গ্রাফিতিতে ভুল প্রত্যাশা প্রকাশ করা হয়েছিল!
Published: 7th, May 2025 GMT
পরপর তিনটি নির্বাচনী তামাশার মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার পর রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের ৯ মাস পূর্ণ হলো। ১৯৬৯ বা ১৯৯০-এর মতো এবারের গণ-অভ্যুত্থানেও কোনো দলীয় নেতৃত্ব ছিল না। ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, ধর্ম, জাতি, পেশা, বয়সের নারীর অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে অপ্রতিরোধ্য শক্তি দিয়েছিল।
দেয়ালের গ্রাফিতিতে সমাজের বিক্ষুব্ধ মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, দাবি ও প্রত্যাশা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটাই ঘোষণাপত্রের কাজ করেছে। সেখানে কথা, স্লোগান, ছবি, কার্টুনে জাতিগত, লিঙ্গীয়, শ্রেণিগত বৈষম্য এবং নিপীড়ন আধিপত্য স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত এক দেশের প্রত্যাশা প্রকাশিত হয়েছিল।
কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে এর উল্টো তৎপরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। বৈষম্যবাদীদের দাপট বাড়তে থাকে। মাজার-মসজিদ, মন্দির, নারী, শিল্পকর্ম, ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষী ও আক্রমণাত্মক তৎপরতা বাড়ে। ভাস্কর্য, নাটক, গান, মেলা, গ্রন্থাগার ও শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্র বহুবার আক্রমণের শিকার হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জোরজবরদস্তি করে কাউকে বসানো কাউকে নামানো।
নারী শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ, মব সহিংসতা চলতেই থাকে। আগের মতো চাঁদাবাজি দখল আবার শুরু হয়। শ্রমিক আন্দোলনে হামলা-মামলা, এমনকি গুলিও চলেছে। বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে ধরপাকড় চলছে। শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় সরকার ১৮ দফা চুক্তি করলেও তা বাস্তবায়ন করেনি।
নিহত ও আহত ব্যক্তিদের নিয়ে এখনো যথাযথ তালিকা, পুনর্বাসন, চিকিৎসা সম্পন্ন হয়নি। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে যে টালবাহানা চলছে। তার প্রমাণ বাছবিচারহীনভাবে শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা পাইকারি হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলা। আর সঙ্গে অজ্ঞাতনামা শত শত আসামি।
এগুলোতে লাভ হচ্ছে গ্রেপ্তার ও আটক বাণিজ্যে নিয়োজিত ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের। লাভ হচ্ছে আসল খুনি লুটেরাদের এবং শেষমেশ আওয়ামী লীগেরও। ত্রাস ছড়ানোর ফলে বহু শিক্ষা–সংস্কৃতির তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে।
অনেক মামলায় খুব দ্রুত সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু বহুল আলোচিত ত্বকী, তনু, সাগর-রুনি, মুনিয়াসহ বহু মামলার সমাধান হয় না। ফুলবাড়ীতে ১২ বছরের পুরোনো হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার হয় না। শিশুসহ বম মানুষদের ভয়ংকর মিথ্যা মামলা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।
মিথ্যা মামলায় আটক দলিত-হরিজনদের জামিনের শুনানি পর্যন্ত হচ্ছে না। হাসিনা আমলে আদালতে বিচারের রায় কী হবে আমরা বুঝতাম। এখনো কে জামিন পাবে, কে আটকে থাকবে আগেই বোঝা যায়। এই সরকার যে সংস্কার বা পরিবর্তন করতে আগ্রহী, তার প্রকাশটা কোথায়?
বর্তমানে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভেনেজুয়েলা, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়ার মতো বহু দেশে বামপন্থী/সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত দলগুলো নির্বাচন করছে, ক্ষমতায়ও যাচ্ছে। ইউরোপের বহু দেশে ডানপন্থী আক্রমণের মুখে প্রবাসী মানুষ এ রকম দলের ভরসাতেই থাকেন।সংস্কার আর নির্বাচন নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তোলা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারগুলো করতে পারে, সেগুলো করতে বাধা কোথায়? ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে কৃষকের আত্মহত্যা বেড়ে গেছে। হিমাগার, কিংবা সরকারি ক্রয়ের মতো সাধারণ কাজগুলো করলে কৃষকের জন্য বড় একটা পরিবর্তন হয়।
মার্কিন কোম্পানি থেকে এলএনজি আমদানির চুক্তি করা হয়েছে পেট্রোবাংলাকে না জানিয়েই। অথচ আমাদের দরকার এলএনজি আমদানি, কয়লামুখী নীতি থেকে বের হয়ে আসা। তাই গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্ষেত্রে জাতীয় সক্ষমতা বাড়িয়ে এই সম্পদ আমরা যাতে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারি, সেই উদ্যোগ ছিল জরুরি। দরকার ছিল আদানি-রামপাল-রূপপুর চুক্তি বাতিলের রাস্তা তৈরি। ৯ মাসে এসবে সরকারের উদ্যোগ দেখা যায়নি। তারা গত সরকারের নীতিমালা অনুযায়ীই কাজ করে যাচ্ছে।
স্টারলিংকের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। রাখাইনে করিডর এখন উদ্বেগ আর আলোচনার বিষয়। লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে। দেশের মানুষ কিছুই জানে না। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বা বিশেষ সহকারীরা বললেই তো হবে না। দেশের মানুষকে তো জানতে হবে, তাদের জীবন–সম্পদ নিয়ে আসলে কী করা হচ্ছে। স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির ব্যবস্থা না করে পুরোনো পথই কেন সরকারের পছন্দ?
এর মধ্যে ভালো কাজ হয়েছে ১১টা বিষয়ে কমিশন গঠন। সেগুলোর রিপোর্টও এসেছে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন, গণমাধ্যম, প্রশাসন, নারী ও শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেদনগুলোতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ আছে, যেগুলো ৫ আগস্টের পর আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটিরও বক্তব্য ছিল।
যেমন বলেছিলাম, ‘উত্তরাধিকার সূত্রে জমি-সম্পত্তিতে নারীদের সমানাধিকার নিশ্চিত করা এবং সব কাজে সমশ্রমে সমমজুরি নিশ্চিত করার কথা। যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে ২০০৯ সালের হাইকোর্ট নির্দেশনা অবলম্বন করে কারখানা-সচিবালয়সহ সব প্রতিষ্ঠানে “যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা” কার্যকর করা।’ শ্রমিক বিষয়ে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, নিয়মিত মজুরি পরিশোধের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ইত্যাদি অন্যতম। এ রকম অনেক সুপারিশই বর্তমান সরকার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারে।
সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট নিয়ে সমাজে যথেষ্ট আলোচনা নেই। তবে ধর্মীয় দল-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে। উত্তরাধিকার প্রশ্ন কিংবা নারীর অধিকার প্রশ্ন এলেই বাংলাদেশের বৈষম্যবাদী রাজনীতি বা মতাদর্শ ধারণকারীদের ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
কোনো যুক্তিযুক্ত আলোচনা নয়, ধর্ম আর সংস্কৃতির নামে হুংকার শোনা যায়, উন্মাদনা ও সহিংসতা তৈরি করার চেষ্টা চলে। এবারও তাই হচ্ছে। নারীকে প্রতিপক্ষ ধরে তাদের সক্রিয়তা হুংকার যত আওয়াজ দেয়, সমাজের বৈষম্য, নিপীড়ন, জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের অনেকগুলোর সঙ্গে আমরা একমত। তবে দুটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার। মূলনীতি নতুনভাবে দাঁড় করাতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এর যুক্তিটাই সমস্যাজনক।
বলা হয়েছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে.
শুধু অন্য ধর্মের মানুষ নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যেও বহু সংখ্যালঘু থাকে। তাদের জন্যও নীতি–বিধিব্যবস্থা প্রণয়নে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। কমিশনের আরও দাবি—এটি ‘অতীতে ফ্যাসিবাদী শাসনের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে’। বস্তুত, উল্টো সেই শাসন তৈরি হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রতারণা করে, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে, নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা জারি করে, মুক্তিযুদ্ধকে অপব্যবহার করে এবং জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের ব্যবস্থা করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার উদগ্র বাসনায়।
সংবিধানের মূলনীতিতে ‘সমাজতন্ত্র’ ছিল অলংকার হিসেবে। তবে এটি বাদ দেওয়ার যুক্তিটিও ভুল। বলা হয়েছে, ‘সমাজতন্ত্র মূলত গণতন্ত্রবিরোধী শাসনব্যবস্থা।’ সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করতে হবে পুঁজিবাদ আর গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করতে হবে স্বৈরতন্ত্রকে। পুঁজিবাদের মতো সমাজতন্ত্রেরও বিভিন্ন ধরন আছে।
বর্তমানে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভেনেজুয়েলা, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়ার মতো বহু দেশে বামপন্থী/সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত দলগুলো নির্বাচন করছে, ক্ষমতায়ও যাচ্ছে। ইউরোপের বহু দেশে ডানপন্থী আক্রমণের মুখে প্রবাসী মানুষ এ রকম দলের ভরসাতেই থাকেন।
কমিশন ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র কথা বলেছে। আসলে এটি কতিপয় গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত প্রাণবিনাশী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সেই পন্থী কিছু গোষ্ঠী ছাড়া দুনিয়ার কেউ এটাকে আর কাঙ্ক্ষিত পথ বলে মনে করে না; ইউরোপ-আমেরিকাতেও নয়।
এই পথ ধরলে এটাও বলতে হবে—‘সাম্য’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ কথাগুলো আমরা রেখেছি অলংকার হিসেবে। আর এটাও বলতে হবে যে বৈষম্যহীনতার দিকে যাওয়ার পরিবর্তে বৈষম্য বৃদ্ধির দিকে যাওয়ার অর্থনীতিই অব্যাহত থাকবে। বলতে হবে এটাই ‘বৈশ্বিক এবং জাতীয় প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক’। মানতে হবে যে দেয়ালের গ্রাফিতিতে ভুল প্রত্যাশা প্রকাশ করা হয়েছিল!
● আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ব যবস থ সরক র র হয় ছ ল ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াবের বিবৃতির জবাবে যা বললেন উপপ্রেস সচিব
দৈনিক জনকণ্ঠ দখল, সাংবাদিকদের হুমকি, সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি, সচিবালয়ের অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কড়া বিবৃতি দিয়েছিল নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)।
সংগঠনটির বিবৃতির প্রসঙ্গে শুক্রবার (৮ আগস্ট) ফেসবুক পোস্ট দেন প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। তিনি বলেন, “গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার প্রতি সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, “সম্প্রতি নোয়াব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রাপ্তি পরিস্থিতি নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, আমরা তা স্বীকার করছি। তবে গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা গণমাধ্যমের স্বাধীকার ক্ষুণ্ণ করেছে-এমন ইঙ্গিত আমরা দৃঢ়ভাবে ও স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।”
এ সময় মৌলিক মূল্যবোধ রক্ষায় ও উন্নত করতে সরকার সব অংশীজনকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
নোয়াবকে জবাব: সত্য ঘটনা তুলে ধরা শীর্ষক শিরোনামে উপপ্রেস সচিব নোয়াবের দেওয়া বিবৃতির বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা দেন:
১.গণমাধ্যমের কার্যক্রমে সরকারের হস্তক্ষেপ নেই
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো গণমাধ্যমের সম্পাদকীয়, পরিচালনা বা ব্যবসায়িক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করেনি। বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার মুখেও আমরা অসাধারণ সংযম দেখিয়েছি। টেলিভিশন টক শো ও কলামে এই সরকারের বিরুদ্ধে প্রায়ই মিথ্যা ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে। তবুও আমরা না সেন্সর করেছি, না প্রতিশোধ নিয়েছি; এমনকি প্ররোচিত হলেও আমরা অভিযোগ করিনি, লাইসেন্স স্থগিত করিনি। বরং আগের সরকারের সময় জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া কিছু গণমাধ্যমকে পুনরায় প্রকাশনা বা সম্প্রচারের সুযোগ করে দিয়েছি। এটি আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতি অঙ্গীকারের স্পষ্ট প্রমাণ।
২. সরকারে প্রবেশাধিকার সবসময় উন্মুক্ত ছিল
সীমিত প্রবেশাধিকারের অভিযোগের বিপরীতে সাংবাদিকরা আমাদের উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীদের সঙ্গে সরাসরি ও উন্মুক্তভাবে যোগাযোগের সুযোগ পেয়েছেন। কোনো সাংবাদিককে তার গণমাধ্যমের পরিচয় বা সম্পাদকীয় অবস্থানের কারণে সাক্ষাৎকার বা ব্রিফিং থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। আমরা স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করি এবং আমাদের আচরণ সেটিরই প্রতিফলন।
৩. সচিবালয়ের অ্যাক্রেডিটেশন প্রক্রিয়ার সংস্কার
অ্যাক্রেডিটেশন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে নোয়াবের সমালোচনা ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর। আগের পদ্ধতিটি ছিল মারাত্মকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত; প্রবেশপত্র এমন ব্যক্তিদের হাতে পৌঁছেছিল যাদের কোনো বৈধ সাংবাদিকতার ভূমিকা ছিল না-যাদের মধ্যে কিছু ছিল রাজনীতিবিদ, লবিস্ট ও সুযোগসন্ধানী, যারা এই বিশেষ সুবিধা ব্যবহার করে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অন্যায্য প্রভাব বিস্তার করত।
আমরা সেই ভাঙা কাঠামো ভেঙে দিয়ে একটি অস্থায়ী পাস ব্যবস্থা চালু করেছি যা নিশ্চিত করছে যে প্রকৃত সাংবাদিকরা সচিবালয়ে প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন।এটি প্রবেশাধিকার সীমিত করার জন্য নয় বরং একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার জন্য। আগের অ্যাক্রেডিটেশন নীতিমালায় সাংবাদিকদের সরকারপন্থি অবস্থান নিতে বাধ্য করার শর্ত ছিল। এমনকি এতে কিছু অপমানজনক ধারা ছিল যা সাংবাদিকদের সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থি। অন্তর্বর্তী সরকার সেটি সংশোধন করেছে। দীর্ঘমেয়াদি নবায়ন সুবিধাসহ নতুন অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে।
৪. চাকরির নিরাপত্তা
স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন: যেসব সাংবাদিক তাদের চাকরি হারিয়েছেন, তা সরকারের নির্দেশে নয়, বরং গণমাধ্যম মালিকদের সম্পাদকীয় বা করপোরেট কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের কারণে হয়েছে। এগুলো সম্পূর্ণরূপে মালিকপক্ষের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের ফল, সরকারের কোনো চাপ বা নির্দেশ নয়।
৫. সাংবাদিকদের নিরাপত্তা: যৌথ দায়িত্ব
আমরা সব নাগরিকের মতো সাংবাদিকদের শারীরিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের অগ্রাধিকার, তবে এই দায়িত্ব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেও যৌথভাবে ভাগ করে নিতে হবে।
এই বছরের শুরুর দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত মিডিয়া সংস্কার কমিশন একটি নতুন ‘সাংবাদিক সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে, যাতে আইনি সুরক্ষা বৃদ্ধি পায় এবং সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ের কারণে স্ব-সেন্সরশিপ কমে। সরকার প্রস্তাবিত আইনটি প্রণয়নের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
৬. শিল্পের ভেতরেও আত্মসমালোচনার প্রয়োজন
আমরা গঠনমূলক সমালোচনার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও নোয়াবকে পরামর্শ দিচ্ছি প্রথমে নিজেদের ভেতরে নজর দিতে। নিজেদের সদস্যদের কার্যকলাপ পরীক্ষা করা উচিত-বিশেষ করে সাংবাদিকদের বেতন বঞ্চনা, শ্রম অধিকার হরণ, সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশে কাজ করানো এবং অসহনীয় কর্মপরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
একটি সূক্ষ্ম রূপান্তরের সময়কাল পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসন হিসেবে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘হ্যান্ডস-অফ’ পদ্ধতি বজায় রেখেছি, যাতে গণমাধ্যম ভয় বা হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করতে পারে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের কাছে কেবল একটি স্লোগান নয়; এটি এমন একটি নীতি, যা আমরা পালন করি।
তথ্যের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্টভাবে দায়ী পক্ষকে লক্ষ্য করে উপস্থাপিত হলে নোয়াবের উদ্বেগ অধিক গুরুত্ব পেত। ঘটনাবলির ভুল ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে করা সাধারণীকৃত অভিযোগ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অগ্রসর করে না, বরং বাংলাদেশের গণমাধ্যম খাতের প্রকৃত সমস্যাগুলো থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়।
আমরা স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এই মৌলিক মূল্যবোধ রক্ষায় ও উন্নত করতে আমরা সকল অংশীজনকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাই।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ