ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—কে জিতল এই যুদ্ধে
Published: 24th, June 2025 GMT
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জবাবে ইরানের পাল্টা আক্রমণে কোনো মার্কিন নাগরিক নিহত হননি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখন হয়তো যুদ্ধবিরতির একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ইসরায়েল, ইরান আর যুক্তরাষ্ট্র—প্রতিটি দেশই নিজেদের বিজয়ের গল্প বলছে। মিসাইল ছোড়ার আগেই ইরান শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজছিল।
সোমবার সকালে ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠক করে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা হামলার বিষয়ে আলোচনা হয়। আগের সপ্তাহে ইসরায়েল ইরানের সামরিক নেতা ও অবকাঠামোর ওপর ভয়াবহ হামলা চালায়। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র তিনটি মূল পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলে। এতে ইরান বড় ধাক্কা খায়।
ইরান মর্যাদা রক্ষা করতে চেয়েছিল। এক বাংকার থেকে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি পাল্টা হামলার নির্দেশ দেন। এ তথ্য জানিয়েছেন যুদ্ধ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত চার ইরানি কর্মকর্তা। তবে খামেনি নির্দেশ দেন, হামলা সীমিত রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে হবে।
আরও পড়ুন২৫০০ বছরের পুরোনো দুশমনি: ইসরায়েল কি ‘মরদখাই’? ইরান কি ‘হামান’?১৭ জুন ২০২৫ইরান চেয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের কোনো মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে। তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও হামলা করতে উসকে দিতে চায়নি। ফলে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটি বেছে নেয়।
দুই গার্ড সদস্যের মতে, এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি। তাঁরা মনে করেন, এখান থেকেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার সমন্বয় করা হয়েছিল। কাতার ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় ইরান আশা করেছিল, হামলায় ক্ষয়ক্ষতি কম হবে।
হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে ইরান মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে সতর্কবার্তা পাঠায়। কাতার আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রও আগাম সতর্কবার্তা পায়। জনসাধারণের উদ্দেশে ইরান বলে, এই হামলা ইরানের ওপর আঘাতের পাল্টা শোধ।
টিভিতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র বলেন, কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী হামলা চালিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের শত্রুদের সতর্ক করছি। পালিয়ে গিয়ে বেঁচে যাওয়ার যুগ শেষ।’ আক্রমণের সময় ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি দেশাত্মবোধক গান বাজায়। কাতারের আকাশে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ঝলক দেখানো হয়। উপস্থাপকেরা ইরানের গৌরব ও বিজয়ের কথা বলেন।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি তুরস্ক, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান সফর করেছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ ইরানকে ভেঙে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। আরাকচি বলেন, ‘আমি বলছি না যে ক্ষতি হয়নি। অবশ্যই ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারা আমাদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ নষ্ট করতে পারেনি।’এক ইরানি কর্মকর্তা জানান, কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার সময়ই পরিকল্পনা ছিল, কোনো মার্কিন নাগরিক যেন নিহত না হন। কারণ, কোনো মৃত্যু হলে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা আঘাত হানতে পারত। পরিকল্পনা কার্যকর হলো। ট্রাম্প জানান, ১৪টি ইরানি মিসাইলের মধ্যে ১৩টি ভূপাতিত হয়েছে। কেউ নিহত বা আহত হননি। ক্ষয়ক্ষতিও কম।
কিন্তু পর্দার আড়ালে ইরানের শীর্ষ নেতারা আশা করেছিলেন, তাঁদের সীমিত আক্রমণ আর আগাম সতর্কতা ট্রাম্পকে পিছু হটতে রাজি করাবে। ইরানও তখন পিছিয়ে আসবে। তারা চাইছিল, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে হামলা বন্ধ করতে চাপ দিক। কারণ, ইসরায়েল আগেই আক্রমণ শুরু করেছিল এবং সোমবার রাতেও তা চলছিল।
অভূতপূর্বভাবে ট্রাম্প ইরানকে ধন্যবাদ জানান। বলেন, ‘আমাদের আগাম সতর্ক করায় কোনো প্রাণহানি হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আশা করি আর কোনো ঘৃণার কাজ হবে না।’ ট্রাম্প জানান, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি শিগগিরই হবে। কিছুক্ষণ পর ইরানও যুদ্ধবিরতির কথা জানায়। ইসরায়েল তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেনি। তারা জানায়, ইরানি মিসাইল হামলায় তাদের আরও চারজন নিহত হয়েছে।
আরও পড়ুনইরানে হামলা ইসরায়েলের জন্য কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে ১৭ জুন ২০২৫আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক পরিচালক আলী ভায়েজ বলেন, এখন সবাই নিজেদের বিজয়ের গল্প বলছে। বড় যুদ্ধ এড়াতে পেরেছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পিছিয়ে দিতে পেরেছে। ইসরায়েল বলছে, তারা আঞ্চলিক শত্রু ইরানকে দুর্বল করেছে। আর ইরান বলছে, তারা টিকে আছে এবং শক্তিশালী শত্রুদের পাল্টা জবাব দিয়েছে।’
এক সপ্তাহের কম সময়ে যুদ্ধের তীব্রতা সীমা অতিক্রম করেছে। কিন্তু ইরান আর দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চায় না। বেশির ভাগ ইরানি এখন দেশের পক্ষে একজোট হয়েছেন। এই যুদ্ধকে তাঁরা মাতৃভূমির ওপর হামলা বলেই বিবেচনা করেছেন। তবে লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। দোকানপাট, ব্যবসা ও সরকারি অফিস বন্ধ বা সীমিত সময় চালু ছিল। সেখানে অর্থনৈতিক চাপ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ট্যাক্সিচালক, শ্রমিক, সেবা খাতের কর্মীরা বলছেন, এভাবে আর বেশি দিন বাঁচা সম্ভব নয়।
তেহরানের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পার্টির প্রধান সাদেক নুরুজি ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে বলেন, ‘আমাদের আর যুদ্ধ চালানোর ক্ষমতা নেই। অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। জনসমর্থন ধরে রাখা যাচ্ছে না। আমাদের সামরিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের সমান নয়।’
এমনকি গার্ড বাহিনীর ঘনিষ্ঠরাও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। বিশ্লেষক কারিম জাফারি বলেন, ইরান যেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর যুদ্ধে না জড়ায়। তিনি লেখেন, ‘ইরান এখন বহুমুখী যুদ্ধ চায় না। এর ফল কী হবে, তা ভেবে দেখা দরকার।’
এরপর ইরান কী করবে, তা স্পষ্ট নয়। সীমিত হামলা বড় যুদ্ধ এড়াতে সফল হয়েছে বটে। তবে এর মানে এই নয় যে শত্রুতার অবসান ঘটেছে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা সত্ত্বেও ইরানের ইউরেনিয়ামের মজুত বর্তমানে কী অবস্থায় আছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। ইরান কি আরও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাবে, নাকি গোপনে অন্য কোনো আক্রমণ করবে? নাকি কঠিন নিষেধাজ্ঞা শিথিলের জন্য আলোচনায় বসবে?
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি তুরস্ক, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান সফর করেছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ ইরানকে ভেঙে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। আরাকচি বলেন, ‘আমি বলছি না যে ক্ষতি হয়নি। অবশ্যই ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারা আমাদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ নষ্ট করতে পারেনি।’
ফারনাজ ফসিহি দ্য টাইমস-এর জাতিসংঘ ব্যুরোপ্রধান
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ইসর য় ল আম দ র সতর ক র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে
এ দেশে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ–সম্পর্কিত পরিসংখ্যান একটি ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরছে—অনেক ক্ষেত্রে মানুষের জীবন-মৃত্যু নির্ধারণ করছে মব বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। অপরাধ প্রমাণের তো প্রশ্নই নেই, অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়েরও প্রয়োজন দেখা হচ্ছে না; শুধু সন্দেহবশত মব তৈরি করে কিংবা গণপিটুনি দিয়ে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
মাগুরার মহম্মদপুরে মো. ইসরাফিলকে মুঠোফোন ও টাকা চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার ভাই মামলা করলেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। পুলিশ বলছে, ঘটনা ‘জটিল’ ও ‘স্পর্শকাতর’। প্রশ্ন হলো, একজন মানুষ হত্যার পর জটিলতার অজুহাত কেন? অপরাধী শনাক্ত না হওয়া পর্যন্ত ‘নীরব’ থাকা কি আদৌ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ?
প্রথম আলোর বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৩ মাসে গণপিটুনিতে ৬৭ জন নিহত হয়েছেন। ৪৬টি ঘটনায় মামলা হলেও গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ১.২৭ শতাংশ আসামি। অর্থাৎ প্রায় ৯৯ শতাংশ হত্যাকারী নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বিচারব্যবস্থা যখন এমনভাবে ব্যর্থ হয়, তখন নাগরিকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, রাষ্ট্র কোথায়?
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের পর মব বা গণপিটুনির মতো সহিংসতা আগের চেয়ে বেড়েছে। মানুষের ক্ষোভ ও প্রতিশোধের রাজনীতি যেখানে বিচার-বিবেচনাকে গ্রাস করে, সেখানে গণপিটুনি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মব সহিংসতার শিকারদের মধ্যে শিশুও যেমন আছে, তেমনি মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষও রয়েছে। আরও ভয়ংকর হলো, কেউ কেউ এসব ঘটনাকে ‘মব জাস্টিস’ বলে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী, অপরাধীও আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাও ন্যায়বিচারের পূর্বশর্ত হিসেবে আদালতের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার কথা বলেছে। তাহলে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কীভাবে রাস্তায় ‘বিচার’ চালানোর অধিকার পেল?
পুলিশ কর্মকর্তাদের যুক্তি হলো, গুজব বা তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় ঘটনাগুলো ঘটে এবং জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন ঘটনাগুলো সংবাদমাধ্যমের নজরে পড়ে, তখনই কেন গ্রেপ্তার হয়? রংপুরের একটি ঘটনায় দলিত সম্প্রদায়ের দুজনকে হত্যার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে ঘটনাগুলো আলোচিত নয়, সেখানে তদন্ত ও গ্রেপ্তার শূন্যের কোঠায়। এর মানে স্পষ্ট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘সিলেকটিভ’ তৎপরতা চালায়। কিছু ঘটনায় মামলা শেষ পর্যন্ত হয়ই না। পরিবারের সদস্যরা মামলা করতে ভয় পান—শত্রু তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করেন।
গণপিটুনি শুধু আইন ভাঙা নয়, এটি বর্বরতার চূড়ান্ত। একটি সমাজ তখনই বর্বর হয়, যখন অভিযোগ প্রমাণের আগেই শাস্তি দেওয়া হয়। এ রকম অবস্থায় রাষ্ট্রকে পরিষ্কার বার্তা দিতে হবে: কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আইন হাতে তুলে নিলে শাস্তি হবেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত প্রতিটি গণপিটুনি মামলার অগ্রগতি কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং অভিযুক্তদের দ্রুত শনাক্তে প্রযুক্তির ব্যবহার করা।
অন্যায়ের বিচার না হলে সেই অন্যায় চলতেই থাকে। শুধু মামলা নেওয়া বা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা নয়; রাষ্ট্রের কর্তব্য ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন করাও। এর পাশাপাশি ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মনস্তাত্ত্বিক ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। সমাজেরও উপলব্ধি জরুরি—গণপিটুনি ন্যায়বিচার নয়; এটি হত্যাকাণ্ড। ন্যায়বিচার আদালতে হয়, রাস্তায় নয়।
অন্যায় থামাতে হলে একটা মাত্র উদাহরণ দরকার—প্রতিটি মামলায় দ্রুত ও যথাযথ শাস্তি। যখন মনে হবে অপরাধ করলে পার পাওয়া যাবে না, তখনই থামবে এই উন্মাদনা। বিচারহীনতার সংস্কৃতির এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।