মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রকল্প তৈরির ক্ষমতার খুবই অভাব। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যে প্রকল্পগুলো আসে, সেগুলোতে অনেক সংশোধন করতে হয়। এ ছাড়া কাগজে–কলমে পরিকল্পনা করা হলেও রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কারণে অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয় না।

গতকাল সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে চতুর্থ আঞ্চলিক নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা সম্মেলনে এ কথা বলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনের শেষ দিনের সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, ‘পরিকল্পনার উদ্দেশ্যই হলো অনেক প্রকল্প থাকবে, সেখান থেকে বাছাই করে ভালো প্রকল্পটা নেব। কিন্তু আমার যদি অনেক প্রকল্প না–ই থাকে, তাহলে বাছাই করব কোথা থেকে। একটা প্রকল্প নিয়ে এসেছে, আর সেটাই যদি নিতে হয়, তাহলে তো আর বাছাই করা হলো না।’

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘কাগজে–কলমে আমরা পরিকল্পনা করি। কিন্তু সমস্যা হলো, রাজনৈতিক প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠীর কারণে অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয় না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে নদী দখল, বন উজাড়, পাহাড় কাটা বন্ধের অঙ্গীকার আদায় করার বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন বলেও জানান তিনি।

সব পরিকল্পনা মিলে একটি সার্বিক পরিকল্পনা করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব দিয়েছেন উল্লেখ করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, ‘এই যে আমাদের এত পরিকল্পনা আছে নদী, পানি, বন্যা—সবকিছুই। আমাদের আরও নগরায়ণ হতে থাকবে, শিল্পায়ন হতে থাকবে, তখন আমরা কোন পথে এগোব, সেটার একটা পূর্ণ পরিকল্পনা করা যায় কি না.

..। এটাই হলো জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা।’

সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘পরিকল্পিত বাংলাদেশের পথে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। যেগুলোকে আমরা এড়াতে পারি না। যার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বাধা হলো ব্যক্তিস্বার্থের ক্ষমতাগোষ্ঠী। এরা পরিকল্পিত বাংলাদেশ চিন্তাধারার পুরোপুরি বিরোধী। এই গোষ্ঠীগুলো এতটাই টেকসই যে রাজনীতির পালাবদলের সঙ্গে তারা টিকে থাকার রাস্তাগুলো ঠিকই খুঁজে নেয়।’

উন্নয়ন প্রকল্পের নামে রাজধানীর বাহদুর শাহ পার্কে ফুড কোর্ট স্থাপনের বিষয়টি তুলে ধরেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় বাস্তবায়নের বিষয়টিকে পরবর্তী চিন্তা হিসেবে দেখি। আমাদের সব মনোযোগ থাকে নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনায়। ভাবি, বাস্তবায়ন যেন একধরনের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া। কিন্তু বাস্তবায়নকেও নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।’

নগরায়ণ বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের (সিইউএস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নগরকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক চিন্তা করলে চলবে না। এই বিকেন্দ্রীকরণ কেবল কাঠামোগত নয়, হতে হবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে। আমরা বৈষম্য, অন্যায় ও অসম বণ্টন নিয়ে হাঁসফাঁস করছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ের অনেক প্ল্যাটফর্ম বা কাঠামো রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এর অনেকগুলোই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে বা খুব কম ব্যবহার হচ্ছে।’ এগুলোর পেছনে নীতি বা পরিকল্পনা থাকার পরও অপর্যাপ্ত বাস্তবায়নকে মূল সমস্যা মনে করেন তিনি। বলেন, ‘তবে একটা ইতিবাচক দিক হলো, এখন অন্তত আমরা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি। এটা সমাধানের পথে একটি বড় পদক্ষেপ।’

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডসের উপরাষ্ট্রদূত থিজ উডস্ট্রা। সমাপনী পর্বে সম্মেলনের মূল বিষয়গুলো তুলে ধরেন বিআইপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান। সম্মেলন শেষে পরিকল্পনা খাতে অবদানের জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মারক দেওয়া হয়।

‘ঢাকা ঘোষণা’

বাংলাদেশে ন্যায্য রূপান্তরের জন্য সম্মেলনে ১৩টি স্থানিক পরিকল্পনা তুলে ধরেন বিআইপির সহসভাপতি সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন। ‘ঢাকা ঘোষণা’ হিসেবে উপস্থাপন করা এসব পরিকল্পনা হলো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্থানিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্তি; জাতীয় স্থানিক কাঠামোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ; জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনার আহ্বান; ন্যায্য রূপান্তর নীতিমালার প্রচার; প্রকৃতি, অর্থনীতি ও সমাজের ভারসাম্য; ভূমি, পানি ও সক্রিয় বদ্বীপ ব্যবস্থাপনা; প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য অন্তর্ভুক্ত উন্নয়ন; প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি; ক্ষমতা ও সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ; সবার জন্য আবাসন; ন্যায় ও প্রমাণভিত্তিক পরিকল্পনা; স্থানিক পরিকল্পনা বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সহযোগিতা ও জ্ঞান বিনিময়।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ক ন দ র করণ র জন ত ক উপদ ষ ট প রকল প কল প ত র জন য আম দ র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে দূরদর্শী সিদ্ধান্তে

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংবিধান সংস্কার। নির্বাহী বিভাগের এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেশে কার্যত একনায়কতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি তৈরি করেছে। গত রোববার নাগরিক কোয়ালিশন নামে একটি নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবিধান সংস্কারের জন্য যে সাতটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, তা সময়োপযোগী ও বিবেচনার দাবি রাখে।

নাগরিক কোয়ালিশনের প্রস্তাবগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণ ও ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।

এই দাবি বেশ জনপ্রিয় হলেও বক্তাদের কেউ কেউ যুক্তি তুলে ধরেছেন যে শুধু মেয়াদ নির্ধারণ করলেই একনায়কতান্ত্রিক শাসন ঠেকানো যাবে না। তাঁরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত না করলে মেয়াদসীমা নির্ধারণ কোনো বাস্তব পরিবর্তন আনবে না। কারণ, পরিবারভিত্তিক ক্ষমতা হস্তান্তর এই বিধানকে অকার্যকর করে তুলতে পারে। একই পরিবারের সদস্যরা যদি পালাক্রমে ক্ষমতায় বসেন, তাহলে মেয়াদ নির্ধারণের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে এবং পুনরায় স্বৈরাচার বা একনায়কতান্ত্রিক শাসনের উত্থান হতে পারে।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করেন। এ ধরনের কেন্দ্রীকরণ রাজনৈতিক জবাবদিহি হ্রাস করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিগুলোকে দুর্বল করে তোলে। এই বাস্তবতায় সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা হ্রাস করে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। ভারত বা যুক্তরাজ্যের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রে যেভাবে রাষ্ট্রপতির ভূমিকায় ন্যূনতম স্বশাসন ও প্রতীকী ভারসাম্য রাখা হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও একটি গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন।

আলোচনায় অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ হাসিনার ‘স্বৈরতান্ত্রিক রূপান্তর’ কোনো সামরিক অভ্যুত্থান বা সংবিধানবহির্ভূত প্রক্রিয়ায় ঘটেনি; বরং বর্তমান সংবিধানই এমন এক কাঠামো তৈরি করেছে, যেখানে নির্বাহী প্রধানের ওপর অন্য কোনো বিভাগের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই কাঠামোই তাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করেছে। সেই কাঠামো ভেঙে ফেলাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।

প্রস্তাবিত সাত দফায় আরও বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, উচ্চকক্ষসহ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, নারী প্রতিনিধিত্বে সরাসরি ভোট, তত্ত্বাবধায়কধর্মী সর্বদলীয় কমিটি এবং সংবিধানের প্রস্তাবে ‘জুলাই সনদ’-এর অন্তর্ভুক্তি।

নাগরিক কোয়ালিশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো সাংবিধানিক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার বিষয়টি। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মতো তাদের পক্ষ থেকেও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে। এসব পদক্ষেপ যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোয় জবাবদিহি ফিরে আসবে এবং জনগণের আস্থা পুনর্গঠিত হবে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল শর্ত হচ্ছে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশের সংবিধান বর্তমানে একজন প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে অগাধ ক্ষমতা তুলে দিয়েছে, তা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখনই সময় সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে প্রকৃত অর্থে জনগণের মালিকানাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।

আমরা মনে করি, নাগরিক কোয়ালিশনের এই প্রস্তাবগুলো শুধু রাজনৈতিক বিতর্কের খোরাক হবে না, বরং একটি ভবিষ্যৎমুখী, গ্রহণযোগ্য এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের বাস্তব রূপরেখা তৈরি করতে সহায়ক হবে। এটি কেবল সংবিধান সংস্কারের প্রশ্ন নয়, এটি জনগণের মালিকানায় রাষ্ট্র পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আলোকপাত করেছে। প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও অঙ্গীকার অপরিহার্য। ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের পরও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছিল। এবার যেন ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তি আর না হয়।

 বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই সময়ের সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ওপর। সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সেতুবন্ধ হবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ