স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তুলে ধরে এক পক্ষের ইশতেহার ঘোষণা
Published: 8th, August 2025 GMT
বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল শনিবার। এই নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করেছে বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের একটি পক্ষ (হারুন-শাকিল)।
আজ শুক্রবার রাজধানীর প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে প্যানেল পরিচিতি ও নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন তাঁরা।
এই অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক হারুন আল রশীদ। তিনি সভাপতি পদপ্রার্থী। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে যাঁরা বিভিন্ন নির্যাতন সহ্য করেছেন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের যেকোনো সমস্যায় এগিয়ে গেছেন, তাঁরাই ড্যাবের এবারের কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচনে (হারুন-শাকিল অংশে) প্রার্থী হয়েছেন।
বিগত স্বৈরাচারের আমলে অসংখ্য মানুষ পুলিশের গুলিতে আহত ও নিহত হন। বিএনপিপন্থী এই চিকিৎসকেরা সেসব নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ান বলে উল্লেখ করেন হারুন আল রশীদ।
সংবাদ সম্মেলনে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন মহাসচিব পদপ্রার্থী মো.
হারুন-শাকিল অংশের ইশতেহারে স্বল্পমেয়াদি (এক থেকে তিন বছর) কর্মপরিকল্পনায় সবার জন্য স্বাস্থ্য ও সর্বজনীন চিকিৎসা, স্বাস্থ্য খাতে সমতাভিত্তিক আইন, সরকারি চিকিৎসকদের সুষম চাকরি নীতিমালা, এমবিবিএস, পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ও নার্সিং শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে রূপান্তরকরণ, ঔষধ নীতির সময়োপযোগী পরিবর্ধন ও সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার এবং সরকারি চাকরিতে চিকিৎসকদের বয়সসীমা ৩২ থেকে ৩৪ বছরে উন্নীত করাসহ ১৪ দফা প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
মধ্যমেয়াদি (এক থেকে পাঁচ বছর) কর্মপরিকল্পনায় রয়েছে স্বাস্থ্যকার্ড প্রবর্তনের প্রস্তাব, স্বাস্থ্যব্যবস্থার অটোমেশন, বিগত ১৫ বছরে বঞ্চিত চিকিৎসকদের চাকরিতে নিয়োগ এবং দুর্নীতিমুক্ত চাকরির নীতিমালা ও মেধাভিত্তিক পদোন্নতি নিশ্চিত করা। হারুন-শাকিল অংশের ইশতেহারে দীর্ঘমেয়াদি (এক থেকে দশ বছর) কর্মপরিকল্পনায় রয়েছে চিকিৎসাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও স্বাস্থ্যবিমা চালুকরণ।
সভাপতি ও মহাসচিব ছাড়াও এই অংশের প্যানেলে রয়েছেন সিনিয়র সহসভাপতি পদপ্রার্থী অধ্যাপক মো. আবুল কেনান, কোষাধ্যক্ষ পদপ্রার্থী মো. মেহেদী হাসান এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদপ্রার্থী অধ্যাপক খালেকুজ্জামান দিপু।
মো. মেহেদী হাসানের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন হারুন-শাকিল অংশের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মোসাদ্দেক হোসেন, সদস্যসচিব সিরাজুল ইসলাম এবং ড্যাবের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এম এ সেলিম প্রমুখ।
ড্যাবের কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচনে কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল শনিবার বেলা একটা থেকে তিনটা পর্যন্ত।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ক ৎসকদ র পদপ র র থ
এছাড়াও পড়ুন:
অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন: মানদণ্ড মানছেন না চিকিৎসক, বিপাকে রোগী
কয়েকদিন জ্বর ও শরীর ব্যথা নিয়ে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন সদর উপজেলার নতুনবসতি এলাকার শিহাব উদ্দিন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক তাকে ওষুধের নাম উল্লেখ করে প্রেসক্রিপশন (ব্যবস্থাপত্র) করে দেন। তবে চিকিৎসকের লেখা অস্পষ্ট হওয়ায় ওই প্রেসক্রিপশন নিয়ে বিপাকে পড়েন শিহাব।
তার বাসার আশপাশের কোনো ফার্মেসির বিক্রয় কর্মীরা ওষুধের নাম বুঝতে পারেননি। অবশেষে তিনি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় কয়েকটি ফার্মেসি ঘুরে ওষুধ কিনেন। শিহাবের মতো এমন অসংখ্য রোগীর ভাষ্য, চিকিৎসকের অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশনের কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি ডাক্তারদের হাতের লেখা ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছে ভারতের আদালত। প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসকদের হাতের লেখা আরো পাঠযোগ্য করতে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার হাইকোর্ট এ নির্দেশ দেন। বাংলাদেশেও ২০১৭ সালে হাইকোর্ট অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন বন্ধে নির্দেশ দেন।
সরকারি বিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (BMDC) অনুমোদিত প্রতিটি চিকিৎসককে প্রেসক্রিপশন লেখার সময় স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লিখতে হবে। প্রয়োজনে বড় অক্ষরে ওষুধের নাম উল্লেখ করতে হবে, যেন ভুল বোঝার সুযোগ না থাকে। প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে চিকিৎসা পরামর্শ ও পরীক্ষার যুক্তি থাকতে হবে। প্রতিটি প্রেসক্রিপশনে রোগীর নাম, বয়স, লিঙ্গ, তারিখ, ডাক্তারের পূর্ণ নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও সঠিক ডোজসহ স্পষ্টভাবে ওষুধের নাম লিখতে হয়।
২০১৭ সালের ৯ জানুয়ারি স্পষ্ট অক্ষরে এবং বড় বা ছাপার অক্ষরে পড়ার উপযোগী করে প্রেসক্রিপশন দিতে চিকিৎসকদের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সার্কুলার জারি করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএমডিসি-এর এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এসব মানদণ্ডের অনেকটাই মানা হচ্ছে না। ফলে চিকিৎসা সেবা জটিল হচ্ছে, বাড়ছে রোগীর আর্থিক ক্ষতি ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি।
মানিকগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ক্লিনিক ও বেসরকারি চেম্বার ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ প্রেসক্রিপশনে এসব নিয়মের তোয়াক্কা নেই। কোথাও ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন নম্বর নেই, কোথাও নেই রোগ নির্ণয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা। অনেক প্রেসক্রিপশন এত অস্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা যে, রোগীরা ফার্মেসিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। কিছু প্রাইভেট ক্লিনিকের চিকিৎসকদের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশনের বদলে ডিজিটাল প্রেসক্রিপশন করতে দেখা গেলেও তা খুবই নগন্য।
স্থানীয় ফার্মেসি মালিক জানান, প্রতিদিনই তারা অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন নিয়ে বিপাকে পড়েন। অনেক প্রেসক্রিপশন এমনভাবে লেখা যে, ডাক্তার ছাড়া কেউ পড়তেই পারে না। এতে ভুল হওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রেসক্রিপশন ঠিকঠাক করিয়ে নিতে রোগীও আবার ডাক্তারের কাছে ফিরে যেতে চান না। এতে নতুন করে সিরিয়াল নেওয়ার ঝামেলা রয়েছে। এসব কারণে খানিকটা রিস্ক থেকে যায়।
স্বাস্থ্য অধিকার ফোরাম মানিকগঞ্জ জেলার সমন্বয়কারী বিমল রায় বলেন, “প্রেসক্রিপশন হচ্ছে চিকিৎসকের আইনি দলিল। এটি যদি মানসম্মত না হয়, তবে রোগীর জীবনঝুঁকি বাড়ে। অনেক ডাক্তার সময় বাঁচাতে দ্রুত লিখে ফেলেন, যা বড় ভুল। মানহীন প্রেসক্রিপশন শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। ভুল ওষুধ সেবনের কারণে হঠাৎ শারীরিক জটিলতা, অ্যালার্জি ও ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া বাড়ছে।”
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি এ বি এম সামসুন্নবী তুলিপ বলেন, “একজন সেবাপ্রার্থী হিসেবে চিকিৎসকের কাছ থেকে স্পষ্ট প্রেসক্রিপশন পাওয়া অধিকার। অস্পষ্ট লেখা থাকার ফলে অনেক সময় ফার্মেসি কর্মীই পরোক্ষভাবে চিকিৎসকের জায়গা নিচ্ছেন। নিজের ধারণা ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ওষুধ সাজিয়ে দিচ্ছেন। এতে রোগীদের জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে। প্রেসক্রিপশনের মানদণ্ড মানা কেবল নিয়ম নয়, এটি রোগীর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা। অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন বন্ধে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা এখন সময়ের দাবি। প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কম্পিউটার জেনারেটেড বা স্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, “অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশনের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের কোন তৎপরতা নেই। ফলে নাগরিকদের অধিকার ও সুশাসন ব্যাহত হচ্ছে। বেশিরভাগ চিকিৎসকের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন দুর্বোধ্য। মাঠ পর্যায়ে সরকারি কোন দপ্তর এসব বিষয় নজরদারি করে না।”
তিনি আরো বলেন, “অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন বন্ধে প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ানো উচিত। জেলা পর্যায়ে মনিটরিং সেল গঠন করে এসব নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা দরকার। চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন লেখার প্রশিক্ষণ এবং রোগী-ফার্মেসি কর্মীদের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।”
মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন এ কে এম মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, “স্পষ্ট প্রেসক্রিপশন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ সম্পর্কিত নির্দেশনা রয়েছে। তবে কেউ অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ এ কার্যালয়ের নেই। কারণ, অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন করলে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নির্দেশনা সিভিল সার্জনকে দেওয়া হয়নি।”
আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, “আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রেসক্রিপশন করা হয় না। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রেসক্রিপশনের নমুনা ফরম্যাট সারা দেশে প্রবর্তনের পরিকল্পনা থাকলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। প্রেসক্রিপশনের মানদণ্ড বাস্তবায়নে কোনো বিশেষ তদারকি কার্যক্রম নেই। বরং, জেলা পর্যায়ে পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট মনিটরিং সেলও কার্যকর নেই। সংস্কার প্রস্তাবে অনলাইন সার্ভার প্রেসক্রিপশন ব্যবস্থা চালু করাসহ কয়েকটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।”
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক (যুগ্ম সচিব) ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “স্পষ্ট প্রেসক্রিপশন করে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া চিকিৎসকের নৈতিক দায়িত্ব। কোন চিকিৎসক অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন করলে তার বিরুদ্ধে কোন লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকা/এস