জামায়াতে ইসলামীকে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার দায় স্বীকার করার আহ্বান জানিয়েছেন ৩২ বিশিষ্ট নাগরিক। আজ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল ছিল জামায়াতে ইসলামী। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন, উচ্ছেদের মুখে যখন স্বাধীনতাকামী মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন; তখন জামায়াতে ইসলামীর নেতা–কর্মীরা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে সক্রিয় ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দলীয়ভাবে গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তাদের অনেক নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, উচ্ছেদ, ধর্ষণ, লুটপাটে সহযোগী হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।’

বিবৃতিদাতারা হলেন অধ্যাপক আজফার হোসেন, রায়হান রাইন, জি এইচ হাবীব, আ-আল মামুন, সায়মা আলম, আর রাজী, সায়েমা খাতুন, কাজল শাহনেওয়াজ, মারুফ মল্লিক, রাখাল রাহা, সৌভিক রেজা, গোলাম সরওয়ার, দেবাশীষ চক্রবর্তী, আশফাক নিপুন, মোস্তফা কামাল পলাশ, মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিন, গাজী তানজিয়া, এস কে তাসনিম আফরোজ, তুহিন খান, পারভেজ আলম, চিনু কবির, ফেরদৌস আরা রুমী, বিথী ঘোষ, মোহাম্মদ রোমেল, সাঈদ বারী, মাহাবুব রাহমান, সালাহ উদ্দিন শুভ্র, অর্বাক আদিত্য, আরিফ রহমান, সোয়েব মাহমুদ, অস্ট্রিক আর্যু ও সাদিক মাহবুব ইসলাম।

জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে জামায়াতে ইসলামী অখণ্ড পাকিস্তানের দাবিতে সভা-সমাবেশ করেছে, প্রচার চালিয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিদাতারা বলেছেন, ‘এমনকি ২৫ মার্চ বর্বর গণহত্যার পর পাকিস্তান জান্তার সঙ্গে বৈঠকও করেছে দলটির নেতারা। তাদের দলের নেতা-কর্মীরা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষে রাজাকার, আলবদরসহ বিভিন্ন বাহিনীতে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধর্ষণ, লুণ্ঠন, গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে বলে পরিষ্কার তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।’

জামায়াত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসলামী ছাত্র সংঘ নাম পরিবর্তন করে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে রাজনীতি শুরু করে। তবে তাদের মূল দল জামায়াতে ইসলামী একই নামে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করে আসছে। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার কারণে তারা কখনো ক্ষমা প্রার্থনা, অনুশোচনার প্রকাশ ঘটায়নি। উল্টো বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছে।’

জামায়াতের চরিত্র জুলাই অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের চরিত্রের সঙ্গে মিলে যায় জানিয়ে বিবৃতিতে দলটির প্রতি এ ধরনের রাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ‘আমরা জুলাই অভ্যুত্থান–পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের স্বার্থে জামায়াতে ইসলামীর কাছে এ ধারার রাজনীতি বন্ধের দাবি জানাই। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার রাজনৈতিক দায় শিকারের আহ্বান জানাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে কয়েক লাখ মানুষের শহীদি আত্মত্যাগ ও সম্ভ্রমের প্রতি অবশ্যই তাদের শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।’

দীর্ঘ বিবৃতিতে উঠে আসে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের বিচারের বিষয়টিও। বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত ছিল সেটা ঠিক। তবে তার মানে এই নয় যে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত বা এ দলের নেতা–কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত ছিল না।’ আওয়ামী লীগ এ অপরাধকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে বলেও উল্লেখ তার যথাযথ তদন্ত এবং বিচার দাবি করা হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অভ্যুত্থানের পর থেকে জামায়াত এবং তার সহযোগী ছাত্রশিবির মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা, গণহত্যাসহ অন্যান্য অভিযোগে ঐতিহাসিকভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করতে চাইছে। পাকিস্তানি শাসকেরা তখন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় যে ভাষায় কথা বলত, সেই একই বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললে আওয়ামী লীগের মতো “শাহবাগী” ইত্যাদি ট্যাগিংয়ের রাজনীতি ফিরিয়ে আনছে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র আহ ব ন র র জন ত গণহত য কর ম র ইসল ম আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্র এক ফোনকলেই গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে পারে, কিন্তু করে না কেন?

মার্কিন রাজনৈতিক পরিসরে যখন কেউ ফিলিস্তিনের মানবিক বিপর্যয়ের কথা তোলে, তখনই প্রশ্ন আসে, ‘৭ অক্টোবরের হামাসের বিষয়টা কী হবে?’ এ প্রশ্ন যেন একটি অস্ত্র, যা দিয়ে ফিলিস্তিনপন্থী বা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলা মানুষদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, বিশেষত মার্কিন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। অথচ এর পাল্টা জবাব হতে পারে, ‘৬ আগস্টের বিষয়টা তাহলে কী হবে?’

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় প্রথম পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল। তিন দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বোমা ফেলা হয়। এই দুই হামলায় আনুমানিক দুই লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল।

এর আগেই ১৯৪৫ সালের মার্চে ‘অপারেশন মিটিংহাউস’ নামে পরিচিত ভয়াবহ অগ্নিবোমা হামলায় টোকিওতে কয়েক হাজার মানুষ মারা যান এবং এক মিলিয়নের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন।

আজ গাজার গণহত্যার সময় যে ‘সংখ্যার রাজনীতি’ আমরা দেখছি, তা এক শীতল বাস্তবতার প্রতিফলন। টোকিও অভিযানের নেতৃত্বদানকারী মার্কিন জেনারেল কার্টিস লে মে খুব ভালো করেই জানতেন, জনবহুল এলাকায় ন্যাপাম ফেলার মানে কী। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘যদি আমরা যুদ্ধে হেরে যেতাম, তাহলে আমাদের সবাইকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হতো।’

আরও পড়ুনযে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে হামলা চালাল ইসরায়েল১৪ জুন ২০২৫

লে মে শুধু জাপানেই থেমে থাকেননি। ১৯৮৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন, মার্কিন বোমা উত্তর কোরিয়ার ২০ শতাংশ জনগণকে হত্যা করেছিল এবং ‘যা নড়াচড়া করেছে’—এ রকম সবকিছুকে তারা লক্ষ্যবস্তু করেছিল।

ইতিহাসবিদ ব্রুস কামিংস নিউজউইকে বলেছিলেন, ‘বেশির ভাগ আমেরিকান জানেনই না যে আমরা উত্তর কোরিয়ার শহরগুলো জাপান বা জার্মানির তুলনায় বেশি ধ্বংস করেছিলাম।…কিন্তু প্রত্যেক উত্তর কোরীয় জানেন। তাঁদের মগজে সেটা গেঁথে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা কখনো এসব শুনি না।’

সম্মিলিত শাস্তির নীতি

লে মে একসময় কিউবার বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন, যদিও প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তাঁকে আটকে দেন। কিন্তু ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় ন্যাপাম হামলার সময় তিনি ‘মানুষকে পাথরযুগে ফেরত পাঠানোর’ বোমাবর্ষণ নীতিতে বিশ্বাস করতেন।

গালফ যুদ্ধ (১৯৯১) শুরুর আগেই লে মে মারা যান। কিন্তু আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এবং আরও বহু মার্কিন আগ্রাসনে তাঁর তত্ত্ব বেঁচে আছে। আকাশ থেকে নির্বিচারে গণসন্ত্রাস চাপিয়ে দিয়ে স্থানীয় জনগণকে অমানবীয় করে তোলা হয়, যেখানে সবাইকে দোষী ধরা হয় এবং সম্মিলিত শাস্তি দেওয়া হয়।

সাম্প্রতিক মার্কিন বক্তব্যও এ ধারাই বজায় রেখেছে। ৮ সেপ্টেম্বর জেরুজালেমে এক বাসস্ট্যান্ডে দুই ফিলিস্তিনির হামলায় ছয়জন ইসরায়েলি নিহত হওয়ার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি ঘোষণা করেন, ‘এই বর্বরতার বিরুদ্ধে আমরা ইসরায়েলের পাশে আছি।’

এখানে প্রশ্ন ওঠে: মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কি সত্যিই স্বাধীন, নাকি ইসরায়েলপন্থী লবিগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? একই সঙ্গে কি দুটি বিষয় সত্য হতে পারে? আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খামখেয়ালি মন্তব্য বা ‘শান্তি উদ্যোগ’ আসলে কী বোঝায়?

বিশ্বনেতারা শোক প্রকাশ করেন, আর বিশ্লেষক মুইন রাব্বানির ভাষায় ‘সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা’ আবারও সক্রিয় হয়—‘টেরর টাওয়ার’, ‘ব্রিডিং গ্রাউন্ড’ ইত্যাদি প্রোপাগান্ডা শব্দগুচ্ছ ছড়িয়ে দিয়ে ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধ আড়াল করার প্রচেষ্টা চলে।

এখানে প্রশ্ন ওঠে: মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কি সত্যিই স্বাধীন, নাকি ইসরায়েলপন্থী লবিগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? একই সঙ্গে কি দুটি বিষয় সত্য হতে পারে? আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খামখেয়ালি মন্তব্য বা ‘শান্তি উদ্যোগ’ আসলে কী বোঝায়?

আরও পড়ুনট্রাম্প ও নেতানিয়াহু মূলত ‘জেনোসাইড পুরস্কারের’ যোগ্য ২৭ আগস্ট ২০২৫প্রত্যাখানেযাগ্যতা বনাম বাস্তবতা

একসময় ‘প্লজিবল ডিনায়েবিলিটি’ (প্রত্যাখ্যানযোগ্যতা) ছিল মার্কিন কৌশলের কেন্দ্রীয় উপাদান। কিন্তু এডওয়ার্ড স্নোডেন, চেলসি ম্যানিং ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ফাঁস করা তথ্য সেই মুখোশ খুলে দিয়েছে। তবু ইসরায়েলের অস্বাভাবিক প্রভাব—মার্কিন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে—আরও জটিল অস্বীকারযোগ্যতার কাঠামো তৈরি করেছে।

বাইডেন–হ্যারিস প্রশাসন ‘গাজা পিয়ার প্রকল্প’-এর মতো হাস্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে আর ট্রাম্প–ভ্যান্সের দল ‘উইটকফ প্ল্যান’ বা ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ হুমকির মতো কৌতুকময় নাটক করেছে। কিন্তু উভয় প্রশাসনই জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে এবং ইসরায়েলকে অব্যাহত সামরিক সহায়তা দিয়েছে। বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে এক ফোনকল বা নির্বাহী আদেশেই গাজার গণহত্যা থামাতে পারত।

কিন্তু বাস্তবতা হলো মার্কিন রাজনীতি ও নিরাপত্তাকাঠামো ইসরায়েলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আইপ্যাকের নির্বাচনী তহবিল থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশিক্ষণ, নজরদারি প্রযুক্তি—সবখানেই ইসরায়েলি প্রভাব দৃশ্যমান।

প্রক্সি রাষ্ট্র ও মার্কিন আধিপত্য

এতে প্রশ্ন ওঠে, ইসরায়েলি জায়নবাদী আদর্শ, প্রযুক্তি ও রাজনীতির এই অতিরিক্ত প্রভাব আসলে কি যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক নীতির জন্যই এক ‘অস্বীকারযোগ্য’ প্রক্সি কাঠামো?

সিরিয়ার শাসন পরিবর্তন, লেবাননকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, ইরানকে লক্ষ্য করে যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞা, মিসরকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ দিয়ে শ্বাসরোধ করা, আব্রাহাম চুক্তি—সবই সেই ইঙ্গিত দেয়।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকান ইহুদি সমাজ কোথায় দাঁড়াবে? সমর্থনকারী বা বিরোধী উভয় পক্ষের জন্যই এটি এক কঠিন বাস্তবতা। নেতানিয়াহু, যিনি আমেরিকায় বহু বছর কাটিয়েছেন, একদিকে প্রগতিশীলদের কাছে সমালোচিত, অন্যদিকে জায়নবাদীদের কাছে নায়ক হিসেবে বিবেচিত হন।

শেষ পর্যন্ত, বর্তমান কাঠামো কেবল ইসরায়েলকে মার্কিন প্রক্সি হিসেবে ধরে রাখছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত বিশ্বভূমিকা নিয়ে গভীরভাবে প্রশ্ন না ওঠে। একই সঙ্গে এই প্রক্সি ভূমিকা মার্কিন ইহুদি সমাজের জন্য নতুন বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা নিয়ে তাদের ভাবনা শুরুই হয়নি।

আমিয়েল আলকালাই মার্কিন কবি, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, প্রবন্ধকার, সমালোচক ও গবেষক।

মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যুক্তরাষ্ট্র এক ফোনকলেই গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে পারে, কিন্তু করে না কেন?