মিয়াজাকি–আমেরিকান বিউটিসহ শখের বাগানটিতে আছে ৫০ জাতের আম
Published: 24th, June 2025 GMT
বাগানে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি আমগাছ। প্রতিটি ডালে ঝুলছে বাহারি আম। কোনোটি গাঢ় লাল, যেন পাকা কাশ্মীরি আপেল। কোনোটার ওপরে হালকা লাল, নিচে সবুজ। কোনোটি আবার ম্লান হলুদ, চোখে লাগার মতো মোলায়েম। আবার কোনোটি বেগুনি-সবুজে ছোপ ছোপ, মনে হয় যেন হাতে আঁকা।
আমগুলো শুধু রঙেই আলাদা নয়, আকারেও বৈচিত্র্যময়। ছোট, লম্বা, মোটা, গোল কিংবা পাতলা—একেকটা একেক ঢঙের। কারও গায়ে চকচকে পলিশ, কারও গায়ে রুক্ষতা। আমের স্বাদেও রয়েছে ভিন্নতা। এই দৃশ্য নড়াইল শহর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার মুলিয়া ইউনিয়নের বনগ্রামের ‘মাহিন কানন-২’ নামের এক বাগানের।
থাইল্যান্ডের চিয়াংমাই জাতের আম দেখাচ্ছেন শৌখিন ফলচাষি জাহাঙ্গীর কবির.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কেন বই বিমুখ হচ্ছে মানুষ
রাজধানীর নিউমার্কেটের জিনাত বুক স্টোর। একসময় বইপ্রেমীদের পছন্দের এ জায়গা এখন আর নেই। সেখানে ঝাঁ–চকচকে মনোহারি দোকান। বইপ্রেমীদের আরেকটি তীর্থস্থান বেইলি রোডে নাটক সরণির সাগর পাবলিশার্স। সেটাও বন্ধ হয়েছে বছর দুই হলো। অমর একুশে বইমেলায়ও বেচাকেনা কমতির দিকে। এমন অনিশ্চয়তায় বই প্রকাশের সংখ্যাও কমিয়ে এনেছে সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনীগুলো। পাঠকখরার চিত্র পাওয়া যায় বিভিন্ন পাঠাগারেও।
বই পড়া ও প্রকাশের হালহকিকত নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সৃজনশীল ১০টি প্রকাশনীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং বিভিন্ন বয়সের ৩৫ জন পাঠকের সঙ্গে কথা বলা হয়। পর্যালোচনা করা হয় বইমেলায় গত পাঁচ বছরে বিক্রির হিসাব। তা থেকেই পাঠকের বইবিমুখ হওয়ার চিত্র পাওয়া গেছে।
প্রযুক্তির কল্যাণে পাঠের বিষয় ও ধরনে পরিবর্তন আসার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টদের অনেকে। আবার অনেকে বলছেন, এখনকার পাঠকেরা ফিকশনের বদলে নন ফিকশনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। সাহিত্যানুরাগীরা বলছেন, পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বই তুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলেও পাঠবিমুখ হচ্ছেন অনেকে। এর ফলে ভবিষ্যতে মানুষের মধ্যে অসংবেদনশীলতা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় ভুগছেন অনেকে।
বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমেছে
বাংলাদেশের পাঠক কোন ধরনের বই বেশি পছন্দ করেন, বইয়ের বাজারের হালহকিকত কেমন—এসবের একটি ধারণা পাওয়া যায় প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলায় বিক্রির হিসাব থেকে। দেশের প্রায় ৩০০ সৃজনশীল প্রকাশনীর বেশির ভাগ বই প্রকাশিত হয় এ মেলাকে ঘিরে।
যেসব দেশের পাঠকেরা বেশি বই পড়েন—সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় তলানিতে। ২০২৪ সালে সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের ১০২টি দেশের মধ্যে বই পড়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯৭তম। বাংলাদেশের মানুষ বছরে গড়ে তিনটির কম বই পড়েন।বাংলা একাডেমির প্রশাসন বিভাগের পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের বইমেলায় অংশ নিয়েছিল ৫৬০টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। মেলায় বই বিক্রি হয়েছিল ৮২ কোটি টাকার। পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ২০২৫ সালের মেলায় অংশ নেয় ৭০৩টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। বই বিক্রি হয় আনুমানিক ৪০ কোটি টাকার (বিক্রির পরিমাণ একাডেমির আনুমানিক হিসাব)। অর্থাৎ পাঁচ বছরে বইমেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশনীর সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু টাকার হিসাবে বই বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
ছোট-বড় ১০টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বিক্রি না হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা বই প্রকাশের সংখ্যা কমিয়ে এনেছেন। প্রকাশকেরা বলছেন, করোনা মহামারি ছিল বই বিক্রির জন্য বড় ধাক্কা। আবার ধীরে ধীরে বিক্রি যখন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আসছিল, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন করে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এখন তাঁরা কম বই প্রকাশ করছেন।
অনুপম প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মিলন কান্তি প্রথম আলোকে বলেন, গত দেড় বছরে তাঁদের বই প্রকাশ ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ কমাতে হয়েছে। বইকে কেন্দ্র করে পুরো দেশের নেটওয়ার্ক সংকুচিত হয়ে আসছে।
অনন্যা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মনিরুল ইসলাম বলেন, তাঁর প্রকাশনীর সৃজনশীল বই বিক্রির হার কমেছে অন্তত ৯০ শতাংশ। তিনি বলেন, মানুষ এখন প্রবন্ধ, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের বই কেনে না। কিছু বই বিক্রি হয়; যেসব গদ্যের বই, ফেসবুকে লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন, এমন সব লেখকের বই।
পড়ুয়াদের মতে, বই পড়ার ধরন যে বদলে গেছে, সেটা অস্বীকার করা হচ্ছে। এখন মুঠোফোনেও পাঠক বই পড়েন। বইয়ের বিষয়বস্তুর প্রতি আগ্রহ নিয়েও মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটছে, এটা মানতে হবে। কদর বাড়ছে ইংরেজি সাহিত্যেরও।গত দেড় থেকে দুই বছরে আগামী প্রকাশনীর বই বিক্রি কমেছে অন্তত ৭৫ শতাংশ। এর মধ্যে কোনো কোনো বই আছে যার বিক্রি একেবারেই নেই, বলছিলেন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি।
বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপংকর দাস জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমেছে ৩০ শতাংশের মতো। প্রকৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সৈকত হাবিব বলেন, ‘আসছে বইমেলায় একটি বইও প্রকাশ করতে পারব কি না, সন্দেহ আছে।’
পত্রিকার পাঠক বেশি
যেসব দেশের পাঠকেরা বেশি বই পড়েন—সে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের ২০২৪ সালের জরিপে বিশ্বের ১০২টি দেশের মধ্যে বই পড়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯৭তম। ‘কান্ট্রিস দ্যাট রিডস দি মোস্ট বুকস’ নামে প্রকাশিত এ জরিপে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বছরে গড়ে ১৭টি বই পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ। বাংলাদেশের মানুষ বছরে গড়ে ৩টির কম বই পড়েন।
দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত সরকারি-বেসরকারি ১০টি পাঠাগারে পাঠকের উপস্থিতির চিত্র থেকেও বই পড়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান খরার চিত্র উঠে এসেছে।
বই পড়তে না চাওয়ার পেছনে আগ্রহ তৈরি না হওয়ার কারণ ব্যক্তি নিজে। পরবর্তী প্রজন্মকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারছেন না অভিভাবকেরা।হরিশংকর জলদাস, কথাসাহিত্যিকরাজশাহীর জননী গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আমিনুল হক বলেন, ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ পাঠাগারে বর্তমানে ৭ হাজার বই আছে। স্থানীয় প্রান্তিক মানুষদের জন্য এ পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছিল। একদিনে সর্বোচ্চ ১৭৫টি বই ইস্যু করার রেকর্ড আছে। কিন্তু এখন দিনে ২৫ থেকে ৩০ জন পাঠক আসেন। করোনা মহামারির পর থেকে এ সংখ্যা বেশি কমতে শুরু করেছে।
রাজধানীর গেন্ডারিয়ার সীমান্ত পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহমেদ জানান, ১৯৫১ সালে এ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। আশির দশকে প্রতিদিন ১৫-২০ জন পাঠক বই পড়তে আসতেন। এখন আসেন ৫-৭ জন।
এ ছাড়া গাইবান্ধা, কুষ্টিয়ার খোকসাসহ বিভিন্ন জায়গায় আরও ৮টি পাঠাগারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঠকের সংখ্যা কমে গেছে। যাঁরাও আসেন, বই ইস্যু করেন কম। অধিকাংশই দৈনিক পত্রিকা পড়েন। এসব পাঠাগারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, বড় সংকট মানুষকে বই পড়ার গুরুত্ব বোঝাতে না পারা।
কী বলছেন লেখক-অভিভাবকেরা
একই কথা বলছেন লেখকেরাও। কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘বই পড়তে না চাওয়ার পেছনে আগ্রহ তৈরি না হওয়ার কারণ ব্যক্তি নিজে। পরবর্তী প্রজন্মকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারছেন না অভিভাবকেরা।’ তিনি আরও বলেন, সন্তানের কাছে নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরার যে গুরুত্ব, সেটাই বুঝতে পারছেন না অভিভাবকেরা। তাই খুদে পাঠক তৈরি না হওয়ার পেছনে পরিবার প্রধানত দায়ী।
বাজারে এখন অনলাইনে বই বিক্রির পেজের রমরমা, যা মূল প্রকাশকদের ব্যবসায় প্রভাব ফেলছে। মূল দামের তিন ভাগের এক ভাগ দামে পাইরেটেড বই কিনতে পারছে পাঠক। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছে প্রকাশক।ফিরোজ শেখ, বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা সমিতির পরিচালক।তাঁর এ বক্তব্যের বাস্তব উদাহরণ পাওয়া গেল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়ার কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্যারেন্টস মিটিংয়ে গিয়ে তিনি একজন অভিভাবককে অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সেই অভিভাবক অধ্যক্ষকে অভিযোগ করেছেন, তাঁর সন্তানটি নিজের পাঠ্যবই না পড়ে লাইব্রেরিতে বসে বাইরের বই (সৃজনশীল) বেশি পড়ছে। এ বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন মনোযোগ দিচ্ছে না।
অনেক অভিভাবকের অভিযোগ, পর্যাপ্ত সৃজনশীল বই তাঁদের হাতের কাছে নেই। এটাও পাঠক কমার আরেকটি কারণ। রাজধানীর কদমতলা পূর্ব বাসাবো স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী ইকরা ও জুনায়েদের মা শিরিন আক্তার বললেন, তাঁর দুই সন্তানের একজন নবম শ্রেণিতে, অন্যজন একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। দুজনের কেউই পাঠ্যবইয়ের বাইরে সৃজনশীল বই পড়ার সময় পায় না। তবে হাতের কাছে যদি স্কুলে সৃজনশীল বই থাকত এবং বই পড়ার জন্য আলাদা সময় দেওয়া হতো, তাহলে নিশ্চয়ই ওরা বই পড়ত।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্কুলে বইপড়া কর্মসূচি ও ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার কর্মসূচির সঙ্গে দুই দশক ধরে আছেন উজ্জ্বল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যে প্রতিষ্ঠান বা পরিবারে বই পড়ার অভ্যাস ও সুযোগ আছে, সেখানে বই পড়ে। বাচ্চারা বই পড়তে চায়। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাগার আছে, কিন্তু পাঠাগার ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া নেই। শিশুদের বই পড়াতে হলে তাদের হাতে পাঠযোগ্য বই তুলে দিতে হবে।
পাঠকদের অনেকেই ফিকশনের বদলে নন ফিকশন বেশি পড়ছেন