নারীবান্ধব বাজেট: প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
Published: 29th, June 2025 GMT
২০২৫-২৬ অর্থবছরে ‘নারী ও শিশু উন্নয়ন’, ‘সমাজকল্যাণ’, ‘স্বাস্থ্য’, ‘শিক্ষা’, ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ ও ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ খাতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখা গেছে। বাজেটে নারীবান্ধব ৪৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে নারীর অংশগ্রহণ বিবেচনায় নিয়ে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ বছর নারীসংশ্লিষ্ট বাজেটের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ২৮ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় এটি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই প্রথমবারের মতো নারীদের অবৈতনিক এবং অস্বীকৃত যত্ন এবং গৃহস্থালির কাজের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবে যত্নকেন্দ্রে আরও বরাদ্দ হলে ভালো হতো।
নতুন করদাতাদের জন্য ন্যূনতম ১ হাজার টাকা করের হার নির্ধারণ, করের ভিত্তি সম্প্রসারণের জন্য একটি স্বাগত উদ্যোগ। তবে করমুক্ত ব্যক্তিগত আয় স্তর এবং ব্যক্তিগত আয়কর কাঠামোতে প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যারা গত কয়েক বছর ধরে ক্রয়ক্ষমতার ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন।
আগামী বছরে ডিজিটাল কর জমা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। মাসিক থেকে ত্রৈমাসিক রিটার্ন জমা দেওয়ার নিয়ম চালু একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, বিশেষ করে ছোট ব্যবসার জন্য তা উপকারী। তবে অনলাইন পণ্য বিক্রয় কমিশনের ওপর ভ্যাট ৫ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য পরিচালন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে এবং পরিষেবা গ্রহণকারীদের কাছে অন্তত আংশিকভাবে স্থানান্তরিত করবে।
মানবসৃষ্ট তন্তু এবং তুলা থেকে সুতা উৎপাদন পর্যায়ে নির্দিষ্ট করের পরিমাণ প্রতি কেজি ৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা করা হলে স্থানীয় টেক্সটাইল উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোর উৎপাদন খরচ বাড়বে। রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার এবং তার কম্প্রেসরের স্থানীয় উৎপানের জন্য বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার উচ্চমূল্যের আকারে গ্রাহকদের কাছে প্রেরণ করা হবে। জীবাণুমুক্ত অস্ত্রোপচার ক্যাটগাট, অস্ত্রোপচারের সেলাই আমদানির ওপর ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহার স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বাড়াবে। এলপিজি সিলিন্ডার, লিফট এবং গৃহস্থালির যন্ত্রপাতির ওপর ভ্যাট অব্যাহতি হ্রাস ভোক্তা মূল্য বাড়াবে। তবে ধীরে ধীরে ভ্যাটের ভিত্তি প্রসারিত করবে।
অর্থ উপদেষ্টা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১২৫ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল ঘোষণা করেছেন। সরকার আগামী তিন বছরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে ১৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া বিভাগীয় শহরগুলোতে পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন, জেলাগুলোতে আঞ্চলিক এসএমই পণ্যমেলার আয়োজন এবং সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ তৈরির জন্য ২৫ হাজার এসএমই উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
এ ছাড়া সরকার প্রান্তিক সিএমএসএমই খাতের ১০ হাজার উদ্যোক্তাকে (মহিলা উদ্যোক্তাসহ) ১০ বিলিয়ন টাকার ঋণ বিতরণ এবং এ খাতের প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ৩ হাজার নারী উদ্যোক্তাকে করপোরেট ক্রেতাদের সঙ্গে সংযুক্ত করার লক্ষ্য ধার্য করেছে।
বাজেটে নারী মালিকানাধীন ব্যবসা থেকে সরকারি ক্রয়ের একটি অংশ সংরক্ষণের বিধান যুক্ত হলে ভালো হতো, যা মোট সরকারি ক্রয়ের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ হতে পারে।
খাদ্য নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের কৃষি ভর্তুকি বাবদ ১৭ হাজার ২৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা আরবিএফওয়াই ২৫ এর চেয়ে ১ শতাংশ বেশি। ২০২৬ অর্থবছরে মোট এএএস বাজেটের ৩৭ শতাংশ কৃষি ভর্তুকি। তবে ২০২৪ অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যবহার দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। ভর্তুকি কমানো ও কীভাবে অতিরিক্ত খরচ মেটাতে সাহায্য করতে পারে, তা স্পষ্ট নয়।
ভর্তুকি থেকে কৃষকরা সম্পূর্ণ সুবিধা পাননি। এটি উন্নত তদারকি এবং ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। কৃষিক্ষেত্রে নারীরা মূলত নিয়োজিত এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও দারিদ্র্যের সময়ে নারীরাই প্রথম ত্যাগ স্বীকার করে। তাই কৃষক হিসেবে নারীদের স্বীকৃতি দান এবং কৃষিতে নারীদের অনুকূলে ইনপুট সহায়তা কার্ড প্রদান গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। ভর্তুকি কাঠামো যুক্তিসংগত এবং মহিলা কৃষকের প্রশিক্ষণ ও ভর্তুকি প্রদানের জন্য সম্পদ বরাদ্দ করা দরকার।
বাজেটের ঘাটতি ও চ্যালেঞ্জ
১.
২. লিঙ্গবৈষম্যমূলক ব্যয় বিশ্লেষণের ঘাটতি: যদিও লিঙ্গ-সংবেদনশীল বাজেট চালু রয়েছে, তবে প্রকৃত লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণ অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। এতে প্রকৃতপক্ষে নারী কতটা উপকৃত, তা নির্ণয় করা কঠিন।
৩. শহর বনাম গ্রামীণ বৈষম্য: শহরের শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত নারীরা কিছু সুযোগ পেলেও পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ ও দরিদ্র নারীরা সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
৪. নারীর সুরক্ষা ও সহিংসতা প্রতিরোধে সীমিত বরাদ্দ: নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি এবং সাইবার ক্রাইম রোধে প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা, পুনর্বাসন ব্যবস্থার জন্য বাজেটে বরাদ্দ এখনও অপ্রতুল।
৫. অপ্রচলিত খাতে নারীর অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা: প্রযুক্তি, পরিবহন, নির্মাণ ইত্যাদি অপ্রচলিত খাতে নারীদের অংশগ্রহণে সহায়ক নীতিমালা এবং বাজেট সহায়তা অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।
সুপারিশ
১. বাস্তবায়ন মনিটরিং জোরদার: বাজেট বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে মনিটরিং ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।
২. গ্রামীণ নারীদের অগ্রাধিকার: নারীবান্ধব প্রকল্পগুলোতে গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
৩. প্রযুক্তিতে নারীর প্রবেশ: তথ্যপ্রযুক্তি ও উদীয়মান খাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে বাজেট সহায়তা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
৪. লিঙ্গ-সংবেদনশীল বিশ্লেষণ: বাজেট প্রণয়নের প্রতিটি ধাপে লিঙ্গ সংবেদনশীল বিশ্লেষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৫. নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একক জানালা: ব্যাংকিং ও সরকারি সহায়তা পেতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’ চালু করা দরকার।
৬. নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন গঠনের জন্য সরকারি সহায়তা ও প্রণোদনা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ থাকা প্রয়োজন, যাতে নারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ও ব্যবসায়িক উন্নয়নের কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) অত্যন্ত শক্তিশালী স্তম্ভ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং অর্থনৈতিক বিকাশে এর বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ খাত প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। বর্তমানে দেশে এসএমই কোম্পানির সংখ্যা ১ কোটি ১৮ লাখ। এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষের। অর্থাৎ শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের ৮৭ শতাংশই এই খাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রতিনিয়ত বেকারের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এর বড় অংশই শিক্ষিত। শিক্ষাজীবন শেষ করে শ্রমবাজারে আসার পর তাদের কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান মিলছে না। বর্তমানে দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী ১০০ জনের মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। ফলে বেকারত্ব নিরসনে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বক্তৃতা-বিবৃতিতে এ খাত নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও কার্যকর উদ্যোগ একেবারেই সীমিত। দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা, ই-কমার্স ও ডিজিটাল মার্কেট প্লেসে এসএমইকে সংযুক্ত, কর কাঠামো ও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজ এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশে সহায়তায় প্রদর্শনীর আয়োজন করা।
নাসরীন ফাতেমা আওয়াল: সভাপতি, উইমেন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ওয়েব), পরিচালক, এসএমই ফাউন্ডেশন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমত ত দ র জন য র জন য ব ভর ত ক বর দ দ সরক র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
কেমন যাবে নতুন অর্থবছর
নতুন অর্থবছর শুরুর মুহূর্তে ভালো-মন্দ দু’রকম খবরই রয়েছে। সবচেয়ে ভালো খবর রিজার্ভ লাফিয়ে বাড়া। জুন শেষে মোট রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াচ্ছে। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী এবং এ মুহূর্তে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ অবশ্য ৪-৫ বিলিয়ন ডলার করে কম হবে। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি স্বস্তির। বিগত সরকারের শেষ সময়টায় রিজার্ভ নিয়ে অস্বস্তি কাটছিলই না। তিন মাসের আমদানি বিল পরিশোধের মতো রিজার্ভ আছে কিনা– এমন প্রশ্ন উঠছিল থেকে থেকেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ১১ মাসে রিজার্ভে উন্নতি হয়েছে ক্রমে। এর একটা কারণ ক্রমে শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ। আরেকটা কারণ অবশ্য আমদানি কমে যাওয়া। এ অবস্থায় রিজার্ভ থেকে ডলার জোগাতে হচ্ছে না। অর্থবছরের শেষ সময়ে আবার বড় অঙ্কের বিদেশি অর্থ এসে যুক্ত হচ্ছে রিজার্ভে। এর মধ্যে আইএমএফ ঋণের দুই কিস্তি লাভের ঘটনা তাৎপর্যবহ। এটা না পেলে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী নতুন করে ঋণ জোগাতে দ্বিধাগ্রস্ত হতো। আইএমএফের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যদেরও দেখা যাচ্ছে ঋণ সহায়তায় এগিয়ে আসতে। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটা ইতিবাচক পরিস্থিতি, বিশেষত যখন তাদের আরও বেশ ক’মাস দেশটি চালাতে হবে।
খারাপ খবরের মধ্যে আছে বোরো উত্তোলন সম্পন্নের পরও চালের দাম বৃদ্ধির ঘটনা। উত্তোলন শুরুর পর এর দাম হ্রাসে মানুষ খুশি হয়েছিল। গত রমজানেও চালের বাজারে ছিল এক ধরনের অস্থিরতা। বিগত বছর থেকে চলে আসা ‘ঘাটতি’ হ্রাস এবং মজুত স্বস্তিকর করতে চাল আমদানিতে উদ্যোগী ছিল সরকার। কর-শুল্ক প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছিল। এ অবস্থায় প্রধান উৎপাদন মৌসুমের ফলন হাতে আসার পরও চালের দাম বাড়লে সেটা দুর্ভাগ্যজনক। ধানের দাম বৃদ্ধির কারণে এমনটি ঘটলে সেটাকেও ইতিবাচক বলার সুযোগ কম। গরিব কৃষকের হাতে এ মুহূর্তে কতটা বিক্রয়যোগ্য ধান-চাল আছে, দেখতে হবে। অন্যান্য কারণের কথাই কিন্তু বেশি বলা হচ্ছে। যেমন ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে চালকল বন্ধ থাকা। চাল পরিবহনে জটিলতা আর ব্যয় বৃদ্ধির কারণও দেখানো হচ্ছে। দেশে ডিজেলের দাম অল্প হলেও কমেছে। এ অবস্থায় চাঁদাবাজি ছাড়া অন্য কোনো কারণে পরিবহন ব্যয় বাড়ার কথা নয়। কিছুদিন আগে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা এক সভায় অভিযোগ করে বলছিলেন পণ্য পরিবহনে দস্যুতা বেড়ে যাওয়ার কথা। চালের বাজার অস্থির হওয়ার নেপথ্যে এসব কারণ আছে কিনা, কে জানে!
বিদায়ী অর্থবছরের বাজেট শেখ হাসিনা সরকার দিলেও এর প্রায় পুরোটা বাস্তবায়ন করল ইউনূস সরকার। নতুন বাজেটও তাদের দিতে হলো। কাজটা সহজ ছিল না; প্রীতিকরও নয়। বিশেষত বিগত সরকারের রেখে যাওয়া পরিস্থিতিতে। সেটা নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন অবশ্য নেই। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়নে গঠিত টাস্কফোর্স ও কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সেটা তুলে ধরেছে। এতে সংকটের স্বরূপ জানতে অসুবিধা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও তৎপর। তার প্রধান কাজ আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে লুটপাট সবচেয়ে তীব্রভাবে হয় ব্যাংক খাতে। তাতে এক শ্রেণির ব্যাংক এখন বন্ধের পথে। সেগুলোকে টিকিয়ে রাখতে ঘোষিত নীতি বদলে টাকা ছাপিয়ে তহবিল জোগাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যেও কিছু ব্যাংক আছে ইতিবাচক ধারায়। উল্লেখযোগ্য মুনাফা করা ব্যাংকও রয়েছে। ব্যাংক মুনাফা করা মানেই কিন্তু সেটা বেসরকারি খাতের সচলতার প্রমাণ নয়। ব্যাংক মুনাফা করেছে প্রধানত সরকারকে ঋণ জুগিয়ে। এর মানে আবার– সরকার বিদায়ী অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের ওপর বেশি নির্ভরশীল থেকেছে, রাজস্ব আহরণ যেহেতু খারাপ। শেষদিকে একযোগে বড় অঙ্কের অর্থ পেলেও ইউনূস সরকার দীর্ঘদিন কিন্তু ছিল বিদেশি ঋণের খরায়। দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই চলতে হয়েছে তাকে। ব্যাংকও এটা জোগাতে পেরেছে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বেশি না থাকায়।
বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়া মোটেও ভালো কথা নয়। এর মানে হলো, উৎপাদন খাত ঝিমিয়ে পড়া। এমনটি ঘটলে বিশেষত শিল্পের মেশিনারিজ ও কাঁচামাল আমদানি কমে যায়। বিদায়ী অর্থবছরজুড়ে এ ধারা অব্যাহত থাকায় স্বস্তি ছিল না অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায়। উৎপাদন না বাড়ার মানে কর্মসংস্থানে অবনতি। শ্রমবাজারে যোগদানকারীরা কাজ পাবে কীভাবে, কর্মে নিয়োজিতরা যখন কাজ হারায়! বিদায়ী অর্থবছরে এমন বেদনাদায়ক পরিস্থিতিই মোকাবিলা করতে হয়েছে জাতিকে। তার একটা বড় কারণ অবশ্য গণঅভ্যুত্থানে তছনছ হয়ে যাওয়া শিল্প-বাণিজ্যের একাংশ। বিশেষ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ব্যবসা করে যাওয়া একটি মহলের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে এমন এক সময়ে, যখন মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই ৯ শতাংশের নিচে নামছে না। এটা কমানোর চেষ্টায় সুদের হার বাড়ানোর ফলে আবার ব্যবসার পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। এসএমইতেও বাড়ছে ব্যয়। এতে উল্টো ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।
এর মধ্যে অবশ্য সুখবর– আরও বেশি করে বাজারে ন্যস্ত হওয়ার পরও ডলারের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল। এতে আমদানি ব্যয়জনিত মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরের অনেকটা সময় আন্তর্জাতিক বাজারও শান্ত ছিল; এমনকি নিম্নগামী। আমাদের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য এটা বিশেষভাবে ইতিবাচক।
নতুন অর্থবছর শুরুর আগ দিয়ে অবশ্য জ্বালানির বাজার অস্থির হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল ইরানে ইসরায়েলের হামলা ঘিরে। জ্বালানি পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকিও দিয়েছিল ইরান। এতে আমাদের এলএনজি আমদানি ঝুঁকিতে পড়তে পারত। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে মধ্যপ্রাচ্যে সংকটে পড়ত আমাদের শ্রমবাজার। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রও, যেটা আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্যের মূল বাজার। যা হোক, সে পরিস্থিতি কেটেছে বলে রক্ষা। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের কথা তো সবারই জানা। জ্বালানি থেকে খাদ্যপণ্যের বাজারও অশান্ত হয় সেই কারণে। বিগত সরকারের আমলে রিজার্ভের অব্যাহত ক্ষয়ও ঘটে ওই পরিস্থিতিতে। এখন প্রশ্ন, নতুন অর্থবছরে কেমন থাকবে আন্তর্জাতিক বাজার?
জ্বালানির দাম আর না বেড়ে বর্তমান স্তরে থাকলেও আমরা নানামুখী সুবিধা পাব, সন্দেহ নেই। কৃষিপণ্যের উৎপাদন আশানুরূপ রাখা গেলে আমদানিও কম করতে হবে। ভুট্টার মতো পণ্যের আমদানি কমছে দেশে উৎপাদন বাড়ছে বলে। তবে ধানের বদলে ভুট্টা চাষ বাড়লে সেটা আবার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
এসব দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ অবশ্য তেমন পাবে না অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন অর্থবছরের মধ্যভাগেই তাদের বিদায় নেওয়ার কথা। এডিপি বাস্তবায়নের ‘পিক সিজন’ তারা পাবেও না। এর আকার ‘যৌক্তিক’ করে ফেলে ভালোই করেছে। ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়ন করা গেলেও এতে পণ্যসামগ্রী সরবরাহকারীরা কম লাভবান হবে না। কর্মসংস্থানও কিছুটা হবে। তবে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে প্রধানত বেসরকারি খাতে। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে আর চলমান গ্যাস সংকটে সেটা কতখানি সম্ভব, কে জানে!
নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিনিয়োগ বাড়ার কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তি শুল্কের ঝুঁকিও যেভাবে হোক কাটাতে হবে। নতুন বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি যতই বাড়ুক, পুরোনো বাজার হারানো চলবে না।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক