চুরি-ছিনতাই কমাতে কমিউনিটি পুলিশিং জোরদার করা জরুরি
Published: 24th, October 2025 GMT
আধুনিক সমাজে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং জনগণের আস্থা অর্জন ও অংশীদারিমূলক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটে ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ ধারণাটি বাংলাদেশে দিন দিন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ পুলিশ কয়েক বছর ধরে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম সম্প্রসারণে কাজ করছে। বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি থানা ও ইউনিয়নে কমিউনিটি পুলিশিং ফোরাম গঠিত হয়েছে। সন্ত্রাস, মাদক, কিশোর গ্যাং, নারী নির্যাতন, সাইবার অপরাধসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যায় জনগণ ও পুলিশের যৌথ উদ্যোগে কাজ চলতে দেখা যাচ্ছে।
তবে বাস্তবতার আলোকে এই কার্যক্রম এখনো প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। রাজনৈতিক মেরুকরণ, অবিশ্বাস এবং অপর্যাপ্ত সম্পদের কারণে জনগণের সঙ্গে পুলিশের কার্যকর অংশীদারি গড়ে উঠতে সময় লাগছে।
কমিউনিটি পুলিশিং ধারণাটি সরাসরি আইনশাস্ত্রের কোনো ধারায় উল্লেখ নেই, তবে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর বেশ কিছু ধারা জনগণের অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভিত্তি তৈরি করছে। যেমন ৪২-৪৪ ধারাতে জনগণের কর্তব্য পুলিশকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, অপরাধী বা জননিরাপত্তার হুমকি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তথ্য দেওয়া এবং প্রয়োজনে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া জনগণকে চুরি, দস্যুতা ও ডাকাতি–সংক্রান্ত অপরাধ ও অন্যান্য কিছু অপরাধ সংঘটনের তথ্য পুলিশের কাছে সরবরাহ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশি কার্যক্রমের ভিত্তি পিআরবি-এর ৩২ বিধিতে পুলিশকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের সহযোগিতা গ্রহণ এবং তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং সেই লক্ষ্যে সহযোগিতা সভার আয়োজন করতে বলা হয়েছে।
৩৩ নম্বর বিধিতে স্থানীয় জনগণের সহিত সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই দুটি বিধি প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিটি পুলিশিং সংক্রান্ত কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে (২০০৬ ও ২০১০ সালে) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম চালু ও সম্প্রসারণ করা হয়।
এসব আইনি ভিত্তি কমিউনিটি পুলিশিংকে একটি বৈধ ও কাঠামোবদ্ধ রূপ দান করেছে।
স্থানীয়ভাবে ছাত্র ও জনগণকে যুক্ত করলে কমিউনিটি পুলিশিং আরও কার্যকর হতে পারে। এতে বাল্যবিবাহ কমানো, ইভ টিজিং প্রতিরোধ, সন্ত্রাস দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মব-সন্ত্রাস রোধে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব। এই সহযোগিতা কাজে লাগানোর মতো বড় সুযোগ এখন রয়েছে।কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়নে কয়েকটি বড় বাধা আছে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিকেরা এতে যুক্ত হওয়ায় দলীয় প্রভাব ঢুকে পড়েছে। কিছু পুলিশ কর্মকর্তা স্বেচ্ছাচারিতা করেন, ঘুষ ও দুর্নীতি করেন—এ কারণে পুলিশের ওপর মানুষের ভয় ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। যারা কমিউনিটি পুলিশিংয়ে কাজ করেন, তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। ফোরামের নেতা ও সদস্যদের অনেকেই নিজের দায়িত্ব কী, তা ভালো করে জানেন না। অনেকে আবার নিজেরা ফৌজদারি অপরাধের মতো অ-আপসযোগ্য মামলাতেও হস্তক্ষেপ করতে চান।
এ কাজে আলাদা সরকারি বাজেট বা অর্থ বরাদ্দ নেই। লজিস্টিকসেরও অভাব আছে। কিছু অপরাধী নানা কৌশলে কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সদস্য হয়ে যায়। তাদের অনেকের মাদক প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ রোধ, কিশোর অপরাধ দমন ও সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় সক্ষমতা কম। জুলাই বিপ্লবের পর নতুন রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতাও এ প্রক্রিয়ায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
জুলাই বিপ্লবের পরের ২-৩ দিন বাংলাদেশ প্রায় সরকারবিহীন ছিল। সে সময় মানুষ পুলিশের অভাব খুব স্পষ্টভাবে টের পেয়েছে। বিভিন্ন পাড়ায় মানুষ নিজেরাই রাতে পাহারা দিয়েছে। ছাত্ররা রাস্তায় নেমে ট্রাফিক সামলেছে। এসব ঘটনা দেখায় যে অপরাধ দমনে সাধারণ মানুষ পুলিশের কাজে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
স্থানীয়ভাবে ছাত্র ও জনগণকে যুক্ত করলে কমিউনিটি পুলিশিং আরও কার্যকর হতে পারে। এতে বাল্যবিবাহ কমানো, ইভ টিজিং প্রতিরোধ, সন্ত্রাস দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মব-সন্ত্রাস রোধে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব। এই সহযোগিতা কাজে লাগানোর মতো বড় সুযোগ এখন রয়েছে।
লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা (পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের দুই দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী) আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থার জনক স্যার রবার্ট পিল ১৮২৯ সালে সাধারণ পুলিশিংয়ের জন্য অসাধারণ ৯টি নির্দেশনা প্রদান করেন। এই ৯ নীতিকে বাংলাদেশ কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে:
১.
২. পুলিশ তার ক্ষমতা জনগণের সম্মতি ও সহযোগিতা থেকে লাভ করে।
৩. জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা পুলিশকে আইন প্রয়োগে সফল করে।
৪. জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারলেই তারা পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে।
৫. পুলিশকে সব সময় নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং জনমতের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে।
৬. বল প্রয়োগ করা হবে কেবল তখনই যখন সব শান্তিপূর্ণ উপায় ব্যর্থ হয়।
৭. পুলিশ শাসকের মতো নয়—জনগণের বন্ধু ও সেবকের মতো আচরণ করবে।
৮. পুলিশের উদ্দেশ্য হলো অপরাধ সংঘটনের আগে তা প্রতিরোধ করা; কেবল ঘটার পর শাস্তি দেওয়া নয়।
৯. পুলিশের সাফল্য অপরাধ কমার মাধ্যমে প্রমাণিত হবে; গ্রেপ্তার বাড়ার মাধ্যমে নয়।
বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যকর করতে কিছু বাস্তব কৌশল প্রয়োজন। এর জন্য এমন সামাজিক ব্যক্তিদের যুক্ত করতে হবে, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এবং সরকার পরিবর্তন হলেও দেশে থাকবেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। থানা ও ফাঁড়ির পুলিশের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কমিউনিটি পুলিশিং-অ্যাপ, হটলাইন, অনলাইন রিপোর্টিং ইত্যাদিসহ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। জনগণের সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত প্রচার ও কার্যক্রম চালাতে হবে।
এলাকার অপরাধের ধরন এবং জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য বুঝে সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা ও নীতি করতে হবে।
মো. শাহ্জাহান হোসেন পিপিএম; উপ-পুলিশ কমিশনার; ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ডিভিশন; ডিএমপি।
ই–মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জনগণ র স র জন ত ক সন ত র স সহয গ ত ক র যকর র অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
অদ্ভুত চেয়ার
শাসক যখন চেয়ারে বসেন, তার চোখ মাছের চোখের মতো জ্বলজ্বলে হয়ে যায়। চেয়ারটি স্থির থাকে। শাসক কথা বলার সময় হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেন। যেন এই জগৎ–সংসারে তার পূর্ববর্তী শাসকেরা যেসব ভুল করে গেছেন, তিনি তা শোধরাতে এসেছেন। শাসকের কথা শুনলে মনে হয়, তিনি কোনো ভুল করতে পারেন না। তার বর্ণনায় যেকোনো শাসক বড় দুর্বল প্রমাণিত হয়। কিন্তু আমার ভালো লাগে তার চেয়ার। একদিন চেয়ারটি খালি পেয়ে বসে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটি ঘুরতে শুরু করল। দেখলাম জগৎ ঘুরছে। আমার চিৎকার শুনে ধীরে–স্থিরে শাসক ঘরে প্রবেশ করলেন।
‘চেয়ারটি কেমন?’
‘আগে ঘূর্ণন থামান, তারপর বলছি।’
‘আমি আগেই জানতাম, তুই এই চেয়ারে বসতে চাস। শাসক হতে চাস। আমি যখন কথা বলি, তুই আমার কথা না শুনে চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকিস, তখনই বুঝতে পারি।’
‘আপনি ভুল জানেন, আমি এই চেয়ারে বসতে চেয়েছি ঠিকই, শাসক হতে চাইনি।’
‘এই চেয়ারে কেবল একজন শাসক বসতে পারেন।’
‘কিন্তু এর আগে আমি আপনার ছেলেকে বসতে দেখেছি, মেয়েকে বসতে দেখেছি। তাদের তো কোনো সমস্যা হয়নি।’
‘ওদের নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস তোকে কে দিল? এটা নিয়ে প্রশ্ন তুললে জনগণ প্রশ্ন তুলবে?’
‘আমিও তো জনগণ।’
‘না, তুই জনগণ না, আমার কর্মচারী।’
‘আপনার চেয়ারের দোহাই লাগে চেয়ারের ঘূর্ণন থামান।’
‘তোর চোখমুখ দিয়ে যখন রক্ত উঠবে, তখন চেয়ার থেমে যাবে। এক ফোঁটা রক্ত চেয়ারে পড়তে দে। চিৎকার কর। কেউ তোর চিৎকার শুনবে না। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিয়েছি, যাতে বাইরে থেকে আর কেউ তোর চিৎকার শুনতে না পায়। চিৎকার মানুষের হৃদয়ে খুব সহজে পৌঁছে যায়। এটা তো হতে দেওয়া যাবে না।’
‘শাসক, আমার কথা বোঝার চেষ্টা করুন। আমি খুব বেশি সময় কাঁদতে পারি না। আমার শরীর থেকে সহজে রক্তও বের হয় না।’
‘ও তা–ই। তাহলে তো তোকে বাঁচার একটা উপায় খুঁজে দিতেই হয়। নে, এবার হাসতে থাক। পারবি না?’
‘পারব।’
শাসকের কথা শুনলে মনে হয়, তিনি কোনো ভুল করতে পারেন না। তার বর্ণনায় যেকোনো শাসক বড় দুর্বল প্রমাণিত হয়। কিন্তু আমার ভালো লাগে তার চেয়ার। একদিন চেয়ারটি খালি পেয়ে বসে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটি ঘুরতে শুরু করল। দেখলাম জগৎ ঘুরছে। আমার চিৎকার শুনে ধীরে–স্থিরে শাসক ঘরে প্রবেশ করলেন। ‘চেয়ারটি কেমন?’আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম। মনে হলো আমার মা একটি ঘুঙুর বাজাচ্ছেন। আমি হাসছি। বাবা বাজার থেকে আষাঢ় মাসের আম নিয়ে ফিরছেন। মা সেই আম কাটছেন। তার চোখ চিকচিক করছে। আমি ভাবলাম আর হাসলাম। আমার শাসক দরজা-জানালা সব খুলে দিলেন। অনেক মানুষ জড়ো হলো ঘরের ভেতর। আমাকে চেয়ারে বসা দেখে তারা শাসকের মহানুভবতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। হাততালির শব্দ পড়ল। শাসকের চেয়ারে আমি তখনো ঘুরছি। আমার ছবি তোলা হলো। ভিডিও করা হলো। আমি তখনো ঘুরছি। আমার আর হাসি আসছিল না। এবার আমি এক গ্লাস রক্ত চাইলাম। শাসকের আগের শর্তে ফিরে যেতে চাইলাম। আমার পূর্বনারীদের মতো, পূর্বপুরুষদের মতো। মনে হলো শাসকের আগের শর্তই ভালো ছিল। এক গ্লাস রক্ত চাইলাম, যাতে চেয়ারে ঢেলে দিতে পারি। কিন্তু তারা ভাবল, আমি পানি চাচ্ছি। শাসক বলল ফলের রস দিতে। কালো জামের রস আনা হলো আমার জন্য। ভাবলাম, চেয়ারের ঘূর্ণন থামিয়ে আমাকে নামিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু কেউ আমাকে নামাল না। তারা ঘূর্ণন থামার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। মনো হলো আমি একাই দুটি মোরগে পরিণত হলাম। একটি মোরগ আরেকটি মোরগকে ঠোকর দিয়ে যেমন রক্তাক্ত করে, এবার নিজেই নিজেকে সেভাবে রক্তাক্ত করার পালা। নিজেকে ঠোকরাতে থাকলাম, রক্ত বের হয়ে শরীরেই শুকিয়ে গেল, চেয়ারে পড়ল না। আমি চোখ বন্ধ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কিছু সময়ের মধ্যেই অচেতন হলাম। মানুষের হাসি কিংবা হাততালির শব্দ আমার কানে পৌঁছাতে পারল না। এরপর নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটি ধবধবে পরিষ্কার বিছানায়। শাসকের হাতে কালো জামের রসভর্তি গ্লাস। তিনি আমাকে এক গ্লাস জামের রস পান করালেন। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
শাসক একা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। বলে চললেন, ‘বাইরে ঝড় হয়েছে। ঝড়ের পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু এই ঝড়ে অনেক পাখির ডানা ভেঙে গেছে। অনেক পাখি পালক হারিয়েছে। কোনো কোনো পাখির বাসা ভেঙে পড়েছে। মৃত ছানাদের জন্য ছটফট করছে মা পাখি। স্কুলগামী ছেলেটা জুতার ফিতাটা আরও ভালোভাবে গিঁট দিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ঝড় হলে আয়নাগুলো আরও স্বচ্ছ হয়। হয়েছেও তা–ই।’
‘আপনার চোখও স্বচ্ছ হয়েছে।’
‘বলছিস?’
‘জি।’
‘তাহলে এবার আমি তোকে আমার চেয়ারে বসতে দেব। অল্প সময়ের জন্য বসলেই দেখবি অসংখ্য চোখ। চোখগুলো ঘৃণায় ভরা, অথচ তারা ভালোবাসার গল্প বলছে।’
‘না, না, আমি আর ওই চেয়ারে বসতে চাই না।’
‘বোকা, চেয়ারে বসে সামনে হেলে পড়েছিলি কেন?’
‘আপনিও তো হেলে বসেন। তাতে তো কোনো সমস্যা হয় না।’
‘শোন, আমি এমন এক শহরে বড় হয়েছি, যে শহরটি অনেক পুরোনো স্থাপনা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা স্থাপনা আরেকটা থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। তাই কখনো কোনো স্থাপনা ভেঙে পড়লে পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারত না। একবার ভূমিকম্প হলো। পুরো শহর কেঁপে উঠল। স্থাপনাগুলো ভেঙে গেল। মানুষগুলো সেই সব স্থাপনার ভেতর থেকে বের হয়ে এল কাটা হাত, পা, মাথা, কপাল নিয়ে, আর মৃতরা পড়ে রইল ধ্বংসস্তূপের ভেতর। শহরের বুকের এক পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটিতে তখন স্রোত আরও বেগবান হলো। তবু লাশগুলো পড়ে রইল। আমার পিতা তখন ওই শহরের শাসক ছিলেন। সেই লাশ উদ্ধার না করে শহরটি ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। বললেন, “শহরে আপাতত কোনো মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। এটি এখন থেকে জাদুঘর হিসেবে বেবেচিত হবে।” আমরা বিশ্বাস করলাম। জাদুঘর দেখাশোনার জন্য লোক নিয়োগ দেওয়া হলো। তারা দিনরাত পরিশ্রম করে সেই পরিত্যক্ত শহরে ফুল ফোটাল। আমরা ভুলে গেলাম, ধ্বংসস্তূপের নিচে শুধু লাশ ছিল না, অনেক জীবিত মানুষও ছিল।
‘শহরটি যেদিন ধসে পড়েছিল, আমি সেদিন শহরে ছিলাম না, পিতার সঙ্গে দূরে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। এসে দেখি, আমাদের প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে মা নেই। মায়ের পায়ের জুতা জোড়া একটা জায়গায় পড়ে আছে। মাকে টেনেহিঁচড়ে হয়তো কোনো ধ্বংসস্তূপের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছে। মাকে হত্যা করে জনগণ তাদের দুঃখ ভোলার চেষ্টা করেছে।‘শহরটি যেদিন ধসে পড়েছিল, আমি সেদিন শহরে ছিলাম না, পিতার সঙ্গে দূরে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। এসে দেখি, আমাদের প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে মা নেই। মায়ের পায়ের জুতা জোড়া একটা জায়গায় পড়ে আছে। মাকে টেনেহিঁচড়ে হয়তো কোনো ধ্বংসস্তূপের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছে। নয়তো এই ধ্বংসের দায় আমার পিতার ওপর চাপিয়ে মাকে হত্যা করে জনগণ তাদের দুঃখ ভোলার চেষ্টা করেছে। আমার পিতা আমাকে বললেন, “শাসকের চেয়ার সব সময় ঘূর্ণনশীল। এটাকে আয়ত্তে রাখতে না পারলে চেয়ারই শাসকের হাড়, মাংসসহ খেয়ে ফেলে।” আমাকে তিনি একটি ঘূর্ণনশীল চেয়ারে বসতে অভ্যস্ত করে তুললেন। প্রথমে মাথা ঘুরত, বমি হত। রক্তবমি হলে দেখতাম চেয়ারটি থেমে যাচ্ছে। পিতা বললেন, “হাসতে শেখো।” আমি হাসতে শিখলাম। ধীরে ধীরে চেয়ারটি আমার বশে এল। কিন্তু সেই ধ্বংসস্তূপ তৈরি হওয়ার পেছনে পিতার দায় ছিল কি না, বলতে পারলাম না। আমি ঘুমিয়ে পড়লেই আমার পিতা কোথায় যেন চলে যেতেন। ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মায়ের কোনো একটি শাড়ির আঁচল নিজের মাথায় টেনে বলতেন, “তোমাকে আজও পেলাম না।” শাসকের দুঃখ বড় গোপন। যে নিজের দুঃখ গোপন করে সে–ই শাসক।
‘আর ইতিহাস? সে তো সব সময় কমপক্ষে তিনটি রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়। জনগণ বেশি হলেও দুটি রাস্তা ব্যবহার করে। আর শাসক ইতিহাস মুছে দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করে। মানুষ ইতিহাস ভুলে না থাকলে তাকে শাসন করা গেলেও শোষণ করা যায় না।’
‘সেই শহর এখন কোথায়?’
‘আমার পিতা তার লাল ডায়েরিতে নিজ হাতে লিখেছিলেন, “ধ্বংসস্তূপের ওপর আরেকটি শহর গড়ে তুলতেই হবে। ইতিহাস থেকে মানুষের দূরত্ব তৈরি করার জন্য এটা প্রয়োজন।”’
এ কথা শোনার পর আমার পা শিরশির করে উঠল। আমি সেই পুনর্নির্মিত শহরে বসবাস করছি, যে শহরের নিচে একটি ধ্বংসস্তূপ রয়েছে। আর ভাবতে পারছিলাম না।
শাসক বললেন, ‘ওই শহরে প্রবেশের একটা পথ রয়েছে। আজ তোকে সেই শহরে নিয়ে যাব।’
‘না, আপনি আমাকে আর ফিরতে দেবেন না।’
‘এমনও তো হতে পারে, তুই নিজেই আর ফিরতে চাইবি না।’
এদিকে শাসক নিজ হাতে আমাকে কালো জামের রস পান করাচ্ছেন, সেই ছবি পত্রিকায় ছাপা হলো। ভিডিও টিভিতে দেখানো হলো। মানুষ আমাকে বলল, ‘আরে তুই তো সৌভাগ্যবান।’
আমি সেই ধ্বংসস্তূপ দেখতে চাই কি না, সেই বিষয়ে শাসক আমাকে আগামী জন্মদিন পর্যন্ত ভেবে সিদ্ধান্ত জানাতে বললেন। শাসকের পিতার লেখা ডায়েরিটা পড়তে চাইলাম। তিনি নিরাশ করলেন না। হাতে পেয়ে পড়লাম। এমন এক পিচ্ছিল রাস্তার বর্ণনা সেখানে আছে, যেই রাস্তায় চলার সময় তিনি তার ছেলের হাত ধরেছিলেন। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম, যাব। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম যাব না। এভাবে একেকবার একেক ভাবনা এসে আমাকে উলট-পালট করে দিয়ে যাচ্ছিল। একদিন ঘরে এসে শুনি, মেঝের মাটি ধসে আমার স্ত্রী, সন্তান মাটির গর্তে ঢুকে গেছে। এবার আর আমার না বলার উপায় থাকল না।