অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে কেমন বিশ্ববিদ্যালয় পেলাম
Published: 7th, August 2025 GMT
জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তার অন্যতম প্রধান অংশ জুড়ে ছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মুক্তি, চিন্তার স্বাধীনতা, জ্ঞানচর্চার স্বায়ত্তশাসন এবং সত্যিকারের মানুষ গড়ার আঙিনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা। আকাঙ্ক্ষা ছিল এমন এক ব্যবস্থার, যেখানে দলীয় লেজুড়বৃত্তি, প্রশাসনিক স্বৈরাচার ও বাণিজ্যিক মুনাফার ঊর্ধ্বে থাকবে শিক্ষা ও গবেষণার আদর্শ; কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পেরিয়ে আমরা কী দেখছি? আমরা কি সত্যিই কোনো পরিবর্তন পেয়েছি?
তথ্য-উপাত্ত বলছে, আমরা কেবল কিছু ‘নিয়ন্ত্রক’ পরিবর্তন করেছি, কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাটিকেই ভাঙতে পারিনি। শীর্ষস্থানীয় কিছু মুখ বদল হয়েছে; ভেতরের গতানুগতিক কায়দার শিক্ষা-গবেষণা, অগণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দমনমূলক কাঠামোটি রয়ে গেছে আগের মতোই।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান সংকট বুঝতে হলে শিক্ষাবিদ হেনরি গিউরোর একটি পর্যবেক্ষণ আমাদের পথ দেখাতে পারে। তিনি দেখান যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন ‘নিরীক্ষা-সংস্কৃতি’ (অডিট কালচার) নামে এমন এক রীতি চালু হয়েছে, যেখানে সবকিছুর বিচার হয় সংখ্যা বা ম্যাট্রিক্স দিয়ে। এই সংখ্যা-নির্ভরতার ফলে সৃজনশীলতা ও মৌলিক চিন্তা গুরুত্ব হারায়। কারণ, যা পরিমাপ করা যায় না, তাকে মূল্যহীন ভাবা হয়।
গিউরো এই ব্যবস্থাকে একটি বদ্ধ খাঁচা বা অদৃশ্য কারাগারের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার মূল দায়িত্ব অর্থাৎ অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার সাহস জোগানো থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। গিউরোর এই পর্যবেক্ষণ সামনে রেখেই আমরা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করব।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়: নতুন মোড়কে পুরোনো ‘স্বৈরাচার’জুলাই জাগরণের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ফ্যাসিবাদী আমলের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা থেকে মুক্ত করা; কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার একেকটি উপশাখা হয়েই রয়ে গেছে। উপাচার্য, ডিন, প্রাধ্যক্ষ বা প্রক্টরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে এখনো দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিগত পছন্দই মূল মানদণ্ড হিসেবে কাজ করছে, যা আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের বিকাশ তো দূরের কথা, ক্যাম্পাসগুলোতে একমুখী স্বৈরাচারী ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যের হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকার যে সংস্কৃতি, তা আজও বদলায়নি। আর পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসনের নামে যা চলছে, তা মূলত ‘সরকারদলীয় শিক্ষকদের’ বা ‘সম্ভাব্য সরকারদলীয় শিক্ষকদের’ আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হয়েই রয়েছে। ভিন্নমত দমন করার প্রবণতা কমেনি।
দেশে সার্বিকভাবে ডানপন্থী উগ্রবাদের উত্থান এবং নারীবিদ্বেষী দমনমূলক পরিবেশ লক্ষ করা যাচ্ছে, যার প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়েও এসে পড়ছে। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নীরব সম্মতি হিসেবেই প্রতিভাত হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন করলেও উচ্চশিক্ষার মতো একটি মৌলিক খাত নিয়ে কোনো শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। ফলে নিয়োগ থেকে শুরু করে ভর্তিপ্রক্রিয়া, আবাসন–সংকট থেকে ছাত্ররাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই পুরোনো অনিয়মগুলোই ভিন্ন চেহারায় ফিরে আসছে।
কী চেয়েছিলাম: দলীয় রাজনীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও স্বায়ত্তশাসিত একটি ব্যবস্থা, যেখানে উপাচার্য থেকে শুরু করে সব প্রশাসনিক পদে নিয়োগ হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ও যোগ্যতার ভিত্তিতে, দলীয় আনুগত্যে নয়। শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। গেস্টরুম সংস্কৃতি, র্যাগিং ও সরকারি ছাত্রসংগঠনের দমনমূলক রেজিমেন্টেশনের অবসান হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘সরকারি চাকরির প্রস্তুতিকেন্দ্র’–এর পরিবর্তে জ্ঞান সৃষ্টি ও গবেষণার কেন্দ্রে পরিণত হবে। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়বে এবং দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে থেকে তা বণ্টন করা হবে। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশের অপব্যবহার রোধে সংস্কার এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোকে গণতান্ত্রিক ও স্বায়ত্তশাসনের আলোকে ঢেলে সাজানো হবে।
কী পেলাম: উপাচার্য, ডিন, প্রাধ্যক্ষ বা প্রক্টরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদগুলোতে এখনো দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিগত পছন্দই মূল মানদণ্ড। শিক্ষক নিয়োগেও দৃশ্যমান কোনো উন্নতি বা পরিবর্তন হয়নি; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে।
প্রতিবাদী কণ্ঠকে পরিকল্পিতভাবে স্তব্ধ করে দেওয়ার আয়োজন চলছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌক্তিক প্রতিবাদের জবাবে ছাত্রীদের বহিষ্কার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অগণতান্ত্রিকভাবে মনীষীদের নাম মুছে ফেলা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের মাধ্যমে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা প্রমাণ করে যে নিপীড়নের কাঠামোটি কতটা শক্তিশালী।
বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে কোনো কার্যকর উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। সরকার বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন করলেও উচ্চশিক্ষার মতো একটি মৌলিক খাত নিয়ে কোনো শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রয়োজন অনুভব করেনি। ফলে কাঠামোগত সংকটগুলো আগের মতোই বর্তমান। কোনো ধরনের আইনি বা কাঠামোগত সংস্কারের বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা এবং প্রশাসনের একচ্ছত্র আধিপত্য আজও অটুট, যা আদতে একটি নতুন স্বৈরাচারী ব্যবস্থারই পুনঃপ্রবর্তন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: মুনাফার মডেলে কোনো আঘাত আসেনিবেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রধান অভিযোগ ছিল যে এগুলো মুনাফাকেন্দ্রিক ‘সার্টিফিকেট বিক্রির ভবনে’ পরিণত হয়েছে। গবেষণার দিকটি বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় অনুপস্থিত। আশা ছিল, নতুন বাস্তবতায় এই নয়া উদারবাদী মডেলকে চ্যালেঞ্জ করা হবে, শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে দেখার মানসিকতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসব; কিন্তু এখানেও আমরা পেয়েছি কেবলই হতাশা।
কী চেয়েছিলাম: শিক্ষাকে মুনাফার ঊর্ধ্বে রাখা হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য যৌক্তিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ফি কাঠামো এবং শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত বেতন ও চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। খণ্ডকালীন শিক্ষকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পূর্ণকালীন, স্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো হবে, যা শিক্ষার মান ও গবেষণার পরিবেশ উন্নত করবে। মাতৃভাষায় পাঠদান এবং গবেষণার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা থেকে মুক্তি পাওয়া। গবেষণা, বিশেষ করে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্রে পরিণত হওয়া।
কী পেলাম: বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো মুনাফাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচালিত হচ্ছে। ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’-এর অধীন ইউজিসির আমলাতান্ত্রিক খবরদারি রয়ে গেছে; কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের কোনো রক্ষাকবচ তৈরি হয়নি। ফি এবং বেতনের বৈষম্য আগের মতোই প্রকট। খরচ বাঁচাতে খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের প্রবণতা এখনো প্রবল। এর ফলে শিক্ষকেরা যেমন ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি শিক্ষার্থীরাও একজন স্থায়ী মেন্টরের নিবিড় তত্ত্বাবধান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি অতি নির্ভরশীলতা এবং বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার অবমূল্যায়ন আগের মতোই চলছে, যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইংরেজির ওপর দখল দুর্বল।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি): নিয়ন্ত্রক না নিয়ন্ত্রিত?কী চেয়েছিলাম: আমরা চেয়েছিলাম এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রভাবমুক্ত একটি সত্যিকারের স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল, ইউজিসি নিজেই তার কার্যক্রম, তহবিল ও নীতি নির্ধারণে সক্ষম হবে এবং এর ভেতরেই স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও সাম্য নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকবে। আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম এমন একটি প্রতিষ্ঠানের, যার নিয়োগপ্রক্রিয়া হবে সম্পূর্ণ মেধাভিত্তিক; যেখানে স্বজনপ্রীতি বা রাজনৈতিক আনুগত্যের বদলে উচ্চশিক্ষার প্রতি দায়বদ্ধ ও নিবেদিতপ্রাণ পেশাদারেরাই নিয়োগ পাবেন। সর্বোপরি, আমরা চেয়েছিলাম এমন একটি ইউজিসি, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আমলাতান্ত্রিক বোঝা না হয়ে; বরং শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন কেন্দ্র করে একটি সহায়ক ও গতিশীল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করবে।
কী পেলাম: বাস্তবে আমরা যা পেয়েছি, তা হলো পুরোনো ব্যবস্থারই একটি অচলায়তন। ইউজিসি আজও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান, যার কার্যক্রম ও তহবিলের জন্য পুরোপুরি আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। এটি একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থার বদলে মন্ত্রণালয়ের বর্ধিত অংশ হিসেবেই রয়ে গেছে। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি ও অনুসারীতোষণের সংস্কৃতি বদলায়নি, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটি জনবলের তীব্র অভাব ও অদক্ষ কর্মশক্তিতে ভুগছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করার বদলে ইউজিসি নিজেই একটি ‘আমলাতান্ত্রিক দুঃস্বপ্নে’ পরিণত হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ‘লাগামহীন খবরদারি’ করে; কিন্তু তাদের মানোন্নয়ন বা সংকট নিরসনে কোনো কার্যকর ও যুগোপযোগী সংস্কার আনতে পুরোপুরি ব্যর্থ।
পরিমাপের সংস্কৃতি ও অবিকশিত বিশ্ববিদ্যালয়ওপরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাকের বাইরেও পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরও কিছু গুরুতর সমস্যা রয়েছে। যেমন পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানি করা র্যাংকিং প্রতিযোগিতা। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি বিভাগ র্যাঙ্কিংয়ে ওঠানামা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে।
এই র্যাঙ্কিংগুলোতে গবেষণার গুরুত্ব অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে অনেক বেশি। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রিসার্চ এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে। এসবই ভালো উদ্যোগ। কারণ, আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মপরিধির মধ্যে গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়; কিন্তু যেসব বিষয় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তবে র্যাঙ্কিং পরিমাপে গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেই বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
ক্লাসরুম শিক্ষার মান একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই মান জানার সবচেয়ে প্রচলিত যে পদ্ধতি, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন সেটিই চালু হয়নি। সত্যি বলতে শিক্ষার মান–সংক্রান্ত কোনো ধরনের জবাবদিহির মুখোমুখি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হন না। সেই সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসন এবং খাদ্যের মান বেশ নিম্নমানের; কিন্তু এই বিষয়গুলো যেহেতু র্যাঙ্কিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই এগুলোর উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নেই।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সন্ত্রাস এবং নিপীড়ন অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। আওয়ামী রেজিমের পতনের পর খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই দু–দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন আগের রেজিমের মতোই অপ্রকাশিত রয়ে গেছে কিংবা তদন্তকাজের কোনো অগ্রগতি নেই। কুয়েটে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম হামলা হয়েছে। এসব ঘটনা বিবেচনা করলে বাংলাদেশের বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিং তো দূরের কথা, কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যাওয়ার কথা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণভাবে এ ধরনের সন্ত্রাস ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত থাকলেও সেখানে বেশ গুরুতর সমস্যা রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মানের দিক থেকেও বেশ বড় বিভাজন রয়েছে। ওপরের দিক থেকে চার-পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় মোটামুটি মান ধরে রাখলেও তারপরের বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী চলছে, তা নিয়ে অনেকেই ওয়াকিবহাল নন।
গিউরোর যে কথাগুলো দিয়ে আমরা আমাদের বক্তব্য শুরু করেছিলাম, তা–ই যেন আমাদের বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিচ্ছবি। অভ্যুত্থানের পরেও আমরা সেই ‘অডিট সংস্কৃতি’ থেকে বের হতে পারিনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ‘ভোটার’ নিয়োগ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুনাফার হিসাব—উভয় ক্ষেত্রেই সৃজনশীলতা বা গভীর জ্ঞানের চেয়ে পরিমাপযোগ্য ‘পারফরম্যান্স’ মুখ্য। পাসের হার, প্রকাশনার সংখ্যা (মান যা–ই হোক), ভর্তি পরীক্ষার এমসিকিউর নম্বর—এসব সংখ্যা দিয়ে আমরা জ্ঞানকে পরিমাপ করতে চাইছি।
এ রকম ব্যবস্থা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি বদ্ধ খাঁচায় পরিণত করেছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নজরদারির অধীন থাকেন এবং শিক্ষকেরা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের ভয়ে থাকেন। আমরা হয়তো কয়েকজন ‘কারারক্ষী’কে পরিবর্তন করেছি; কিন্তু ‘কারাগারের দেয়াল’, পরিমাপের শৃঙ্খল এবং নিয়ন্ত্রণের দর্শন—সবই আগের মতো রয়ে গেছে।
এ ব্যবস্থা দিয়ে হয়তো তথ্য দেওয়া যায়; কিন্তু জ্ঞান সৃষ্টি করা যায় না। এই কাঠামো দিয়ে হয়তো চাকরিজীবী তৈরি করা যায়; কিন্তু ন্যায়বিচার ও সাম্যের স্বপ্ন দেখতে সক্ষম মুক্তচিন্তার নাগরিক তৈরি করা যায় না। জুলাই জাগরণের স্বপ্ন ছিল এই কারাগার ভাঙার, কিন্তু আমরা এখনো সেই ভাঙনের কোনো বাস্তব রূপ দেখতে পাচ্ছি না।
মতামত শিক্ষক নেটওয়ার্কের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ব যবস থ উপ চ র য প রক র য় আম দ র ব ব সরক র এমন এক র জন য পর ম প র ওপর ইউজ স আমল ত ন একট
এছাড়াও পড়ুন:
‘সরকারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু, প্রধান কাজ ভালো নির্বাচন’
অন্তর্বর্তী সরকার মনে করছে, তাদের প্রথম পর্ব শেষ এবং দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের মূল দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ভালো একটি নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছেন।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
আরো পড়ুন:
‘আলোকিত স্বার্থবোধের’ ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছি আমরা: তৌহিদ হোসেন
জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার পূর্ণ ভাষণ
প্রেস সচিব বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা সরকারের সব পর্যায়ের কর্মচারীদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে সংস্কার ও বিচারের কাজও চলতে থাকবে।”
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন আয়োজনের জন্য চিঠি দিয়েছেন। এর মাধ্যমে সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে।”
“তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন দ্বিতীয় অধ্যারয়ে প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে নির্বাচন সুন্দরভাবে করা,” বলেন শফিকুল আলম।
এর বাইরে সংস্কার ও বিচারক কাজও গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন বলেন জানান প্রেস সচিব।
ঢাকা/আসাদ/সাইফ