দেড় কোটি প্রবাসীর ভোট নিয়ে আমরা কি ভাবছি
Published: 7th, April 2025 GMT
বাংলাদেশে নির্বাচনের দাবিতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছুটা মতভিন্নতা চলছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের জন্য একটি সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেছে।
কয়েক মাস আগে বা পরে নির্বাচন বাংলাদেশে হবে। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনে বিদেশে থাকা আমাদের ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে আমাদের ভাবনাটা কী?
বাংলাদেশের কতজন নাগরিক প্রবাসে আছেন, তার সর্বশেষ সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের প্রবাসী–সংক্রান্ত তথ্য যে কোনটি সঠিক, সেটি নির্ণয় করা আরও কঠিন।
২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর ‘প্রবাসীর সংখ্যা আসলে কত’ শিরোনামে বণিক বার্তার প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, বিবিএসের জনশুমারি অনুযায়ী, প্রবাসীর সংখ্যা ৫০ লাখ ৫৩ হাজার; বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি ২৫ লাখ; বিএমইটিএর তথ্যমতে, ১ কোটি ৪৮ লাখ এবং জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ১ কোটি ৫৫ লাখ।কোনটি যে সঠিক, কে জানে?
এর চেয়ে দুঃখজনক কী আছে, যে প্রবাসীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, জীবিত হিসেবে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে এসে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখেন, তাঁদের প্রকৃত হিসাব আমরা জানি না!
আরও পড়ুনগণতন্ত্রে ফিরতে চাইলে নির্বাচন ছাড়া পথ কী১৭ মার্চ ২০২৫অথচ ডেইলি স্টার বাংলার এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এই প্রবাসীরাই ২০২৪ সালে ২৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। কিন্তু আপনি যদি অনানুষ্ঠানিক পথে পাঠানো টাকাকে বিবেচনা করেন, তাহলে এর পরিমাণ যে ঢের বেশি।
বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের নানা অভিযোগ বা সমস্যার বিষয় নিয়ে অনেক প্রতিবেদন হয়। হাজারো প্রবাসী প্রতিবছর লাশ হয়ে ফিরে আসেন।
অনেকের ভাগ্যে হয়তো দেশের মাটিটুকুও জোটে না। অনেকে প্রবাসে অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটান। মানবেতর পরিবেশে জীবন কাটান।
আমাদের রাজনীতিতে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। নির্বাচন এলে কিংবা বিশেষ কোনো দিবসে প্রবাসীদের সুবিধার বিষয়ে নানা প্রতিশ্রুতি শুনতে পাই।
কিন্তু বাস্তবে প্রবাসীরা কতটা সহযোগিতা আসলে পাচ্ছেন, সেই বিষয়ে আমরা কি কখনো তাঁদের কথা শুনেছি? আমরা কি তাঁদের যোগ্য সম্মান বা মর্যাদাটুকু দিই?
প্রতিশ্রুতির সঙ্গে আমরা কি মাঠের বাস্তবতাকে কখনো মিলিয়ে দেখেছি?
আরও পড়ুননির্বাচনে বিভিন্ন দলের অবস্থান কেমন হতে পারে ২২ মার্চ ২০২৫এই যে আমাদের এত বড়সংখ্যক লোক স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের সময়ে প্রবাসে থাকেন, তাঁরা কীভাবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, সেই বিষয়ে আমরা কি ভেবেছি? আমাদের প্রস্তুতি আছে কি?
প্রবাসীদের ভোটাধিকার সুযোগ প্রদানের সঙ্গে জড়িত আছে নাগরিক হিসেবে তাঁদের যথার্থ মর্যাদা প্রদানের বিষয়। তাঁদের সম্মান জানানোর বিষয়।
তাঁদের কথাও আমাদের পলিসিতে অন্তর্ভুক্তি করার বিষয়। দেড় কোটি প্রবাসীকে ভোটাধিকারের বাইরে রেখে কি সত্যিকার অর্থেই অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা সম্ভব?
পৃথিবীর অনেক দেশের নাগরিকেরা বিদেশে অবস্থানকালে নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা প্রবাসে থাকাকালীন ডাকযোগে (অ্যাবসেন্টি ব্যালট), ই-মেইল/ফ্যাক্স (কিছু অঙ্গরাজ্যে), সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য অনলাইন ভোটিংয়ের সুযোগ পান।
আরও পড়ুননির্বাচনী ট্রেনের ট্র্যাক ঠিক করতে যা করা দরকার০৫ এপ্রিল ২০২৫যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী ভোটারদের নির্বাচনে কতটা ভূমিকা রাখতে পারেন, তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্বাচিত হওয়া।
কেননা, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রবাসী মার্কিন ভোটারদের বড় একটি ভূমিকা ছিল।
যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরা প্রবাসে থাকাকালে ডাকযোগে (পোস্টাল ভোটিং), প্রক্সি ভোটিং (নিয়োগকৃত প্রতিনিধি দ্বারা), কিছু ক্ষেত্রে ই-মেইলে ব্যালট পাঠানোর সুযোগ পান।
ফ্রান্সের প্রবাসী নাগরিকেরা দূতাবাসে সরাসরি ভোট প্রদান, অনলাইন ভোটিং (কিছু নির্বাচনে) ও প্রক্সি ভোটিংয়ের সুযোগ পান।
জার্মানি ও কানাডার প্রবাসীরা ডাকযোগে ভোট দিতে পারেন। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী নাগরিকেরা ডাকযোগে, দূতাবাসে সরাসরি ভোট প্রদান, কিছু ক্ষেত্রে অনলাইনের মাধ্যমে ভোট প্রদানের সুযোগ পান। অন্যদিকে এস্তোনিয়া বিশ্বের প্রথম দেশ, যেখানে নাগরিকদের অনলাইনে (আই–ভোটিং) ভোট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ তার প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নের জন্য কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেবে নাকি একাধিক ব্যবস্থা করবে, সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। গবেষণা হতে পারে।
যদিও দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ তাদের প্রবাসীদের জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিতে পারেনি। কিন্তু অন্যরা পারেনি বলে আমরা কেন পারব না? আমরা কেন সবার আগে এই সুযোগ প্রদানের মধ্য দিয়ে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করব না? সত্যিকার অর্থেই যদি আমরা নাগরিক গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে চাই, দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সম্মান জানাতে চাই, তবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রদানের ব্যবস্থা করাই হতে পারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়।তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অনলাইনে ভোটের সুবিধা কিংবা প্রতিনিধির মাধ্যমে ভোট (প্রক্সি ভোটিং) সবচেয়ে ভালো হতে পারে। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, ডাকযোগে কেন নয়?
বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় ডাকযোগে ভোট দিলে তা নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছানো নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
তবে এটাও ঠিক, অনলাইনে ভোটিংয়ের চ্যালেঞ্জ কম নয়। কেননা অনলাইন ভোটিং নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক রয়েছে।
বিতর্ক কিন্তু সরাসরি ভোট নিয়েও কম নয়। কাজেই প্রতিটি ব্যবস্থারই কোনো চ্যালেঞ্জ বা সীমাবদ্ধতা থাকবে। তবে সেই সীমাবদ্ধতা কমানোর জন্য এখন বিকল্প ব্যবস্থাও রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে এস্তোনিয়ার অনলাইন ভোটিং সিস্টেম হতে পারে প্রমাণিত উদাহরণ। এ ছাড়া অনলাইনের বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে ব্লক চেইনের মতো প্রযুক্তি অনেকটাই কার্যকর।
আরও পড়ুনপ্রবাসীদের শূন্য হাতে ফেরা ০১ এপ্রিল ২০২৫সারা পৃথিবীর ব্যাংকিং কার্যক্রম এখন অনলাইনে হতে পারলে, ভোট হতে সমস্যা কোথায়?
বাংলাদেশ যদি প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করে, তা পরবর্তী সময় স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়েও ব্যবহার করা যাবে।
কেননা মানুষ যখন ঘরে বসে নিজের সুবিধামতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। এটি একদিকে যেমন ই-পার্টিসিপেশন বাড়াবে, অন্যদিকে নির্বাচন আয়োজনের খরচও কমবে।
এ ছাড়া কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতাও কমে আসবে। প্রকৃতপক্ষেই তা জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করবে।
যদি এমন হয়, আসন্ন নির্বাচন আয়োজনের আগে প্রবাসীদের অনলাইনে ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে প্রবাসীর পক্ষে প্রতিনিধির (মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান বা তাঁর মনোনীত কোনো ব্যক্তি) মাধ্যমে প্রক্সি ভোটিংয়ের সুযোগ প্রদান করা যেতে পারে।
এতে করে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও প্রবাসীদের অধিকার সুরক্ষা এবং তাঁদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উদ্যোগী হবেন।
প্রবাসীদের অধিকার রাজনীতির ফাঁকা বুলির পরিবর্তে সত্যিকার পলিসি টেবিলে জায়গা করে নেবে। কেননা এই দেড় কোটি প্রবাসী ভোট-ই হতে পারে বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের অন্যতম প্রভাবক।
উপরোক্ত প্রস্তাবে নিশ্চয়ই কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কিংবা এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প হতে পারে। সে বিষয়েও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ বিষয়ে এখনো উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
যদিও দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ তাদের প্রবাসীদের জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিতে পারেনি। কিন্তু অন্যরা পারেনি বলে আমরা কেন পারব না?
আমরা কেন সবার আগে এই সুযোগ প্রদানের মধ্য দিয়ে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করব না?
সত্যিকার অর্থেই যদি আমরা নাগরিক গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে চাই, দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সম্মান জানাতে চাই, তবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রদানের ব্যবস্থা করাই হতে পারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়।
মো.
ইমরান আহম্মেদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকের পলিটিকস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিভাগের পিএইচডি গবেষক।
ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রব স দ র ভ ট ধ ক র র ব যবস থ র প রব স প রব স র র র জন ত আম দ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে আজ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
এ বছর প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছয় রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারা ঢাকা থেকে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যোগ দেন।
এছাড়া জামায়াত নেতা নকিবুর রহমান তারেক যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিনিধি দলে যুক্ত হন।
এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর রাত ১টা ৪০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময়) প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা দেয়।
সূচি অনুযায়ী অধ্যাপক ইউনূস আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন।