ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে তুরস্কের ড্রোন ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। পাকিস্তান প্রতিশোধমূলক হামলার সময় ওই ড্রোন কাজে লাগায়। বিষয়টি ভারতের সামরিক বাহিনীও স্বীকার করেছে। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্কের সামরিক উপস্থিতির বিষয়টি এখন আলোচনায়। এশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে বলে তথ্য মিলেছে।  

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তুরস্ক। বিশেষ করে দক্ষিণ ও দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছে আঙ্কারা। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে তারা এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চাচ্ছে। চীনের পরই ইসলামাবাদ এখন তুরস্কই প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ।  

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আগে আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হতো। এখন সেই সম্পর্ক প্রতিরক্ষা খাতে সহায়তার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান রূপ পাচ্ছে। যার ফলে ভারত-পাকিস্তান কৌশলগত উত্তেজনা নতুন করে বাড়িয়ে তুলছে। অস্ত্র রপ্তানিতে তুরস্কের উত্থানে এশিয়ার প্রতিরক্ষা বাজার নতুন রূপ পাচ্ছে। 

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের পর ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, সাম্প্রতিক সংঘাতে পাকিস্তান তুরস্কের তৈরি অ্যাসিসগার্ড সোঙ্গার মডেলের ড্রোন ব্যবহার করেছে। স্বয়ংক্রিয় এই চালকবিহীন যানটি গোয়েন্দা নজরদারির কাজেও ব্যবহৃত হয়।     

এছাড়া বেশ কয়েকটি অস্ত্র প্রকল্প প্রমাণ করে আঙ্কারার কৌশলগত প্রতিরক্ষা খাত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে মনুষ্যবিহীন বায়রাক্টর টিবি২ ড্রোন সিস্টেম, আতাক হেলিকপ্টার, আলতাই ট্যাংক, আঙ্কা-৩ স্টিলথ ড্রোন এবং কেএএএন স্টিলথ ফাইটার জেট।  

গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন করে যাচ্ছে তুরস্ক। তুর্কি কোম্পানি বেকার নির্মিত টিবি২ ড্রোনটি একাধিক দেশে রপ্তানি হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়েও এই ড্রোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। 

নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে সংঘাতে এই ড্রোন আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। টিবি২ ড্রোন সিরিয়া, উত্তর ইরাক ও লিবিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রেও পারদর্শিতা দেখিয়েছে।  

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এশিয়ায় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ে বৃহত্তর শক্তি অর্জন করতে চায় তুরস্ক। আর আঙ্কারার এই কাজে প্রধান সহায়ক ভূমিকায় রয়েছে পাকিস্তান।  এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে তুরস্ক প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ওপর জোর দিচ্ছে।  

এশিয়ার অস্ত্র বাজারে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে তুরস্ক তৎপর। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে তুরস্ক-পাকিস্তানের মতো অবিচল সম্পর্ক খুব কম দেশের মধ্যে দেখা যায়।  

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাতে এর প্রমাণ মিলেছে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, সংঘাতকালে করাচি বিমানবন্দরে তুর্কি বিমান বাহিনীর একটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান ও করাচি বন্দরে নোঙর করা তুর্কি অ্যাডা-ক্লাস অ্যান্টি-সাবমেরিন কর্ভেট দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সংঘাতেই প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় তুর্কি সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার হতে দেখা গেল। 

এর আগে বিমানবাহিনীর পাশাপাশি সেনা ও নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করতে পাকিস্তান বরাবরই তুরস্কের সহায়তা নিয়েছে। পাকিস্তান তুরস্কের কাছ থেকে মিলগেম নৌ কর্ভেট ও আকিনসি ড্রোনের মতো সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। এমনকি টার্কিশ অ্যারোস্পেস (টিএ) কর্মসূচিতে ইসলামাবাদের সম্ভাব্য অংশগ্রহণ নিয়েও জল্পনা চলছে, যা এই অঞ্চলের আকাশে শ্রেষ্ঠত্বের রূপরেখা পুনর্নির্ধারণ করতে পারে। 

এশিয়ার দেশগুলোকে সামরিক সরঞ্জামে লাভজনক অফার দিয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তুরস্ক। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে দেশটি মাঝারি ওজনের ট্যাংক উৎপাদনে চুক্তি করেছে। জাকার্তাকে ১০টি শক্তিশালী কাপলান ট্যাংকও উপহার দিয়েছে আঙ্কারা। 

মালদ্বীপ সম্প্রতি তুরস্কের কাছ থেকে টিবি২ যুদ্ধ ড্রোন কিনেছে, যা এই অঞ্চলে বিশেষ করে ভারতে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। নয়াদিল্লি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। 

মালদ্বীপ এই ড্রোনগুলো দেশটির জলসীমায় টহল দেওয়ার উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করেছে। দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে তুরস্কের কৌশলগত পদক্ষেপ এই অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে তুরস্ক নতুন অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিয়েছে।  

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প, বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তি মধ্য এশিয়ায়ও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। দেশগুলো তাদের নিরাপত্তা অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করতে তুরস্কের সহায়তা নিতে আগ্রহী। 

গত দশকের বেশিরভাগ সময় ধরে তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের মিতালি ক্রমবর্ধমান অস্বস্তির সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে ভারত। যৌথ সামরিক মহড়া, অস্ত্র চুক্তি থেকে শুরু করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে কাশ্মীর নিয়ে আঙ্কারা অবিরাম বক্তব্য তুলে ধরেছে। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক রাজনীতিতে তুরস্ক নিজ উপস্থিতি বাড়ানোর প্রচেষ্টায় রত। 

দিল্লির ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের একজন গবেষক সৈয়দ ইসার মেহেদী বলেন, ইসলামাবাদ সীমান্ত প্রতিরক্ষা জোরদার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ছোট ড্রোনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের উন্নত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছে। ইসলামাবাদ তার সামরিক খাতকে বৈচিত্র্যময় করতে তুরস্কের উন্নত ড্রোন প্রযুক্তি ঝুঁকেছে।    

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ডেপুটি ডিরেক্টর কবির তানেজা মনে করেন, এরদোয়ানের আমলে পাকিস্তানের প্রতি তুরস্কের সমর্থন ভারতীয় কূটনীতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

সূত্র : দ্য ডিপলোম্যাট, ইউরেশিয়া রিভিউ। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ত রস ক ত রস ক র স ইসল ম ব দ উপস থ ত র জন ত ব যবহ

এছাড়াও পড়ুন:

কলকাতায় সম্মিলিত সেনা সম্মেলনের উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী মোদির

কলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৬তম সম্মিলিত সেনা সম্মেলন (সিসিসি) উদ্বোধন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেনা সম্মেলন একটি দ্বিবার্ষিক প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত শীর্ষস্তরীয় মতবিনিময়ের আসর।

অপারেশন সিঁদুরে’র পর এটিই প্রথম সম্মিলিত সেনা সম্মেলন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও এই বৈঠকে যোগ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, তিন বাহিনীর প্রধান জেনারেল অনিল চৌহান, প্রতিরক্ষা সচিব রাজেশ কুমার সিং এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানও।

আরো পড়ুন:

অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি নরম হওয়ার দিন শেষ: ট্রাম্প

আসামে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, ৫ বাংলাদেশি ছাত্রকে বহিষ্কার

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দপ্তর কলকাতার বিজয় দুর্গে তথা ফোর্ট উইলিয়ামে আগামী তিনদিন এই সম্মিলিত সেনা সম্মেলন চলবে। 

এই সম্মেলন সেনার তিন বাহিনীর সর্বোচ্চ চিন্তাভাবনামূলক ফোরাম, যা দেশের শীর্ষ অসামরিক ও সামরিক নেতৃত্বকে ধারণাগত ও কৌশলগত স্তরে মতামত বিনিময়ের জন্য আয়োজন করা হয়েছে ৷ কলকাতার আগে সর্বশেষ সম্মিলিত সেনা সম্মলেন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৩ সালে ভোপালে। অপারেশন সিঁদুরের প্রেক্ষাপটে, এই বছরের সম্মেলন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এবারের সম্মেলনে সংস্কার, রূপান্তর, পরিবর্তন এবং অপারেশনাল প্রস্তুতির উপর জোর দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের  বিবৃতি অনুযায়ী, ‘সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দু সশস্ত্র বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, সংহতিকরণ এবং প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণে বিশেষ জোর দেওয়া। একই সঙ্গে শীর্ষস্তরের একাধিক ক্ষেত্রে অপারেশনাল প্রস্তুতির উপরও জোর দেওয়া হবে। তিনদিনের এই সম্মেলন সশস্ত্র বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হবে, যাতে ক্রমবর্ধমান জটিল ভূ-কৌশলগত পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়।’

রবিবার আসাম সফর সেরে নির্ধারিত সময়ের থেকে বেশ কিছুটা পর দমদম বিমানবন্দরে নামেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষা এবং উত্তর-পূর্ব উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। দলীয় কোনো কর্মসূচি না থাকলেও মোদিকে দেখতে ভিড় ছিল বিজেপি সমর্থকদের। ভিড় দেখে গাড়ি থামিয়ে হাত নেড়ে জনসংযোগ সারেন মোদি। সেখান থেকে তার ২৪ গাড়ির কনভয় পৌঁছায় রাজভবনে। সেখানেই রাত্রিবাস করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংও। তিনি রাত কাটান ফোর্ট উইলিয়ামে।

চলতি বছরে এই নিয়ে চতুর্থবার পশ্চিমবঙ্গে এলেন নরেন্দ্র মোদি। সকাল ৯ টাতেই রাজভবন থেকে ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে রওনা দেন প্রধানমন্ত্রী। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়ামে ছিলেন মোদি। দেড়টার পরে কলকাতা থেকে বিহারের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি।

একদিকে বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। অন্যদিকে অস্থির চিন সীমান্ত। তার মধ্যে আবার নেপালে পালাবদল। দিনকয়েক আগে বাংলাদেশের উত্তরে চিন বিমানঘাঁটি তৈরি করতে চলেছে বলে একটি খবর ছড়ায়। ঘাঁটিটি নাকি আবার তৈরি হবে চিকেনস নেকের কাছেই। সবমিলিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিরাট এক জটিল সমীকরণ তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় কলকাতার বিজয় দুর্গে সেনা সম্মেলনের আয়োজন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবাহী বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কারও ওপর আক্রমণ হলে যৌথভাবে জবাব দেবে পাকিস্তান ও সৌদি আরব
  • বাংলাদেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎমুখী সম্পর্ক চায় ভারত: প্রণয় ভার্মা
  • কলকাতায় সম্মিলিত সেনা সম্মেলনের উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী মোদির