নবীজি (সা.)-এর ‘পেটে পাথর বাঁধা’ হাদিসের ব্যাখ্যা কী
Published: 22nd, September 2025 GMT
নবীজি (সা.)-এর জীবন ছিল ত্যাগ, ধৈর্য ও সহ্যশীলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবনে ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যের ঘটনা অনেকবার এসেছে, যা মুসলিম উম্মাহকে শিক্ষা দেয় যে দুনিয়ার অভাব-অনটন সত্ত্বেও আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে।
একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা হলো নবীজি (সা.)-এর পেটে পাথর বাঁধা, যা ক্ষুধার তীব্রতার প্রতীক। এই ঘটনা কীভাবে ঘটেছে, এর অর্থ কী এবং এর সত্যতা কতটুকু—সে সম্পর্কে আমাদের সমাজে ব্যাপক বিভ্রান্তি লক্ষ করা যায়। আমরা আজ সে বিষয়টি তুলে ধরছি।
ক্ষুধায় পেটে পাথর বাঁধা হতো কেননবীজি (সা.
এই আয়াত নবীজি (সা.)-এর জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত, কারণ তাঁর ক্ষুধা সত্ত্বেও আল্লাহ তাঁকে অলৌকিক সাহায্য প্রদান করতেন। পেটে পাথর বাঁধা এমনই একটি ঘটনা, যা ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করার একটি উপায় ছিল। এটি শুধু শারীরিক কষ্টের প্রতীক নয়, বরং মানসিক দৃঢ়তা এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলেরও প্রমাণ।
পেটে পাথর বাঁধার অর্থ হলো, ক্ষুধার কারণে পেট খালি হয়ে যাওয়ায় মেরুদণ্ড সোজা রাখতে অসুবিধা হয়। পেট পিঠের সঙ্গে লেগে যাওয়ায় দাঁড়ানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। পাথর বাঁধলে পেটের শূন্যস্থান পূরণ হয় এবং মেরুদণ্ড সোজা রাখা সহজ হয়।
এটি আরবদের মধ্যে একটি সাধারণ প্রথা ছিল, যা ক্ষুধার তীব্রতা কমাতে সাহায্য করত। নবীজি (সা.)-এর এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে তিনি সাহাবিদের সঙ্গে সমানভাবে কষ্ট সহ্য করতেন, যা তাঁর নেতৃত্বের একটি উজ্জ্বল দিক।
আরও পড়ুনউষ্ণতা বাড়লে নবীজির ৭ সুন্নাহ২৫ আগস্ট ২০২৫হাদিসের বর্ণনা এবং প্রসঙ্গনবীজি (সা.)-এর পেটে পাথর বাঁধার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হাদিসটি খন্দক বা পরিখার যুদ্ধের প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘খন্দক খননের সময় রাসুল (সা.) ও সাহাবিরা তিন দিন অনাহারে ছিলেন। এ সময় তাঁরা কোনো খাবারের স্বাদ গ্রহণ করেননি।
খননকালে একবার বৃহদাকার এক পাথর খননে সমস্যা সৃষ্টি করল। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, এখানে বৃহদাকার এক পাথর!” রাসুল (সা.) বললেন, “পানি ছিটিয়ে দাও তার ওপর।” সাহাবায়ে কেরাম পানি ছিটিয়ে দিলেন। রাসুল (সা.) এলেন। নিজ হাতে গাঁইতি ধরলেন। “বিসমিল্লাহ” বলে তিনবার আঘাত করলেন। পাথরখণ্ডটি বিচূর্ণ বালুকারাশিতে পরিণত হয়ে গেল।’
জাবির (রা.) বলেন, ‘হঠাৎ আমার রাসুল (সা.)-এর পেটের দিকে চোখ পড়ল। দেখলাম, তিনি পেটে পাথর বেঁধে রেখেছেন।’ হাদিসটি সহিহ বুখারি ছাড়াও মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, মুসনাদে আহমাদ, তবরানির আল-মু’জামুল আওসাত, বায়হাকির দালায়েলুন নুবুওয়্যাহ প্রভৃতি কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। (আহমাদ ইবনে হাম্বল, মুসনাদে আহমাদ, ২২/১২১, মুআসসাসা আর রিসালা প্রকাশনী, বৈরুত, ২০০১)
রাসুল (সা.) এলেন। নিজ হাতে গাঁইতি ধরলেন। “বিসমিল্লাহ” বলে তিনবার আঘাত করলেন। পাথরখণ্ডটি বিচূর্ণ বালুকারাশিতে পরিণত হয়ে গেল।’আরেকটি হাদিসে আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আবু তালহা (রা.) তাঁর স্ত্রী উম্মে সুলাইম (রা.)-এর কাছে আসলেন। তিনি বললেন, “উম্মে সুলাইম, তোমার কাছে খাবার মতো কিছু আছে? আমি রাসুল (সা.)-এর ওখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি আসহাবে সুফফাকে সুরা নিসার পাঠদান করছিলেন—দেখলাম, ক্ষুধার কারণে তিনি পেটে পাথর বেঁধে রেখেছেন।”’
হাদিসটি তাবারানির মু’জামুল আওসাত ও মু’জামুল কাবির, বায়হাকির দালায়েলুন নুবুওয়্যাহ এবং আবু নুয়াইমের দালায়েলুন নুবুওয়্যাহ কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। (সুলাইমান ইবনে আহমাদ আততবরানি, আল-মু’জামুল আওসাত, ৩/৩১৮, দারুল হারামাইন প্রকাশনী, কায়রো, ১৯৯৫; আবু নুয়াইম আল-আসবাহানি, দালায়েলুন নুবুওয়্যাহ, ১/৪১৬, দারুন নাফায়েস প্রকাশনী, বৈরুত, ২০০২)
বোঝা যায় যে নবীজি (সা.)-এর ক্ষুধা কেবল খন্দক যুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অন্যান্য সময়েও তাঁর এবং সাহাবিদের কষ্টের ঘটনা ঘটেছে।
আরও পড়ুনকন্যা ফাতিমাকে নবীজির ৫ উপদেশ০৪ আগস্ট ২০২৫হাদিসের সত্যতা ও ব্যাখ্যাহাদিসটি প্রমাণিত এবং বিশুদ্ধ। তবে কিছু আলেম এর ব্যাখ্যায় মতভেদ করেছেন।
আবু হাতিম ইবনে হিব্বান (রহ.) বলেন, ‘নবীজির সওমে বেসালের (লাগাতার রোজা রাখা) হাদিস প্রমাণ করে যে পেটে পাথর বাঁধার হাদিসগুলো বাতিল, কারণ যে আল্লাহ রোজায়ও তাঁকে আহার করাতেন, তিনি কেন ক্ষুধার্ত রাখবেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘পেটে পাথর বাঁধলে লাভ কী?’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, ৩/৬৬, দারু ইবনে হাযাম প্রকাশনী, বৈরুত, ২০১২)
ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘আবু হাতিমের কিতাবেই ইবনে আব্বাস (রা.)-এর হাদিস রয়েছে যে রাসুল (সা.) বলেছেন, “আমি ক্ষুধার কারণেই বেরিয়েছি।” এটি নবীজির ক্ষুধার প্রমাণ।
পেটে পাথর বাঁধার লাভ হলো মেরুদণ্ড সোজা রাখা, কারণ খালি পেট পিঠের সঙ্গে লেগে যায় এবং দাঁড়ানো কষ্টকর হয়। পাথর বাঁধলে শূন্যস্থান পূরণ হয়।’ (ফাতহুল বারী শারহু সহিহ আল-বুখারি, ৭/২৫৫, দারুল মারিফাহ প্রকাশনী, বৈরুত, ১৩৭৯ হি.)
পেটে পাথর বাঁধার লাভ হলো মেরুদণ্ড সোজা রাখা, কারণ খালি পেট পিঠের সঙ্গে লেগে যায় এবং দাঁড়ানো কষ্টকর হয়। পাথর বাঁধলে শূন্যস্থান পূরণ হয়।ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.), ফাতহুল বারী শারহু সহিহ আল-বুখারিতাজ উদ্দিন সুবকি (রহ.) বলেন, ‘আবু হাতিমের বক্তব্য প্রশ্নবিদ্ধ। নবীজি (সা.)-এর ক্ষুধা কোনো দোষ নয়, বরং মর্যাদা বৃদ্ধিকারী। আল্লাহ তাঁকে বিভিন্ন অবস্থায় রাখতেন—কখনো ক্ষুধার্ত, কখনো অলৌকিক আহার দিয়ে। ক্ষুধা নবীজির “আবদিয়্যাত” এবং মর্যাদার প্রমাণ।’ (আত–তাবাকাতুশ শাফিইয়্যা আল-কুবরা, ১/১২৩, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ প্রকাশনী, বৈরুত, ১৯৯৯)
হাদিসের শিক্ষানবীজি (সা.)-এর পেটে পাথর বাঁধা কেবল ক্ষুধার কষ্টের বর্ণনা নয়, বরং ধৈর্যের প্রতীক। এটি দেখায় যে নবীজি সাহাবিদের সঙ্গে সমান কষ্ট সহ্য করতেন, যা তাঁর নেতৃত্বের সৌন্দর্য। কোরআনে বলা হয়েছে: ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদ, জীবন এবং ফল-ফসলের ক্ষতি দিয়ে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫)
এই ঘটনা মুসলিমদের শেখায় যে অভাবে ধৈর্য ধরলে আল্লাহর রহমত আসে। হাদিসগুলো বিশুদ্ধ এবং আলেমদের মতামত এর গভীরতা বাড়ায়। আজকের যুগে এটি আমাদের স্মরণ করায় যে দুনিয়ার কষ্ট সাময়িক, আখিরাতের প্রতিদান চিরস্থায়ী।
আরও পড়ুননবীজির (সা.) আচরণ পরীক্ষা৩০ আগস্ট ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই ঘটন র জ বন এর প ট নব জ র আল ল হ করত ন য করত আহম দ
এছাড়াও পড়ুন:
ঘরে ঢুকে যুবকের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে এক যুবককে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় এক ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ।
নিহত ব্যক্তির নাম মো. ইউনুছ (৩৫)। তিনি উপজেলার হাজিগাঁও কর্ণফুলী কটন মিল এলাকার এয়াকুব আলীর ছেলে। তিনি পেশায় দিনমজুর। গত বুধবার রাতে মাথার আঘাত নিয়ে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।
স্থানীয় বাসিন্দারা ও পুলিশ জানায়, এলাকায় অটোরিকশার ব্যাটারি চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বুধবার রাত আটটার দিকে ইউনুছের সঙ্গে মো. নিলয় নামে স্থানীয় এক বাসিন্দার কথা-কাটাকাটি হয়। এরই জেরে রাতে মো. নিলয় ও তাঁর এক সহযোগী ঘরে ঢুকে মো. ইউনুছের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন। এরপর গুরুতর আহত অবস্থায় ইউনুছকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন পরিবারের সদস্যরা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
এদিকে ইউনুছের ওপর হামলার পর তাঁর প্রতিবেশীরা মো. নিলয়কে ধরে পিটুনি দেন। আহত অবস্থায় তাঁকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে আটক করে।
মো. ইউনুছের মৃত্যুর বিষয়টি আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনির হোসেন প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রাতেই হাসপাতাল থেকে অভিযুক্ত নিলয়কে আটক করেছি। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন।’