সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের কোপে নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের (৩৮) দাফন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় নিজ বাড়ির পাশের সামাজিক কবরস্থানে সম্পন্ন হয়েছে।

শুক্রবার (৮ আগস্ট) মাগরিবের নামাজের পর দ্বিতীয় জানাজা শেষে উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের ভাটিপাড়া গ্রামে তাকে দাফন করা হয়।

এর আগে, গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় জুমার নামাজের পর তুহিনের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে তুহিনের মরদেহ গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। 

আরো পড়ুন:

নাটোরে প্রাইভেটকার চালককে হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার ১

সাংবাদিক তুহিন হত্যায় জড়িতদের শাস্তি দাবি

সাংবাদিক তুহিন ভাটিপাড়া গ্রামের মো.

হাসান জামাল ও সাবিহা খাতুন দম্পতির ছেলে। তিনি ছিলেন ভাই-বোনদের মধ্যে সবার ছোট। তার স্ত্রীর নাম মুক্তা আক্তার। তাদের সংসারে দুই ছেলে রয়েছে। তুহিনের বড় ছেলের নাম তৌকির (৭) ও ছোট ছেলের নাম ফাহিম (৩)।

সন্তানের শোকে আহাজারি করা তুহিনের ৭৫ বছর বয়সী মা সাবিহা খাতুন বলেন, “আমার ছেলে তুহিন বুধবার বলেছিল, আমি তোমাকে আগামী মাসে চোখের ডাক্তার দেখাব। ডাক্তার অপারেশন করানোর কথা বললে, অপারেশন করাব। আম্মা কোনো চিন্তা করো না। তুমি ভালো হয়ে যাবে।” 

তুহিনের জানাজায় অংশ নেন গ্রামের বাসিন্দা ও স্বজনরা 

ছেলের মৃত্যুতে পাগল প্রায় বৃদ্ধ বাবা মো. হাসান জামাল বলেন, “কী অপরাধ করেছিল আমার ছেলে? কী অন‍্যায় করেছিল সে? কেন এমন হলো। আমি খুনিদের চাই না। তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও।”

 

স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, ‍“তুহিনরা পাঁচ ভাই। প্রত্যকেই কাজের তাগিদে সিলেট ও গাজীপুরে থাকেন। তারা কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। তুহিন খুব ভালো ছেলে ছিল। নিয়মিত বাবা-মায়ের সেবা ও খোঁজ খবর নিতেন। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।”

একই এলাকার বাসিন্দা আকরাম হোসেন বলেন, “তুহিন সাংবাদিকতা পেশায় খুব ভালো করেছিল। অল্প সময়েই তিনি নাম-ডাক অর্জন করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তুহিনের আয় বেশি ছিল। সংসারের হাল ধরেছিলেন তিনি। তুহিনের মৃত্যুতে স্ত্রী মুক্তা আক্তার দুই সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়বেন। সরকার যদি সহায়তা করে, তাহলে তুহিনের পরিবারের জন্য খুব ভালো হবে।”

স্বজনরা জানান, আসাদুজ্জামান তুহিন ২০০৫ সালে ফুলবাড়িয়া আল হেরা স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০২ সালে সিলেট এম সাইফুর রহমান কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি গাজীপুর ভাওয়াল কলেজ থেকে অনার্স করে সেখানে ভাই জসিম উদ্দিনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। পরে ওষুধ কোম্পানি চাকরি নেন। ২০১২ সালে সংবাদপত্রে কাজ শুরু করেন। তার বড় ভাই জসিম ২০০৯ বা ২০১০ সালে  ক‍্যানসারে মারা যান।

বতর্মানে তুহিন ও তার অপর ভাই সেলিম গাজীপুরে বসবাস করছিলেন। সেলিম পরিবহন শ্রমিকের কাজ করেন। অপর ভাই জাহাঙ্গীর আলম কক্সবাজার টেকনাফে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন এবং অন‍্য ভাই শাজাহান মিয়া সিলেটে থাকেন। তাদের দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বতর্মানে গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা ও মা বসবাস করেন। তারা বার্ধক‍্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। ছেলেরাই তাদের দেখভাল করেন।

বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) গাজীপুর চন্দনা চৌরাস্তা এলাকায় চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবের ভিডিও ধারণ করায় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

ঢাকা/মিলন/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর হত য

এছাড়াও পড়ুন:

‘হাসপাতালে দেখি ছেলের নিথর দেহ, রক্তে ভেজা’

ঠিক এক বছর আগে, সাভারের রাস্তায় পড়ে ছিল এক তরুণের রক্তাক্ত দেহ। শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। মেধাবী, পরিশ্রমী, বিনয়ী এক তরুণ। তার পরিবার আজও সেই দৃশ্য ভুলতে পারেনি। ভুলতে পারেনি তার বাবা মো. মহিউদ্দিনও। 

আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “শহীদের রক্তমাখা কাপড়ই কাফন হয়। তাই আমার ছেলেকে যে কাপড় পরে গুলি খেয়েছে, সে কাপড়েই দাফন করেছি।”

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল রাজপথ। নানা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় থানা রোড এলাকায়। দুপুরের দিকে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ সাঁজোয়া যান নিয়ে এগিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য ও ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, এমআইএসটির চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন পুলিশের গুলিবর্ষণ থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে সাঁজোয়া যানটিতে উঠে পড়েন।

ঠিক সেই সময়, পুলিশের ছররা গুলি লাগে তার বুকে। তিনি লুটিয়ে পড়েন। এরপর যেভাবে তার শরীরকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়, তা সামাজিক মাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে।

শহীদ ইয়ামিন ছিলেন সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক টাউন মহল্লার বাসিন্দা। মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। থাকতেন এমআইএসটির ওসমানী হলে। পরিবারের বড় সন্তান। বাবা মহিউদ্দিন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা।

সেদিন দুপুরে জোহরের নামাজ শেষে বাসা থেকে বেরিয়ে যান ইয়ামিন। আর ফেরেননি। বিকেল নাগাদ খবর আসে-তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে। বাবার ভাষায়, “হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ছেলের নিথর দেহ। বুকের বাম পাশে শটগানের গুলি। শরীর রক্তে ভিজে গেছে।”

ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়েও বাবার আবেগ জড়িয়ে, “তালবাগ কবরস্থানে দাফন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। পরে ছেলের এক বন্ধুর সহযোগিতায় ব্যাংক টাউনের কবরস্থানে দাফন করি। যেই পোশাকে সে শহীদ হয়েছে, সেটাই তার কাফন।”

পরবর্তীতে আদালত থেকে মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ আসে। কিন্তু শহীদের মর্যাদা রক্ষায় পরিবার তাতে রাজি হয়নি। “আমার ছেলের গায়ে যেন আর কেউ হাত না দেয়। সে শহীদ হয়েছে, আমি চাই আল্লাহ যেন তাকে আখিরাতে শহীদের মর্যাদা দেন,” বলেন মহিউদ্দিন।

ইয়ামিনের হত্যার ঘটনা নিয়ে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং ছাত্র সমাজ সোচ্চার হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলাও গৃহীত হয়েছে। তবে এক বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

মহিউদ্দিন বলেন, “আমরা অপেক্ষা করছি। কিন্তু কতদিন? আমার ছেলে যে হত্যা হয়েছে, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। ভিডিও আছে, সাক্ষী আছে। বিচার কেন হচ্ছে না?”

এই প্রশ্ন শুধু এক বাবার নয়, এটি আজকের বাংলাদেশের তরুণদের পক্ষ থেকেও। কারণ ইয়ামিন শুধু একজন ছাত্র নয়, হয়ে উঠেছেন একটি সময়ের প্রতীক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক সাহসী কণ্ঠস্বর।

এক বছর পরও সাভারে আয়োজিত স্মরণসভায় বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, শিক্ষার্থীরা তার ছবি হাতে দাঁড়ায়। মোমবাতি জ্বালিয়ে বলে, “তোমার রক্ত বৃথা যেতে দেই না, ইয়ামিন ভাই।”

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • উন্নত চিকিৎসা করাতে না পেরে বন্ডে সই, ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু
  • সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৭ জনের দাফন সম্পন্ন
  • ‘হাসপাতালে দেখি ছেলের নিথর দেহ, রক্তে ভেজা’