদের সুশিক্ষিত করেছি। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে কাজটি সহজ ছিল না। সন্তানরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত দেখে আনন্দ ও গর্ববোধ করি।’
তাঁর বড় ছেলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক শহীদ উদ্দিন বলেন, ‘দুজন ছাড়া আমরা ১১ ভাই-বোনের সবাই গ্রামের নাইখাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পটিয়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়, আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়, গৈরলা কেপি হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছি। পঞ্চম শ্রেণির পর আমি কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে পাথরঘাটায় মামার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক ওয়ার্কশপের এক কামরার রুমে থেকে পড়াশোনা করেছি। তখন আমাদের পড়াশোনা ও মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা মা-বাবার জন্য ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। এখন শহরে থেকেও আমার দুই সন্তানকে পড়াশোনা করাতে হিমশিম খাচ্ছি। ওই সময়ে মা কিন্তু ঠিকই আমাদের মানুষ করেছেন।’
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু শাহাদাত মোহাম্মদ সায়েম বলেন, ‘আম্মার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল উনি শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিদিন একাডেমিক প্রোগ্রামের বিষয়ে সচেতন ছিলেন। সন্ধ্যা হলেই পড়ালিখায় বসিয়ে দিতেন এবং রাতে খাওয়ার আগে তার হিসাব নিতেন। উনি সব বিষয়ে সচেতন থাকতেন এবং যে কোন কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করতেন।’
আরেক সন্তান ডাক্তার মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘সত্তর-আশির দশকে গ্রাম থেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সামাজিক প্রতিকূলতায় খুবই কঠিন কাজ ছিল। মানুষের মধ্যে শিক্ষাবিমুখতা, সন্তান সংখ্যা বেশী হওয়ায় মেয়ের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেওয়া, ছেলের আয় রোজগারে নামিয়ে দেওয়ার কারণে গ্রামে পড়াশোনার হার ছিল খুবই কম। সেখানে মা অপরিসীম ধৈর্য্য ধারণ করে সামাজিক প্রতিকূলকতা মোবাকেলা করে আমাদের সবাইকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন।’
তাঁর সফল সন্তানদের মধ্যে চতুর্থ সন্তান পারভীন আকতার বিএ পাশ করে নারী উন্নয়নে কাজ করছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেষ্ট্র থেকে বিএসসি অনার্স ও এমএসমি পাশ করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন পঞ্চম সন্তান মোহাম্মদ আলমগীর। নগরের বিএএফ শাহীন স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক ষষ্ট সন্তান সেলিনা আকতার বাংলায় বিএ অনার্স ও এমএ উর্ত্তীণ একজন উচ্চ শিক্ষিত নারী। সপ্তম সন্তান ডা. মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন চট্টগ্রামের সংক্রামক ও বক্ষ্যব্যাধি হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি অনার্স ও এমএসসি পাশ অষ্টম সন্তান মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ পটিয়া সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। চুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের পেট্রোলিয়াম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন নবম সন্তান ড. আবু সাহাদাৎ মুহাম্মদ সায়েম। দশম সন্তান ইংরেজীতে এমএ উত্তীর্ণ রোজিনা আকতার নগরের হোসাইন আহমদ সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সিনিয়র শিক্ষক। সর্বশেষ ১১তম সন্তান ডা. মোহাম্মদ ওমর কাইয়ুম এমবিবিএস পাশ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আইইডিসিআরের সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার এন্ড রেসিডেন্ট এ্যাডভাইজার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তাঁর সন্তানরা মনে করছেন তিনি জাতীয় পর্যায়ে জয়িতা পুরস্কার পাওয়ার মতো একজন সফল মা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম হ ম মদ কর ছ ন অন র স সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ওয়ারেন বাফেটের বেড়ে ওঠা, জীবন, বিয়ে ও বিনিয়োগের যত কাহিনি
আগামী ৩০ আগস্ট তাঁর বয়স হবে ৯৪ বছর। এখনো খেতে পছন্দ করেন চিজ বার্গার আর চেরি কোকাকোলা। চুটিয়ে কন্ট্রাক্ট ব্রিজ খেলেন। ‘ব্রেকিং ব্যাড’ ওয়েব সিরিজের দারুণ ভক্ত। ৬৫ বছর ধরে একটি বাসাতেই থাকেন। লেনদেন করেন নগদ অর্থে। আর যা আয় করেন, বিলিয়ে দেন তার প্রায় সবটাই।
বলছি ওয়ারেন বাফেটের কথা, বিশ্বের সেরা বিনিয়োগকারী। তিনি এমন এক মানুষ, যাঁর কোনো শত্রু নেই বললেই চলে। নামটা যেন কেবলই ভালো লাগা আর শ্রদ্ধার। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১১ সালে তাঁর গলায় প্রেসিডেনশিয়াল গোল্ড মেডেল পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ওয়ারেন বাফেট কেবল একজন শীর্ষ ধনীই নন, একই সঙ্গে অন্যতম শ্রদ্ধেয় ও ভালোবাসার মানুষ।’ ভালোবেসে তাঁকে ডাকা হয় ‘ওমাহার জাদুকর’।
ওয়ারেন বাফেট এখন বিশ্বের ষষ্ঠ শীর্ষ ধনী, বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আবার কেউ কেউ বলেন, বাফেট যত ভালো বিনিয়োগকারী, তার চেয়েও ভালো ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপক। বাফেট যেখানে বিনিয়োগ করেন আর যেভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালান, সেটাকেই আদর্শ মানা হয়। আসলে বিনিয়োগকারী হিসেবে তিনি কিংবদন্তিতুল্য আর ব্যবস্থাপক হিসেবে প্রথম শ্রেণির। ফোর্বস পত্রিকার ২০২৪ তালিকা অনুযায়ী বাফেটের সম্পদের পরিমাণ এখন ১৩৩ বিলিয়ন ডলার বা ১৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেট কত জানেন তো? ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
ওয়ারেন বাফেটের আরেকটি বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনহিতৈষীদের একজন। ২০০৬ সালে তিনি তাঁর সম্পদের ৯৯ শতাংশই দানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর এখন পর্যন্ত দান করেছেন প্রায় ৫৬ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।
যেভাবে বেড়ে ওঠাওয়ারেন বাফেটের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা অঙ্গরাজ্যের ওমাহায়, ১৯৩০ সালের ৩০ আগস্ট। হাওয়ার্ড ও লেইলা বাফেট দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। হাওয়ার্ড দম্পতি বিয়ে করেছিলেন ১৯২৫ সালে। বড় বোন ডরিসের জন্ম ১৯২৮ সালে আর ছোট বোন বার্টি ওয়ারেন বাফেটের চেয়ে তিন বছরের ছোট।
মা ও দুই বোনের সঙ্গে বাফেট