ক্লাব বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই হোঁচট খেল রিয়াল মাদ্রিদ। সৌদি প্রো লিগের দল আল-হিলালের বিপক্ষে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ার সুযোগ থাকলেও ফেদেরিকো ভালভের্দের পেনাল্টি মিসে শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে স্প্যানিশ জায়ান্টদের।

যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামির হার্ড রক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ম্যাচটি। অনেকেই আল-হিলালকে আন্ডারডগ ভাবলেও মাঠে তারা প্রমাণ করেছে নিজেদের শক্তি। রিয়ালকে তারা যে সহজে জিততে দেবে না, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছে ম্যাচজুড়ে। কোচ হিসেবে অভিষেক ম্যাচেই জয় না পাওয়ায় হতাশ হতে হয়েছে জাভি আলোনসোকে।

খেলার শুরু থেকেই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে ম্যাচ জমে ওঠে। ম্যাচের ৩৪ মিনিটে গোল করে রিয়ালকে এগিয়ে দেন রদ্রিগো। তবে ৭ মিনিট পরই পেনাল্টি থেকে গোল করে সমতা ফেরায় আল-হিলাল। শেষ দিকে জয়ের সুবর্ণ সুযোগ আসে রিয়ালের সামনে। ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে পেনাল্টি পায় দলটি। তবে গোলরক্ষক ইয়াসিন বুনুর অসাধারণ সেভে ফেদেরিকো ভালভের্দের শট ব্যর্থ হয়। তার এই দারুণ প্রতিরোধেই এক পয়েন্ট নিশ্চিত করে আল-হিলাল।

এই ড্রয়ের ফলে ক্লাব বিশ্বকাপের গ্রুপ 'এইচ'-এ দুই দলই ১ পয়েন্ট করে অর্জন করেছে। ২০২২ সালে ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে আল-হিলালকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল রিয়াল। তবে এবার সেই হিলালই রুখে দিল ইউরোপিয়ান শক্তিকে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ল ব ব শ বক প আল হ ল ল

এছাড়াও পড়ুন:

ডিলা রোচি চিকো সাহেবের ভূত

প্লিজ ওপেন দ্য গেট। আই অ্যাম চিকো, ডিলা রোচি চিকো। ইঞ্জিনিয়ার চিকো। স্টিল আই হ্যাভ সাম ওয়ার্ক টু ডু...। কিন্তু মোয়াজ্জেক কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অপারগ, জেলখানার শিকসদৃশ মোটা রডওয়ালা মরিচাজীর্ণ বিশাল ফটকের ভেতরে দাঁড়িয়ে দাগি আসামির মুদ্রায় চিকো সাহেবকে প্রতিদিনই ফিরিয়ে দেয় মোয়াজ্জেক—এই মিল তো কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। আর কোনো দিন মিলের কলের চাকা ঘুরবে না। ওই যে দেখছেন না, আকাশছোঁয়া চোঙাটা মাজা ভেঙে পড়ে আছে; চোঙার ভাঙা বুক থেকে বেরিয়ে হাজার হাজার বাদুড় নদী পার হয়ে মেন্টাল হাসপাতালের দিকে উড়ে যাচ্ছে অন্ধকারের ভেতর। বাদুড়গুলোও আপনার মতো পাগল, দিশাহীন। আপনি ফরাসি দেশে ফিরে যান সাহেব। আর কোনো দিন এ মিলের চোঙা দিয়ে ধোঁয়া উড়বে না। আপনার মা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মচঞ্চলতায় একসময় মুখর সাহেবি ভারতের বিখ্যাত বস্ত্রকল—নব্বই বিঘা জমির ওপরে খোঁড়া পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিলটি হালে মৃত, পরিত্যক্ত, জংধরা লোহার জঙ্গল। বিষাক্ত সাপ, হাড় জিরজিরে শিয়াল, ক্ষুৎকাতর বাদুড়ের নিরাপদ আশ্রয়—রিরংসা ও প্রজননপয়োধি। লাল ইটের দেয়াল ফুঁড়ে বট-অশ্বত্থ, পরজীবী উদ্ভিদের আতঙ্কিত প্রাণ—কেননা সংস্কার আর পরিচ্ছন্নতার অজুহাতে প্রথম রক্তাহত হতে হয় তাদেরই। জরাজীর্ণ মিল–দালানের শরীরে তারা সবুজ, কচি প্রাণ—পৃথিবীর প্রয়োজনে সামান্যতর, যদিও তবু কিছু সুস্থ, বিমল অক্সিজেন!

কর্মচারীদের মুখর কোলাহল অস্ত কবেই, কবেই তাদের পা বিচিত্র জীবিকার ক্লেদজ পথে ডুবেছে সময়ের চাবুকে চাবুকে। রিকশার প্যাডেলে জীবন, কেউ বড়বাজারে কুলি, কারও পিঠে আইসক্রিমের বাক্স, নিরুপায় জনেদের শেষতম পথ—ভিক্ষা। শ্রমিক আন্দোলনের ইশতেহার আর স্লোগান সব মিল–দালানের দেয়ালে এখনো আবছা, যেন–বা এখনো নীরব বিপ্লবের রেখা, নিভন্ত প্রতিবাদ। ওই তো কমরেড রওশন আলীর ভরাট স্লোগান দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ক্লান্ত, ম্রিয়মাণ। হাতের পরে হাত বদলে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি এখন সরকারের করায়াত্তে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন চেয়ারগুলো তর্জনী নাড়ায়। তাদেরই নির্দেশে মিলের গেটে—‘বিনা অনুমতিতে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ’ সাইনবোর্ড ঝোলানো থাকলেও, উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই বস্ত্রকল দর্শনাকাঙ্ক্ষীদের বরাবরই ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্বে অটল চল্লিশ–ছোঁয়া মোয়াজ্জেক অথবা পঞ্চাশোর্ধ্ব আসাদুল্লাহ—তারা সামান্য কর্মচারী, প্রহরী; পালাক্রমে ডিউটি—কোনো দিন রাতে মোয়াজ্জেক, তো দিনে আসাদুল্লাহ। আসাদুল্লাহর রাত হলে, দিন মোয়াজ্জেকের। একটা জীর্ণ, অশীতিপর বৃদ্ধের লাঠির মতো গৌরবহীন রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে পরিত্যক্ত, অন্ধগন্ধময় মিলের গেটে মোয়াজ্জেকদের রাত-দিন। গেটের পাশে টিনশেডের ছোট্ট প্রাচীন, স্যাঁতসেঁতে ঘরে মোয়াজ্জেক-আসাদুল্লাহর সংসার। রান্না—প্রায়ই পোড়া ভাত, আধা সেদ্ধ আলুর ভর্তা গলা দিয়ে চালান করতে করতে দুজনেরই আপন আপন স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। তারা অনুষ্ণ হৃদয়ে স্ত্রীর রসব্যঞ্জনের কথা ভেবে জিহ্বায় আনে জল; যেন তা গরল, ছ্যাপ ফেলে নিবারণ করে ক্ষুধা। কখনো বিধুর হয় হয়তো–বা শরীর, তাপাঙ্ক ঊর্ধ্বগতি পেয়ে আবার স্রোত ছাই হয়। ওদের ঘরের দরজার গা ঘেঁষে প্রাচীন এক মাধবীলতা—তার বিস্তৃত শাখা-প্রশাখা নিয়ে ঘরের চাল ছেয়ে সর্পিল রূপে আছড়ে পড়েছে মিলের বন্ধ ফটকের ওপরে। কোনো কোনো রাতে মাধবীলতা পরাক্রমী হয়ে তার গন্ধৈশ্বর্য প্রকাশপটু হলে মোয়াজ্জেক তার তেল চিটচিটে ঝুলি থেকে বাঁশি বের করে—সুর; একটা করুণ সুর রাত্রির পাঁজর বিদীর্ণ করে বহুদূর বরফসমুদ্রের দিকে তলিয়ে যাওয়া জাহাজের মতো হু হু করে ওঠে। ওদের ছুটিছাটা কম, নেই বলাটাই সমীচীন—দুটো ঈদের আগে–পরে তিন দিন, পালাক্রমে। ঈদুল ফিতর আসাদুল্লাহর হলে, মোয়াজ্জেকের ঈদুল আজহা। মোয়াজ্জেকের বিচ্ছেদি বাঁশির করুণ সুর কি হাটবোয়ালিয়ায় যায়, হয়তো যায়—পরানপুত্তলি রোজিলার বুকে গিয়ে লাগে, লাগে হয়তো। সন্তান দুটোর মুখ বুকে বেঁধে মায়াকাঁটার মতো—আহা, কত দিন দেখা হয় না চাঁদমুখগুলো। আসছে ঈদুল আজহায় হাটবোয়ালিয়া গেলে আর ফিরব না—এই সংকল্প বৃথা হতে হতে এক যুগ পার। আসাদুল্লাহ বয়সে বড়—বলে, অস্থির হও কেন মোয়াজ্জেক, বাপের তো দু কাঠা জমিও নাই যে চাকরি ছেড়ে বাড়ি গিয়ে চাষবাস করবা। চাকরির আকালে বাজারে চাকরি ছাড়বা কেন। ত্যাগ-তিতিক্ষা ছাড়া জীবন নাই। তোমার ভাবিও তো ক্যানসারের রোগী, পরান পোড়ে; বেচারির কাছে থাকতে পারলে হতো। বড় ছেলেটা উজানগাঁয়ের গরুর হাটে খাটে, মাকে নিয়ে সদরে যায়, ডাক্তারপানি করে। জানোই তো আমাদের সামান্য বেতন, পুরোটাই তো তোমার ভাবির চিকিৎসার পেছনে ঢালছি। তাও হগিলগি করে চলছি। দিন দিন মিলের ভেতরের সব যন্ত্র, লোহালক্কড় উধাও হয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। শিয়াল-সাপে ভরে যাচ্ছে। তোমার–আমার মুখে তো কুলুপ। সরকার খালি ইটের দেয়াল পাহারা দেওয়ার জন্য তো আমাদের রাখবে না।

সরকারি নির্দেশে ঘণ্টায় ঘণ্টায় মিলের গেটের সামনের ঝুলন্ত ঘণ্টা বাজাতে হবে, অবধারিত। মোয়াজ্জেকের যেদিন নৈশ দায়িত্ব—রাত বারোটার ঘণ্টা বাজিয়ে গেটের পাশের খুনখুনে চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছন্ন হলেই—প্লিজ ওপেন দ্য গেট। আই অ্যাম চিকো, ডিলা রোচি চিকো। ইঞ্জিনিয়ার চিকো। স্টিল আই হ্যাভ সাম ওয়ার্ক টু ডু...। ভুতুড়ে গলার খ্যাসখেসে ইংরেজি সংলাপ মোয়াজ্জেকের ঘুমের মসলিন উৎপাটন করে। প্রথম প্রথম খুব রাগ হতো, বিরক্ত ও বিবমিষা। এখন সাহেবের প্রতি করুণা। চাকরির এই চৌদ্দ বছর মিলের রাত বারোটার ঘণ্টা বাজানোর পরেই মাথায় বিরাট হ্যাট, কোট-টাই পরিহিত, পায়ে ফিতে বাঁধা জুতা, মুখে অপাঙ্‌ক্তেয় সজারুকাঁটাসদৃশ দাড়ির বৃদ্ধ চিকো সাহেব এসে হাজির হয় গেটের সামনে। কিন্তু যতই সে এই মিলের পুরোনো বিরাট ইঞ্জিনিয়ার হোক—মিল তো এখন পরিত্যক্ত, বন্ধ। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া সবার প্রবেশ নিষেধ। চিকো সাহেবকে ভেতরে ঢুকতে দিতে পারে না মোয়াজ্জেক, চাকরি বিপদসংকুল হবে দায়িত্বে অবহেলা ও আইন অমান্য হলে।

কিন্তু কমরেড আজহার শেখকে মিলের ভেতর থেকে বের করে দিতে পারে না মোয়াজ্জেক। প্লিজ গিভ মি ওয়ান টাকা—ঘুমবিভোর শহরের জনহীন, সারমেয়শূন্য রাস্তায় ইংরেজিতে ভিক্ষা চাইতে চাইতে কোনো ঘুমন্ত গলির ভেতরে হারিয়ে যায় চিকো সাহেব, তা অনির্ণেয়। তখন মিলের ভেতরের দিঘিমতো পুকুরপাড়ের ছাতিমগাছের ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে কমরেড আজহার শেখ গুটি গুটি পায়ে এসে মোয়াজ্জেকের পাশে পড়ে থাকা ক্ষয়িষ্ণু লোহার রেলিংয়ে বসে—চিকো সাহেবকে ফেরাও কেন প্রতিদিন, লোকটারে ঢুকতে দাও। শুনেছি লোকটা বড় কাজপাগল ছিল—অত বড় ইঞ্জিনিয়ার, শুধু কাজের নেশায় পড়ে ছিল এই মিলে। সবাই জানত লোকটা ইংরেজ। না, লোকটা আসলে ফরাসি দেশের। ব্রিটিশ–ভারতের দিল্লিতে দুই বোন, দুই ভাই থাকত। ছোট ভাই ব্রিটিশ রেলের ড্রাইভার ছিল আর চিকো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কর্মসূত্রে কলকাতা। তাকে ধরে আনল ‘আবু বকর সিদ্দিক’ কটন মিলের মালিক। চিকো সাহেবের কাজের সুনাম এই মিলে পৌঁছে গেল, বাবুরা তাকে নিয়ে এল এখানে। রাতদিন কাজ আর কাজ। সাতচল্লিশের পার্টিশনের পরেও চিকো সাহেব থেকে গেল এখানেই, দিল্লিতে ভাইবোনের সঙ্গে আর দেখা হয়নি কোনো দিন। কিন্তু পঁয়ষট্টিতে মিলের ব্যক্তিমালিকানা হাতছাড়া হলে, শত্রু সম্পত্তি গণ্য হলে বন্ধ হয়ে যায় মিলের যাবতীয় কাজ। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার—তাদের হাতের চঞ্চল আঙুলেরা অসাড় হয়ে গেল। চিকো সাহেব প্রতিদিন আসত মিলে কাজ করতে, কিন্তু ঢুকতে দেওয়া হতো না ভেতরে। তারপর দিনে দিনে পাগল হয়ে গেল লোকটা, ভিক্ষুক হয়ে গেল লোকটা—যে সময়ে পেশাদার ভিক্ষুক এক আনা ভিক্ষা চাইত, চিকো সাহেব সেখানে চাইত এক টাকা—‘প্লিজ গিভ মি এ টাকা’—কদাচিৎ বলত, ‘হেল্প মি।’ তারপর আগ্রাসী ডায়রিয়ায়, স্বজনহীন, বান্ধবহীন পাগল লোকটা সদর হাসপাতালে ধুঁকে ধুঁকে মায়া ছেড়েছিল পৃথিবীর। জাতে খ্রিষ্টান বলে মিশনারির লোকেরা শহরের খ্রিষ্টান কবরস্থানে শুইয়ে দিল তাকে, সেখানে তার নামহীন গোত্রহীন অনন্ত ঘুম।

—তাহলে প্রতিদিন যে রাত বারোটার সময় মিলের গেটে এসে কড়া নাড়ে চিকো সাহেব! মোয়াজ্জেক ছানাবড়া চোখে কমরেড আজহার শেখের দিকে তাকায়।

—ওটা চিকো সাহেবের ভূত। আমিও তো ভূত, কমরেড আজহার শেখের ভূত। তুমি তো জানো মোয়াজ্জেক।

—জানি। আপনি বিপ্লবী ভূত। শ্রমিকপক্ষের ভূত। আপনি তো আমাদের ভূত।

—মিল ব্যক্তিমালিকানা থেকে সরকারপক্ষ নিয়ে আবার চালু করলে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আমি সোচ্চার হলে, ইউনিয়নের মিটিং শেষ করে রেললাইন দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় আমাকে তুলে আনা হলো রাতের অন্ধকারে। অনেক রাত ধরে আমার সঙ্গ বাহাস হলো ওই তো পেছনের একটা গুদামঘরে, অনেক লোভ-লালসা, উচ্চপদ দেখাল। আমি বুক টান টান করে ছিলাম। তারপর এই দেখো আমার গলায় ফাঁসের দাগ এখনো আছে আর বুকের এই ফুটোটাতে চোখ রাখো, যেন দুরবিন, দিল্লি দেখা যাবে। রাতের অন্ধকারে আমাকে পুকুরপাড়ের ওই ছাতিমগাছের জঙ্গলে পুঁতে দিল। সকালে আমার নিখোঁজ সংবাদে শ্রমিকেরা মিল ঘেরাও করেও কোনো দিশা পেল না। আমি গুম হয়ে রইলাম। আমি ভূত হয়ে গেলাম। সারা রাত মিলের চারপাশে ঘুরি। কত স্মৃতি বলো, কত সংগ্রামের চিহ্ন চারপাশে, শ্রমিকদের পবিত্র ঘামের গন্ধ। মাঝেমধ্যে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে, তোমার কাছে আসি। তুমি বড় লক্ষ্মী ছেলে মোয়াজ্জেক। আমাকে কি তোমার ভয় করে?

—করত। এখন করে না। আপনি প্রথম যেদিন ছাতিমগাছের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে পেছন থেকে আমার পিঠে হাত রাখলেন। খুব ভয় পেয়েছিলাম। পরে আস্তে আস্তে ভয় কেটে গেছে। রাতের বেলা আরও আরও ভূত আসে মিলের পেছনের দরজা দিয়ে, বাইরে বড় বড় লরি রাখা থাকে। দিনে দিনে মিলের সব মেশিনপত্র ওই সব লরিতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বন্দুকওয়ালা ভূতেরা। ওদের খুব ভয় করে। আপনার মতো আমাকেও যদি গুম করে দেয়। আমি যদি ভূত হয়ে যাই। দল বেঁধে এসে আমাকে শাসিয়ে গেছে, একদম চুপ, কারও কাছে মুখ হাঁ করলে একদম ভূত বানিয়ে দেব। আমার একদম ভূত হতে ইচ্ছা করে না, জানেন!

কমরেড আজহার শেখ হাসে। হাসতে হাসতে পুকুরপাড়ে ছাতিমগাছের অন্ধকারে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মোয়াজ্জেকের আর ঘুম হয় না। সারা রাত মিলের ভেতরে লোহালক্কড় ভাঙার বিকট শব্দে তার কানের তালা ফেটে যেতে চায়। ভয়ার্ত মোয়াজ্জেক, খেলনার মতো অরব আর ক্লিশে রাইফেলে থুতনি ঠেকিয়ে গুটিয়ে বসে থাকে সকাল অবধি। সকালে আসাদুল্লাহর ঘুম ভাঙলে রাতের সব কথা গড় গড় করে ঢেলে দিলে আসাদুল্লাহ হাসে—তুমি খোয়াব দেখো প্রতিদিন মোয়াজ্জেক। আর না হলে তুমি পাগল হয়ে গেছ। না হলে তুমি ভূত হয়ে গেছ। আমি তো কোনো দিন এসব দেখি না মোয়াজ্জেক—কিসের তোমার চিকো সাহেব, কমরেড আজহার, মিলের ভেতরে লোহা ভাঙার বিকট শব্দ, ভূত—সব তোমার খোয়াব।

আবার রাত এলে, মাধবীলতার গন্ধ উন্মুখ হলে বাঁশি বাজানো থামিয়ে মোয়াজ্জেক বিষণ্ন হয়, ভাবে—সত্যিই কি সে ভূত হয়ে গেছে! কিন্তু সে তো দিব্বি রোজিলার কথা মনে করতে পারছে, সন্তানদের মুখ আঁকতে পারছে হৃদিপটে হামেশাই—যাহ্, ভূতের কি বউ থাকে, সন্তান, স্মৃতি? নিজে নিজে হাসে অথবা অসহায়, কাঁদে। না, এবার ঈদের ছুটিতে হাটবোয়ালিয়া গেলে আর ফিরব না। আমি মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে চাই। স্টেশনে বাদাম বিক্রি করব, তবু ভূত হব না। কিন্তু সে সহসা চাকরিও ছাড়তে পারে না। কেননা বন্দুকওয়ালা ভূতেদের সব কথা তার জানা। চাকরি ছেড়ে বাইরে গিয়ে সব যদি মানুষে মানুষে রটিয়ে দেয়, বন্দুকওয়ালা ভূতেরা তাই শাসনে রেখেছে তাকে।

দিনের আলোয় মোয়াজ্জেক বারবার আয়নায় নিজেকে দেখে, মুখের এলোমেলো দাড়ি রেজারে কাটে, সেলুনে গিয়ে চুল ছেঁটে আসে, সারা দিন নিজের গায়ে চিমটি কাটে—সব অনুভূতি তার সজাগ। মোবাইলে জমিলার সঙ্গে কথা বলে—এবার হাটবোয়ালিয়া এসে আর ফিরব না। আর চাকরি করব না। জমিলা অবাক হয়, গাছ থেকে পড়ে—কেন চাকরি ছাড়তে হবে? সংসার কীভাবে চলবে?

—স্টেশনে বাদাম বিক্রি করব। এখানে আর বেশি দিন থাকলে আমি ভূত হয়ে যাব। এখানে প্রচুর ভূত রোজিলা—ইংরেজ ভূত, কমরেড ভূত, বন্দুকওয়ালা ভূত। আমি বাড়ি ফিরতে চাই রোজিলা।

ভূতের ভয় দিন দিন মোয়াজ্জেককে গ্রাস করছে। নিজেকেও ক্রমেই তার ভূত মনে হতে থাকে। মাঝেমধ্যে ঘুমের ভেতরে লাফিয়ে ওঠে। যদি ঘুম থেকে জেগে কোনো দিন দেখে সে সত্যিই ভূত; শূন্যে পা। ছোটবেলায় এমন কত ভূতের গল্প শোনা মুরব্বিদের কাছে—ভূতেরা মাটিতে পা ফেলে না, মাটির একটু ওপরে শূন্যে ভাসে, খুব কৌশলী না হলে দেখা যায় না। কিন্তু মোয়াজ্জেকের কোনো কৌশল লাগে না—পরিত্যক্ত মিলের যন্ত্রপাতি লরি বোঝাই করে নিয়ে যায় প্রতি রাতে যেসব ভূত—তাদের হাতে ভয়ংকর সব আগ্নেয়াস্ত্রই শুধু থাকে না, তারা মাটিতেই হাঁটে, অবিকল মানুষের মতো। মিলের যন্ত্রাংশ লরিতে ওঠানোর ফাঁকে ফাঁকে গোল হয়ে বসে তারা মদও খায়। রাশি রাশি সিগারেটের ধোঁয়া—ভ্রম হয়, মিলের মাজা ভাঙা চোঙা দিয়ে হু হু করে ধোঁয়া উঠছে যেন!

কেবল কমরেড আজহার শেখের ভূত দেখলে নিজেকে কিছুটা মানুষ মনে হয় মোয়াজ্জেকের। আজহার শেখ বলে, তুমি বড় ভালো মানুষ মোয়াজ্জেক। নাও, এই শনপাপড়ি খাও, খুব মজা। মিলের অফিসারদের জন্য স্পেশালি এই শনপাপড়ি বানানো হতো। আমার বুকটা যেদিন ফুটো করে দেওয়া হয়, তার আগে অফিসার আমাকে এই শনপাপড়ি খেতে দিয়েছিল। না খেয়ে পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। তোমার জন্যই রেখে দিয়েছিলাম মনে হয় এত দিন।

সেই শনপাপড়ি হাতে নিয়ে মোয়াজ্জেকও পকেটে রেখে দেয়, বলে, পরে খাব। কিন্তু পরে আর খায় না। ভূতের দেওয়া শনপাপড়ি খেয়ে যদি সত্যিই ভূত হয়ে যায়!

মাঝেমধ্যে অশীতিপর রাইফেলে থুতনি ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়া মোয়াজ্জেক হঠাৎ ঘুমের আঠা থেকে চোখ অবমুক্ত করে দেখে পাশের ক্ষয়িষ্ণু লোহার রেলিংয়ে নিবিষ্ট পাঠক কমরেড আজহার শেখ পত্রিকা পড়ছে। পত্রিকা থেকে মাথা তুলে মোয়াজ্জেককে বলে, খবর আছে, খবর। দেখো সরকার নাকি আবার মিল চালু করবে, আমূল সংস্কার করে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে মিল চালু করবে।

—তাহলে আমাদের তো বেতন বাড়বে?

—বাড়তেও পারে, আবার তোমার চাকরি না–ও থাকতে পারে।

—কী বলেন এসব, আপনি দেখছি সত্যি সত্যি ভূত!

—কাল সকালে মন্ত্রণালয়, প্রশাসনের লোক আসবে পরিদর্শনে। তারপর বাজেট। সংস্কার। পুরোনো, জীর্ণ মিল–দালান ভেঙে নতুন দালান উঠবে। অত্যাধুনিক যন্ত্র আসবে বিদেশ থেকে। সংস্কারের কোপে পুকুরপাড়ের ছাতিমগাছটা নিশ্চয় উধাও হয়ে যাবে, কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে যাবে আমার ঘুম। আমি আর জাগব না মোয়াজ্জেক। কিন্তু আমাকে যে জাগতে হবে।

—আপনি তো সত্যিকারের ভূত, কমরেড ভূত। আপনাকে কেউ চিরদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারবে না।

সকালে আসাদুল্লাহ শশব্যস্ত—মোয়াজ্জেক, সারা রাত জেগেছ ঠিকই; কিন্তু আজ দিনের ঘুমটাকে কুরবানি করা লাগবে। মন্ত্রণালয়ের স্যাররা আসবে, ডিসি সাহেব, এমপি সাহেব আসবে।

—কী দেখতে আসবে। ভেতরে কিছু আছে?

—চুপ, একদম কথা বলবে না। তুমি তো সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছ। ভূত হয়ে গেছ। মিল চালু হবে নতুন করে। স্যারদের সামনে ভালো ব্যবহার করবে। পাগলামো কোরো না। বড় পোস্ট পেতে পারো।

বেলা সাড়ে এগারোটার শীতরোদ মাধবীলতার গা চুইয়ে চেয়ারে বসে থাকা সারা রাতের ঘুমক্লান্ত মোয়াজ্জেকের শরীরে গলে পড়ছে। আসাদুল্লাহ ব্যস্ত। সারি সারি গাড়িবহরের শব্দ এগিয়ে আসছে মিলের বন্ধ দরজার দিকে—কতকাল পরে আজ খোলা হবে এই বন্ধ দরজা। দরজার দিকে তাকিয়ে চিকো সাহেবের কথা মনে পড়ে। চিকো সাহেব কি সত্যিই ভূত! কোনো দিন দিনের বেলা আসে না, মাঝরাতে, যখন রাত বারোটার ঘণ্টা বাজে চিকো সাহেব হাজির। কোথা থেকে আসে প্রতিদিন। চিকো সাহেবের পা কি মাটিতে থাকে, না শূন্যে। এবার রাতে এলে দেখে নিতে হবে। যেসব ভূতের পা মাটিতে থাকে, তারা নকল ভূত—ছোটবেলা থেকে তা–ই তো জানে, আসল ভূতের পা শূন্যে থাকে। রাতের বেলা মিলের পেছনের দরজা দিয়ে যেসব ভূত আসে, তাদের তো পা মাটিতেই থাকে। তাহলে তারা নকল ভূত—মোয়াজ্জেক মনে মনে ভাবে।

আসাদুল্লাহ আর মোয়াজ্জেক বিরাট ওজনদার লোহার গেটটা দুই পাশ ধরে টেনে খুলতে থাকে আর গাড়িবহর থেকে একে একে অ্যাকশন সিনেমার অভিনেতাদের মতো নামতে থাকে মন্ত্রণালয়ের স্যাররা, ডিসি, এমপি ও এমপির অনুগত ভয়ংকরেরা। তাদের একজনকে দেখে মোয়াজ্জেক ঠিক চিনতে পারে—এ তো রাতের বন্দুকওয়ালা ভূতেদের নেতা। মাটিতে পা। দরজার কাছে এগিয়ে আসতেই মোয়াজ্জেকের চোখের দিকে তাকিয়ে ভূতের নেতা ইশারায় ধমকে দেয়—যেন কোনো রা না করে। সঙ্গে টেলিভিশন ও পত্রিকার অনেক সাংবাদিক, কিছু রটে গেলে কেল্লাফতে হয়ে যাবে।

পরিত্যক্ত মিলের চারপাশ জঙ্গলবিধৃত, কাঁটাগুল্মে আচ্ছাদিত—সেখানে প্রভূত বিষাক্ত কীট ও রাসেলস ভাইপার, ক্ষুধার্ত শিয়াল, তাই চারদিকে ঘুরে দেখার সুযোগ নেই পরিদর্শক দলের। বরং মিলের প্রধান কক্ষের জংধরা বিরাট তালাটা মোয়াজ্জেক খুলে দিলে কয়েক শ বাদুড় বল্লমের গতিতে বের হয়ে আসে, ভয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়ে পরিদর্শক দল। উঠে দাঁড়িয়ে বুকে থুথু দিতে দিতে এমপি সাহেব মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বলে, ভয় পাবেন না প্লিজ; পরিত্যক্ত জায়গা। জন্তু–জানোয়ারে ভরা। নতুন ভবনের টেন্ডারটা আমার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিলে দেখবেন, কত দ্রুত এসব জন্তু–জানোয়ার দূর হয়ে যায়। নতুন ভবন ওঠে। দেশের অন্যতম প্রধান কলকারখানা হবে এটি। কী ঐতিহাসিক বস্ত্রকল এটি, ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় বস্ত্রকল কেমন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এখানকার উৎপাদিত সুতা চলে যেত ইউরোপে, ভাবা যায়! এই যে শত শত তাঁতযন্ত্র, সেই ইংল্যান্ড থেকে আনা—দেখেন আমাদের ঐতিহ্য, মুখ থুবড়ে আছে। এই সাংবাদিক ভাইয়েরা, ছবি তোলেন।

কোথায় শত শত ঐতিহ্যবাহী তাঁতযন্ত্র, মোয়াজ্জেক তো মোটে দু–তিনটি তাঁতযন্ত্র দেখতে পাচ্ছে, সেগুলোও বিধ্বস্ত, নানা অংশ উধাও। সেই ফাঁকা বিশাল মিলঘরের ছবি তুলল সাংবাদিকেরা ক্লিক ক্লিক করে। পরের দিন পত্রিকায় ছাপা হলো সেসব ছবি। পত্রিকার ছবিতে মিলঘর ভরা পরিত্যক্ত জীর্ণ তাঁতযন্ত্রে। রাতে ছাতিমগাছের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে কমরেড আজহার শেখের ভূত বুকের ফুটোর ভেতর থেকে পত্রিকাটা টেনে বের করে মোয়াজ্জেককে দেখায়—দেখো মোয়াজ্জেক।

—তা খালি ঘরে ওরা এত মেশিন পেল কোথায়? ছবি তো আমার সামনেই তুলল।

—তুমি তো খোকা। পড়াশোনা করার সুযোগ পাওনি মোয়াজ্জেক। ক্ষমতার পৃথিবী কত দূর চলে গেছে, তোমার মতো মানুষেরা জানেই না। কম্পিউটার, ফটোশপ, এআই...শুনেছ এই সব!

—কম্পিউটার তো দেখি। এআই টেআই দেখিনি।

—ওসব দেখা যায় না। সৎ যুক্তিকে ঢেকে ফেলার প্রযুক্তি ওসব।

পত্রিকায় খবর এসেছে, কিছুদিনের মধ্যেই পুরোনো মিলঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে নতুন দালান করার কাজ শুরু হবে। স্থানীয় এমপির ঠিকাদার কোম্পানিকে টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। চাকরিটা হয়তো থাকবে না মোয়াজ্জেকের। মোয়াজ্জেক তো ছুটিই চেয়েছিল এত দিন। হাটবোয়ালিয়ায় ফিরে যাবে। আলমডাঙা স্টেশনে বাদাম বিক্রি করবে। রোজিলার সঙ্গে নুনভাতের জীবন কাটাবে। সন্তান দুটোকে নিয়ে বন্ডবিলের মেলায় যাবে, বেলুন কিনে দেবে। কিন্তু এত দিনের কর্মক্ষেত্র এই ঐতিহ্যবাহী পরিত্যক্ত বস্ত্রকলের মায়ায় পড়ে গেছে। তবু এত দিন পরে তার হাটবোয়ালিয়ায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ হবে চাকরিটা হারিয়ে। তাতে তার মন খুশিই।

কিন্তু আসাদুল্লাহ তাকে মনে করিয়ে দেয়—তুমি তো ভূত হয়ে গেছ। এ অবস্থায় তুমি কীভাবে সংসারে ফিরে যাবে। ভূত হয়ে গেলে কেউ সংসারে ফিরে যেতে পারে? আমিও তো পারছি না। তোমার ভাবি ক্যানসারের রোগী, তার পাশে থাকা দরকার। যেতে পারছি না।

—আপনিও কি ভূত হয়ে গেছেন?

ভূতেদের ভেতরে থাকলে ভূত হবে না...বলতে বলতে আসাদুল্লাহ আস্তে আস্তে তার জামার বোতাম খুলে বুকটা উদোম করে। ঠিক হৃৎপিণ্ড বরাবর একটা ফুটো। সেই ফুটোর ভেতর থেকে একটা শনপাপড়ি বের করে অর্ধেকটা ভেঙে মোয়াজ্জেকের হাতে দিয়ে বলে, খাও, ভয় নেই। তুমিও ভূত, আমিও ভূত। তোমার বুকেও দেখো ফুটো আছে। আমাদের মতো মানুষদের ভূত হয়ে বাঁচতে হয়। আমরা জানিও না কখন আমরা ভূত হয়ে যাই।

—আপনি কবে ভূত হলেন, আমাকে বলেননি তো।

—কেন, তোমার মনে নেই, বন্দুকওয়ালা ভূতেদের কথা আমি প্রথম যেদিন সাংবাদিকদের বলে দিই, ওই দিন রাতেই ভূতেদের নেতা আমার বুকের ওপর এই শনপাপড়ি রেখে গিয়েছিল। গরম বারুদের শনপাপড়ি। বুকটা ফুটো করে ভেতরে ঢুকে আছে সেই থেকে। তুমিও তো সেই একই ভুল করেছিলে। কতবার নিষেধ করেছিলাম—রাতের অন্ধকারে এখানে যা দেখবে দিনের বেলায় আলাপ করবে না। তুমি তো ফেরেশতা হতে চেয়েছিলে।

রাত বারোটার ঘণ্টা বাজাল মোয়াজ্জেক। বেশ কয়েক দিন হলো চিকো সাহেবের ভূত আসে না। কয়েক দিন ধরে কমরেড আজহার শেখের ভূত ছাতিমগাছের অন্ধকার থেকে উঠে এসে তার পাশে ভাঙা লোহার রেলিংয়ে বসে না। মাধবীলতার গন্ধের মধ্যে সে একা ভাসছে। তার কি রোজিলার কথা মনে পড়ছে—তেল চিটচিটে ঝোলা থেকে সে কি বাঁশি বের করে এখন বিধুর সুরে ভাসিয়ে দেবে রাতের পৃথিবী? বরং আস্তে আস্তে বুকের বোতাম খোলে মোয়াজ্জেক, এত দিন নিজের শরীরটাই দেখা হয়নি ভালো করে। সত্যিই তো হৃৎপিণ্ড বরাবর ফুটো! ফুটোর ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে একটা শনপাপড়ি বের করে আনে। মুখে দেবে খাওয়ার জন্য—তখন স্পষ্ট শুনতে পায় মিলঘরের ভেতরে তাঁত চলার শব্দ। এত দিন তো মেশিনগুলো ভাঙা আর ভূতেদের হল্লা শুনেছে। এগিয়ে গিয়ে মিলঘরের দরজা খোলে মোয়াজ্জেক। মিলঘরের গুমোট অন্ধকারের এক কোণে চালের ভাঙা অংশ দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে পরিত্যক্ত একটি তাঁতযন্ত্রের ওপরে। সেই আলোতে কোট-টাই পরা মাথায় হ্যাটওয়ালা চিকো সাহেব নিবিড় মনে তাঁতযন্ত্র নিয়ে কী যেন গভীর গবেষণা করছে, পাশের আরও বিধ্বস্ত একটি তাঁতযন্ত্র চালাচ্ছে কমরেড আজহার শেখ। তাঁতযন্ত্র থেকে রঙিন সুতা বের হয়ে মিলঘরের টিনের চাল ফুটো করে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে...কী বাহারি রং সেসব সুতার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ