ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে তুরস্কের ড্রোন ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। পাকিস্তান প্রতিশোধমূলক হামলার সময় ওই ড্রোন কাজে লাগায়। বিষয়টি ভারতের সামরিক বাহিনীও স্বীকার করেছে। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্কের সামরিক উপস্থিতির বিষয়টি এখন আলোচনায়। এশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে বলে তথ্য মিলেছে।  

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তুরস্ক। বিশেষ করে দক্ষিণ ও দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছে আঙ্কারা। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে তারা এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চাচ্ছে। চীনের পরই ইসলামাবাদ এখন তুরস্কই প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ।  

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আগে আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হতো। এখন সেই সম্পর্ক প্রতিরক্ষা খাতে সহায়তার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান রূপ পাচ্ছে। যার ফলে ভারত-পাকিস্তান কৌশলগত উত্তেজনা নতুন করে বাড়িয়ে তুলছে। অস্ত্র রপ্তানিতে তুরস্কের উত্থানে এশিয়ার প্রতিরক্ষা বাজার নতুন রূপ পাচ্ছে। 

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের পর ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, সাম্প্রতিক সংঘাতে পাকিস্তান তুরস্কের তৈরি অ্যাসিসগার্ড সোঙ্গার মডেলের ড্রোন ব্যবহার করেছে। স্বয়ংক্রিয় এই চালকবিহীন যানটি গোয়েন্দা নজরদারির কাজেও ব্যবহৃত হয়।     

এছাড়া বেশ কয়েকটি অস্ত্র প্রকল্প প্রমাণ করে আঙ্কারার কৌশলগত প্রতিরক্ষা খাত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে মনুষ্যবিহীন বায়রাক্টর টিবি২ ড্রোন সিস্টেম, আতাক হেলিকপ্টার, আলতাই ট্যাংক, আঙ্কা-৩ স্টিলথ ড্রোন এবং কেএএএন স্টিলথ ফাইটার জেট।  

গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন করে যাচ্ছে তুরস্ক। তুর্কি কোম্পানি বেকার নির্মিত টিবি২ ড্রোনটি একাধিক দেশে রপ্তানি হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়েও এই ড্রোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। 

নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে সংঘাতে এই ড্রোন আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। টিবি২ ড্রোন সিরিয়া, উত্তর ইরাক ও লিবিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রেও পারদর্শিতা দেখিয়েছে।  

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এশিয়ায় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ে বৃহত্তর শক্তি অর্জন করতে চায় তুরস্ক। আর আঙ্কারার এই কাজে প্রধান সহায়ক ভূমিকায় রয়েছে পাকিস্তান।  এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে তুরস্ক প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ওপর জোর দিচ্ছে।  

এশিয়ার অস্ত্র বাজারে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে তুরস্ক তৎপর। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে তুরস্ক-পাকিস্তানের মতো অবিচল সম্পর্ক খুব কম দেশের মধ্যে দেখা যায়।  

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাতে এর প্রমাণ মিলেছে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, সংঘাতকালে করাচি বিমানবন্দরে তুর্কি বিমান বাহিনীর একটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান ও করাচি বন্দরে নোঙর করা তুর্কি অ্যাডা-ক্লাস অ্যান্টি-সাবমেরিন কর্ভেট দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সংঘাতেই প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় তুর্কি সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার হতে দেখা গেল। 

এর আগে বিমানবাহিনীর পাশাপাশি সেনা ও নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করতে পাকিস্তান বরাবরই তুরস্কের সহায়তা নিয়েছে। পাকিস্তান তুরস্কের কাছ থেকে মিলগেম নৌ কর্ভেট ও আকিনসি ড্রোনের মতো সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। এমনকি টার্কিশ অ্যারোস্পেস (টিএ) কর্মসূচিতে ইসলামাবাদের সম্ভাব্য অংশগ্রহণ নিয়েও জল্পনা চলছে, যা এই অঞ্চলের আকাশে শ্রেষ্ঠত্বের রূপরেখা পুনর্নির্ধারণ করতে পারে। 

এশিয়ার দেশগুলোকে সামরিক সরঞ্জামে লাভজনক অফার দিয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তুরস্ক। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে দেশটি মাঝারি ওজনের ট্যাংক উৎপাদনে চুক্তি করেছে। জাকার্তাকে ১০টি শক্তিশালী কাপলান ট্যাংকও উপহার দিয়েছে আঙ্কারা। 

মালদ্বীপ সম্প্রতি তুরস্কের কাছ থেকে টিবি২ যুদ্ধ ড্রোন কিনেছে, যা এই অঞ্চলে বিশেষ করে ভারতে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। নয়াদিল্লি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। 

মালদ্বীপ এই ড্রোনগুলো দেশটির জলসীমায় টহল দেওয়ার উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করেছে। দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে তুরস্কের কৌশলগত পদক্ষেপ এই অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে তুরস্ক নতুন অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিয়েছে।  

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প, বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তি মধ্য এশিয়ায়ও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। দেশগুলো তাদের নিরাপত্তা অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করতে তুরস্কের সহায়তা নিতে আগ্রহী। 

গত দশকের বেশিরভাগ সময় ধরে তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের মিতালি ক্রমবর্ধমান অস্বস্তির সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে ভারত। যৌথ সামরিক মহড়া, অস্ত্র চুক্তি থেকে শুরু করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে কাশ্মীর নিয়ে আঙ্কারা অবিরাম বক্তব্য তুলে ধরেছে। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক রাজনীতিতে তুরস্ক নিজ উপস্থিতি বাড়ানোর প্রচেষ্টায় রত। 

দিল্লির ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের একজন গবেষক সৈয়দ ইসার মেহেদী বলেন, ইসলামাবাদ সীমান্ত প্রতিরক্ষা জোরদার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ছোট ড্রোনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের উন্নত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছে। ইসলামাবাদ তার সামরিক খাতকে বৈচিত্র্যময় করতে তুরস্কের উন্নত ড্রোন প্রযুক্তি ঝুঁকেছে।    

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ডেপুটি ডিরেক্টর কবির তানেজা মনে করেন, এরদোয়ানের আমলে পাকিস্তানের প্রতি তুরস্কের সমর্থন ভারতীয় কূটনীতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

সূত্র : দ্য ডিপলোম্যাট, ইউরেশিয়া রিভিউ। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ত রস ক ত রস ক র স ইসল ম ব দ উপস থ ত র জন ত ব যবহ

এছাড়াও পড়ুন:

বন্দর পরিচালনা বিদেশিদের দেওয়া কতটা যৌক্তিক

চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় ও লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। সেটা ২০২৩ সালের মার্চে। বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা সে সময়ই এর বিরোধিতা করেছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ আমলের সেই সিদ্ধান্তই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার ভার দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)।

সবকিছু পরিকল্পনামতো এগোলে দর-কষাকষি করে নভেম্বরে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে কনসেশন চুক্তি হবে। চুক্তির পর টার্মিনালটি পুরোপুরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যাবে। তারা কনটেইনার ওঠানামার মাশুল আদায় করবে, লোকবল নিয়োগ দেবে এবং বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থ প্রদান করবে।

বন্দরসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এটাকে দেশের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করছেন। তাঁদের বক্তব্য হলো টার্মিনালটিতে দেশের টাকায় জেটি নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর অত্যাধুনিক ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’ থেকে শুরু করে কনটেইনার স্থানান্তরে যত ধরনের যন্ত্র দরকার, তার সবই আছে টার্মিনালটিতে। বন্দর কর্তৃপক্ষ দরপত্রের মাধ্যমে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে টার্মিনাল পরিচালনা করছে। এখানে এক হাজারের মতো শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছেন।

চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি কনটেইনার টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিউমুরিং টার্মিনাল, যেখানে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও একটি অভ্যন্তরীণ নৌপথের ছোট জাহাজ ভেড়ানো যায়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যত কনটেইনার ওঠানামা করা হয়, তার ৪৪ শতাংশই হয় এই টার্মিনালের মাধ্যমে, বন্দরের সবচেয়ে বেশি আয়ও হয় এই টার্মিনাল থেকে।

১৭ বছর ধরে এ রকম লাভজনকভাবে চলতে থাকা একটি টার্মিনাল কেন বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দিতে হবে, তা স্পষ্ট নয়। অনেকে দক্ষতা ও আধুনিক প্রযুক্তির কথা বলছেন। কিন্তু টার্মিনালে ইতিমধ্যে সব প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, যা ব্যবহার করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান দক্ষতার সঙ্গে কনটেইনার ওঠানামা করছে। এই বিদেশি বিনিয়োগের ফলে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে উল্টো বিদ্যমান কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ ছাড়া বন্দর পরিচালনার ভার কাকে দেওয়া হবে বা না হবে, তা শুধু কারিগরি ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না। একটি দেশের বন্দর হলো কৌশলগত সম্পদ, যার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে। যে ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার ভার তুলে দিতে যাচ্ছে, জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় সেই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র টার্মিনাল পরিচালনার সুযোগ দেয়নি।

আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই কোম্পানি ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনা পিঅ্যান্ডও নামের একটা ব্রিটিশ কোম্পানির কাছ থেকে অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে—এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ফলে ডিপি ওয়ার্ল্ড ওই বন্দরগুলোর পরিচালনার ভার ‘পোর্ট আমেরিকা’ নামের সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি মার্কিন কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, যেটি আজকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল অপারেটর।

নির্বাচনের আগে এ ধরনের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বন্দর পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি থাকলে সরকার বরং সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দিকে গুরুত্ব দিতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হলো জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পাশাপাশি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা।

২০১৮ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কসকো শিপিং যখন হংকংভিত্তিক ওরিয়েন্ট ওভারসিজ লিমিটেড অধিগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের শর্তের কারণে ওরিয়েন্ট ওভারসিজ তাদের মালিকানাধীন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচ কনটেইনার টার্মিনাল তৃতীয় পক্ষের কাছে করতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ কনটেইনার টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ যেন চীনের হাতে না যায়, সে জন্যই এই শর্ত।

দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে বন্দরের ব্যবস্থাপনা ও কর্তৃত্বকে আর দশটা সাধারণ বিনিয়োগের মতো দেখা হয় না। বিদেশি কোম্পানির মালিকানা নানা কারণে পরিবর্তন হতে পারে। মালিকানা পরিবর্তন হলে বন্দর পরিচালনার কর্তৃত্ব কার হাতে গিয়ে পড়ে, তা নিয়েও ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যেভাবে মালিকানা পরিবর্তন প্রভাবিত করতে পারে, অন্য দেশের পক্ষে তা সম্ভব না-ও হতে পারে। বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও বিবেচনার প্রয়োজন।

এ ছাড়া বিগত সরকারের আমলে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার অভিজ্ঞতাও উৎসাহজনক নয়। দেশে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দরের একটি টার্মিনাল সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে (আরএসজিটিআই) পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০২৪ সালের জুনে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা ব্যয় করে এই টার্মিনাল তৈরি করে। কথা ছিল, ২৪ কোটি মার্কিন ডলার বা ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আগামী ২২ বছর আরএসজিটিআই টার্মিনালটি পরিচালনা করবে। বিনিময়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ রাজস্ব পাবে বছরে ৩০০ কোটি টাকা।

সম্প্রতি সমকাল–এ প্রকাশিত সংবাদ থেকে দেখা যাচ্ছে, ১০ মাসেও প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ হয়নি। ফলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলের অভাবে টার্মিনালটি পুরোদমে কার্যকর হয়নি। প্রত্যাশার মাত্র ১২ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছে এ টার্মিনাল। দৈনিক ২০ ফুট দীর্ঘ ১ হাজার ৩৬৯ কনটেইনার পরিচালনা করার সক্ষমতা থাকলেও এই টার্মিনালে হ্যান্ডলিং হচ্ছে মাত্র ১৭০-১৮০ কনটেইনার।

শুধু তা-ই নয়, পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে কনটেইনারপ্রতি আয়ও হচ্ছে তুলনামূলক কম। পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে বন্দরের কনটেইনারপ্রতি আয় হচ্ছে ১৮ ডলার, অন্যদিকে নিউমুরিং টার্মিনাল থেকে বন্দরের বিদ্যমান আয় কনটেইনারপ্রতি ৪৭ ডলার। পতেঙ্গা টার্মিনালের জন্য বন্দরের বিনিয়োগ কেবল জেটি নির্মাণে আর নিউমুরিংয়ের জন্য বিনিয়োগ জেটির পাশাপাশি যন্ত্রপাতিতেও।

নিউমুরিং টার্মিনালে যেহেতু বন্দর কর্তৃপক্ষের বিনিয়োগ পতেঙ্গা টার্মিনালের চেয়ে বেশি, তাই সেখান থেকে দর-কষাকষির মাধ্যমে আয় হয়তো পতেঙ্গার তুলনায় বেশি হবে। তারপরও সেটা বিদ্যমান আয়ের চেয়ে কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কাজেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার তুলে দিলেই যে লাভজনক হবে এবং দেশের স্বার্থ রক্ষা হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিঙ্গাপুরের বন্দর পরিচালনার সুনাম সুবিদিত। সেখানকার বন্দরগুলো পরিচালিত হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পিএসএ করপোরেশন ও জুরং পোর্ট কোম্পানির মাধ্যমে। আসলে সবকিছু নির্ভর করে মূলত রাষ্ট্রের গভর্ন্যান্স বা তদারকির ওপর। যথাযথ তদারকি না থাকলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। আবার ঠিকঠাক তদারক করা হলে দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকেও ভালো ফল আদায় করা যায়।

চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব, ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া কতটা যৌক্তিক।

এ ছাড়া নির্বাচনের আগে এ ধরনের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বন্দর পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি থাকলে সরকার বরং সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দিকে গুরুত্ব দিতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হলো জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পাশাপাশি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা।

কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

[email protected]

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইউক্রেনের সেনা বিতাড়নের পর প্রথমবার কুরস্কে পুতিন
  • পাকিস্তানকে সমর্থন জানালো চীন
  • হুতিদের সঙ্গে যুদ্ধে আমেরিকা কেন পিছু হটল
  • চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত সিদ্ধান্তে সতর্ক হওয়া জরুরি
  • বন্দর পরিচালনা বিদেশিদের দেওয়া কতটা যৌক্তিক