বজ্রপাতে মৃত্যু: ওরা গরিব, তাই কি আমাদের গড়িমসি
Published: 8th, May 2025 GMT
২৮ এপ্রিল ছিলাম খুলনায়। উপকূলের শিশুদের সঙ্গে ভালোই সময় কাটছিল। এর মধ্যে ফোনের পর ফোন; মেসেজ হোয়াটসঅ্যাপে, মেসেঞ্জারে। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর খবরে দিশাহারা গণমাধ্যম; কেউ প্রকৃত সংখ্যা জানতে চায়, কেউ চায় একটা বাইট; সংশ্লিষ্টদের কড়া সমালোচনা থাকতে হবে সেই বাইটে।
বৈশাখ শুরু হলেই ভয় বাড়ে কালবৈশাখী আর বজ্রপাতের। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে গড়ে ৩০০ মানুষ মারা যান, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বজ্রপাতের কারণে বছরে ২০ জনেরও কম মৃত্যু ঘটে। চলতি বছর (২০২৫) জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৭ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। এর মধ্যে শিশু ৬ জন, নারী ১৪ এবং পুরুষ ৪৭ জন। আহত হয়েছেন ৩৪ জন। (মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ৬ জন, মার্চে ২ এবং ৩০ এপ্রিল বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৫৯ জন)। গত বছর (২০২৪) নিহত হয়েছে ২৮৮ জন। শিশু ৪৮, নারী ৩৩ ও পুরুষ ২০৭ জন। আহত ১৩৯ জন।
প্রতিবছর বজ্রপাতে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ৭০ শতাংশই মাঠে কাজ করার সময়। বাকি সাড়ে ১৪ শতাংশ খেতখামার থেকে বাড়ি ফেরার পথে আর ১৩ শতাংশ মারা যান গোসল কিংবা মাছ ধরার সময়। মাসের হিসাবে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় এপ্রিল থেকে জুনে অর্থাৎ বর্ষা–পূর্ববর্তী মৌসুম এবং বর্ষায়।
হাওরে কি বজ্রপাত বেশি হয়আবহাওয়াবিদদের মতে, বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা। বজ্রপাতে হতাহত বেশি ঘটে হাওরাঞ্চলে। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও ময়মনসিংহকে বজ্রপাত-ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে আবহাওয়াবিদেরা চিহ্নিত করেছেন। ২০২৪ সালে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন সিলেট জেলায়। নিহতের সংখ্যা ২১ জন, যা অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক বেশি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো.
২০২৪ সালের মার্চ মাসে ‘পিয়ার-রিভিউ’ জার্নাল হেলিয়ন-এ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে বজ্রপাত পরিস্থিতির ওপর জিআইএস-ভিত্তিক স্থানিক বিশ্লেষণ’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতের ফলে ২ হাজার ১৪২ জন মারা যান। আহত হন ৫৩৮ জন।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। বর্ষা–পূর্ববর্তী মৌসুম এবং বর্ষাকালে তীব্র সৌর বিকিরণ থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন বজ্রপাত হয়ে থাকে। এ সময়ই মেঘ থেকে মাটিতে বজ্রপাতের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি হয়। অন্যদিকে সময়টি চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত হওয়ায় কৃষক ও জেলেরা বজ্রপাতের হতাহতের বিশেষ ঝুঁকিতে থাকেন।
কর্মক্ষম পুরুষেরাই প্রধান শিকারপরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরের বজ্রপাতে দুর্ঘটনার শিকার মোট ২ হাজার ২৭০ জনের মধ্যে মোট ১ হাজার ৬২৪ জন মারা যান, যার মধ্যে পুরুষ ছিলেন ১ হাজার ১৬৬ এবং আহত হন ৬৪৬। গত ২০২৪ সালে মোট ২৮৫ নিহত ব্যক্তির মধ্যে পুরুষ ছিলেন ২০৫ জন, শিশু ৪৭ এবং নারী ৩৩। নিহতের পাশাপাশি বহু মানুষ আহত হয়। এদের বেঁচে থাকতে হয় নানা শারীরিক সমস্যা নিয়ে। স্মৃতিশক্তি হ্রাস, শ্রবণশক্তি হারানো, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, কর্মক্ষমতা হ্রাস, ক্লান্তি বা অবসাদ বোধ, মাথা ঘোরা অথবা ঝিমঝিম করা, শরীরব্যথা, মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যাজনিত বিভিন্ন ধরনের স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
আরও পড়ুন‘মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি’১৮ মার্চ ২০২৩বজ্রপাতে নিহতদের ভাগ্যে কী ঘটেরংপুরের পীরগঞ্জের দুই ভাই আরও অনেকের সঙ্গে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বীর বাসিন্দা ইউনিয়নের নোয়াবাড়ী গ্রামে এসেছিলেন ধান কাটতে। ধানকাটা শ্রমিক আফজাল আর আমির ২০২৪ সালের ১৮ মে বজ্রপাতে আহত হন। হাসপাতালে নিলে তাঁদের মৃত ঘোষণা করা হয়। লাশ পড়ে থাকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সংবাদমাধ্যমকে জানান, নিহত দুজনের পরিবারকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা এলে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
২৮ বছর আগে ১৯৯৬ সালের ১৩ মে কালিহাতী, গোপালপুর, বাসাইল, ঘাটাইল ও সখীপুর উপজেলার ৪০টি গ্রাম টর্নেডো ও বজ্রপাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সেই বিভীষিকাময় ঘটনায় ধান কাটতে আসা রংপুর অঞ্চলের অনেক শ্রমিক নিহত হন। দুই দিন পর তাঁদের লাশ এক গর্তে কবর দেওয়া হয়। সেই শ্রমিকদের নাম আমরা কেউ জানি না। আফজাল-আমিরের নাম জানি, তাঁদের লাশ প্রমাণ সাপেক্ষে আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তরের আশ্বাস মেলে। গত ২৮ বছরে পরিবর্তন শুধু এটুকুই। গরিব মানুষের জন্য এটাই-বা কম কী!
বজ্রপাত প্রতিরোধে উদ্যোগবজ্রপাত থেকে মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্য প্রথমে নেওয়া হয়েছিল তালগাছ সৃজন প্রকল্প। কথা ছিল, সারা দেশে ৪০ লাখ তালগাছ লাগিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া হবে। তাক লাগানো দূরে থাক, ব্যবস্থাপনার তালগোলে প্রায় শতকোটি টাকা পানির মতো বেরিয়ে যেতে বোঝা গেল, চারদিকে ‘গায়েবি’ গাছের ছড়াছড়ি।
পরিকল্পনা কমিশন জানাল, ‘তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া। কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষাও হয়নি।’ তবে কি এটা ঝোঁকের মাথায়? ঝোঁকের ঝাঁকিতে টাকা ঝরেছে, কিন্তু মানুষের ঝুঁকি কমেনি। এখন তাল কর্মসূচির বাতিল করে শুরু হয়েছে বজ্রপাত প্রতিরোধক বা লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপনের কাজ।
লাইটনিং অ্যারেস্টার কীতামা, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি ধাতুর বৈদ্যুতিক রোধের মাত্রা অনেক কম। তাই সাধারণত এ ধরনের ধাতু দিয়ে বজ্রনিরোধক দণ্ড তৈরি করা হয়। এটি উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎকে সহজে নিরাপদে মাটিতে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। ৩০ থেকে ৪০ ফুট লম্বা দণ্ডে ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি জিআইপি পাইপ এবং তামার তার থাকে। বজ্রনিরোধক দণ্ডের ওপর বসানো লাইটনিং অ্যারেস্টার ডিভাইসের মূল কাজ, নির্ধারিত ব্যাসের মধ্যে বজ্রপাত হলে তা টেনে মাটিতে নামিয়ে আনা। এতে মিটারের মতো কাউন্টার রয়েছে, কয়টি বজ্রপাত হলো, তার হিসাব সেখানে থাকবে। যন্ত্রটিকে ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় রাখতে হয়।
অ্যারেস্টার কত দূর পর্যন্ত কার্যকরযে ধরনের অ্যারেস্টার এখন ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে ১০০ মিটার ব্যাসের মধ্যে এটা কার্যকর হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মতো দণ্ড বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়ও। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার এক মেগা বাজেট নিয়ে এগিয়ে আসছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সেখানেও বজ্রনিরোধক দণ্ডের হিস্যা আছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ২০১৮ সালে বজ্রপাতের আগাম সংকেত দিতে ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি জায়গায় লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর (সংকেতব্যবস্থা) বসিয়েছিল, যা এখন বেকার।
এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকাতে যেসব অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তা দেখে আমি হতাশ। এ ধরনের চিন্তা কীভাবে আসে? অর্থের অপচয়মাত্র…’
কেমন আছে দণ্ডগুলো২০২৪ সালের ১০ মে পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র (লাইটনিং অ্যারেস্টার মেশিন) বসানো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাওরে যন্ত্রগুলো বসানোর পর আর কেউ খোঁজ নেননি, অকেজো হয়ে পড়ে আছে।’ লেখকের সরেজমিন পরিদর্শন একই ছবি পেয়েছে।
বজ্রপাত থেকে প্রাণ রক্ষার সাশ্রয়ী পথকৃষিজমির উর্বরতা আর মাছের বংশ বৃদ্ধিতে বজ্রপাতের ভূমিকা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। সাইবেরিয়ান সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব জিওলজির কর্মকর্তা ভি বেগাটভ সুন্দর করে বলেছেন, ‘যদি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বজ্রপাতের না হতো, তবে বিশ্বের সব কারখানাকে নাইট্রোজেন সার কারখানায় পরিণত করতে হতো।’
এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এই উপকারী প্রাকৃতিক ব্যবস্থা থেকে জানমালের সুরক্ষা। কৃষিজমির চকে আগে যেমন বাবলা, খেজুরগাছের সমারোহ ছিল, সেটা আবার আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। গাছ লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। গত ২৮ জানুয়ারি আদালত গাছ কাটার আগে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে বলে রায় দিয়েছেন।
এক নড়াইলের জেলা প্রশাসক ইচ্ছা করলেই বছরে হাজার ছয়েক তালগাছ বাঁচাতে পারেন। নড়াইল জেলার চাচুড়ী, তুলারামপুর, দিঘলিয়াসহ বিভিন্ন হাটে ডোঙা বিক্রি শুরু হয় জুন মাসে, চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। নড়াইল-যশোর সড়কে তুলারামপুরের হাট দেশের সবচেয়ে বড় ডোঙার হাট। এখানে সপ্তাহের শুক্র ও সোমবার হাট বসে। এখানকার প্রতিটি হাটে কয়েক শ ডোঙা বেচাকেনা হয়। জনস্বার্থে তুলারামপুরের ডোঙার হাট বন্ধ করা উচিত।
নেপাল ও ভারতে বজ্রপাতে বেঁচে যাওয়া কৃষকদের নিয়ে কাজ করছেন, এমন সব মাঠকর্মী দেখেছেন, যেসব খেতমজুরের পায়ে রাবারের জুতা ছিল, তাঁদের বেঁচে যাওয়ার সংখ্যা খালি পায়ে থাকাদের চেয়ে অনেক বেশি। তা-ই যদি হয়, তবে ব্যয়বহুল দণ্ড স্থাপনের চেয়ে জুতার দিকে মন দিতে বাধা কোথায়?
ক্ষতিপূরণ ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাবজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করলেও সরকার এখন পর্যন্ত আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে আলাদা তহবিল গঠন করেনি। আগে বলা হয়েছিল, বজ্রপাতে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা গেলে ভিজিএফ-ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে প্রতি মাসে তাঁর পরিবারকে চাল ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। সেটা হয়নি।
ভারতে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ মৃত ব্যক্তির জন্য ২ লাখ এবং আহত ব্যক্তিদের জন্য ৫০ হাজার রুপি। বাংলাদেশ খেতমজুর সমিতি মনে করে, বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারপ্রতি কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।
দেশে এখনো বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার কোনো নির্দেশিকা বা ‘প্রটোকল’ তৈরি হয়নি। বিজ্ঞানসম্মত এক কার্যকর ‘প্রটোকল’ তৈরি এখন সময়ের দাবি। তবে একটা জবাবদিহি আর অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে অথবা সেই ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজটি ত্বরান্বিত করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, বস্তুত এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে বায়ুমণ্ডলে ধাতব উপাদান বেড়ে গেলে তা বজ্রপাতের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কয়েক বছর ধরে বায়ুদূষণ–সম্পর্কিত সূচকগুলোয় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিকে থাকছে। বজ্রপাতে রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি প্রচুর গাছ লাগিয়ে গাছ কাটা বন্ধ করে এবং জনসাধারণের মধ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতে পারে।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক। ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২০২৪ স ল ব যবস থ পর ব র র জন য ধরন র ল ইটন সবচ য়
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্ব শরণার্থী দিবসে উদ্বাস্তু জীবনের ভাবনা
২০ জুন ছিল বিশ্ব শরণার্থী দিবস। সেই দিবস উপলক্ষে ১৯ জুন কক্সবাজার শহরে কোস্ট ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আমার যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়। সভায় ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দান: ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
আলোচনা সভাটি ছিল মূলত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তা ও ক্যাম্পে শরণার্থীদের পরিপোষণের বার্ষিক বাজেট সংগ্রহ হ্রাসের উদ্বিগ্নতাকে ঘিরে। তার সঙ্গে আলোচনায় চলে ছিল ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বৃদ্ধি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নানান বিষয়ে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব। সম্প্রতি তহবিল ঘাটতির কথা বলে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম হ্রাস করায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্য থেকে নিযুক্ত শত শত শিক্ষকের চাকরিচ্যুতির বিষয়টিও আলোচনায় প্রাধান্য পায়।
সভায় বক্তাদের সমস্যার বিবরণ ও তালিকা পেশ ব্যতীত সমাধানের কোনো পথনির্দেশের হদিস পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া আলোচনা সভায় স্থানীয় জেলা প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা চোরাচালান রোধের রূপরেখার কিছুই জানা যায়নি। আলোচনা সভায় উখিয়া-টেকনাফের জনপ্রতিনিধিদের মুখে সবচেয়ে করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে রোহিঙ্গাদের অবাধে শ্রমমজুরিতে প্রবেশ ও হাটবাজারে অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারায় টেকনাফ-উখিয়া উপজেলার সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবন নির্বাহের অচলাবস্থা সৃষ্টির বিষয়টি নিয়ে।
সভায় জনপ্রতিনিধিরা আরও জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য দূষণের কারণে কৃষকদের কৃষি কাজে মারাত্মক পরিবেশদূষণের বাধা-বিঘ্নতা। এখনো ফয়সালা হয়নি একটানা কয়েক বছর ধরে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় জেলেদের নিয়মিত মাছধরার কাজে বাধাগ্রস্ত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দারিদ্র্য ও হতাশায় জীবনধারণের বিষয়টিও আলোচনায় গুরুত্ব পায়। আলোচনা সভায় সরকারি কর্মকর্তাদের মুখেই শোনা গেছে সীমান্তে মাদক চোরাচালানে সীমান্ত পাহারাদারদের ব্যর্থতার কথা।
আলোচনায় আরও প্রকাশ পেয়েছে, রোহিঙ্গাদের পরস্পরের মধ্যে হানাহানি এবং রোহিঙ্গা কর্তৃক স্থানীয় বাসিন্দাদের জিম্মি করার মতো অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা। বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসকারী স্থানীয় জনসংখ্যার তুলনায় অধিকসংখ্যক নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পবাসী কীভাবে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে জেলার সর্বত্র বেপরোয়াভাবে বিচরণ করছে এবং নানান পেশায়—ব্যবসায় যুক্ত হতে পারছে, তার কোনো ব্যাখ্যা স্থানীয় প্রশাসন থেকে জানা যায়নি। এতে স্থানীয় জনগণ উদ্বিগ্ন।
সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিদের বিবরণে প্রকাশ পেয়েছে, রোহিঙ্গা নারীদের নিয়ে কক্সবাজার পর্যটন এলাকায় ব্যভিচারী ব্যবসার চিত্র। এ আলোচনা সভায় যে চিত্র ফুটে উঠেছে—রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে নানা অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় জনমনে শঙ্কা বাড়া বৈ কমেনি। সরকারের উদ্যোগে রোহিঙ্গা ও ক্যাম্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি সব দপ্তরের প্রধান, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটির নেতা ও সাংবাদিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্ণিত সব সমস্যা সমাধানের জরুরি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি উঠেছে সভায়।
২০২৪ সালের বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থানের পর এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। রাষ্ট্রভাবনার বিশেষজ্ঞরা, সব রাজনৈতিক দল, অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সব ব্যক্তি ও সংস্থার আর কোনো সংশয় নেই যে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি ক্রমে একটি একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে উঠেছিল। যার পরিণতি ঘটেছে একটি অভ্যুত্থানে।
এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার এক বছরের মাথায় বিশ্ব শরণার্থী দিবসের কথা ভাবতে গিয়ে আমার মনপ্রাণ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে তাঁদের কথা ভেবে, যাঁরা আমাদের দেশের, আমাদের পরিচিতজনেরা, বন্ধুরা; যাঁরা কিনা এক বছর আগে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, তাঁরা নিজ দেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা পরদেশে শরণার্থী হয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করবেন।
রোহিঙ্গারা তাদের রাষ্ট্র ও সেই রাষ্ট্রের জনগণ কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে, নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের অধিকার বঞ্চিত হয়ে, পরিশেষে উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও তার দলনেতা শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ প্রভৃতি বলে যে কৃতিত্বের দাবিদার হয়েছিলেন, ভাগ্যের কী করুণ পরিণতি, তাঁদের দলনেতাসহ অনেকেই আজ উদ্বাস্তু ও শরণার্থী!
এখন আমাদের সবার ভেবে দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে, একটি রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের হঠাৎ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণ কোথায় নিহিত রয়েছে। আমাদের মধ্যে যাঁরা আকস্মিকভাবে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছেন, তার জন্য অনেকে ক্ষুব্ধ, অনেকে খুশিতে ডগমগ, অনেকে চোখের জলে ভাসছেন। কিন্তু আমার মন তাঁদের জন্য দুঃখে ভারাক্রান্ত। এই উদ্বাস্তু হওয়ার কারণ খুঁজে পেলে দেখতে পাব, রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণের সঙ্গে আমাদের বারবার উদ্বাস্তু হওয়ার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।
আমার এই লেখায় উদ্বাস্তু বা শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতা, সেই দুঃসহ জীবনের ভার বা তার মর্মবস্তুর কোনো ছিটেফোঁটাও ব্যক্ত করতে পারব না। এখানে তা ব্যক্ত করার দুঃসাহস দেখানো আমার উদ্দেশ্যও নয়। কারণ সেই উদ্বাস্তু জীবনযাপনের সেই দুর্ভাগ্য আমার জীবনে কখনো নেমে আসেনি। একাত্তরে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার দুঃসহ-দুর্গম যাত্রার বিবরণ ও জীবনযাপনের কাহিনি বহু আমি পড়েছি; কিন্তু উদ্বাস্তু জীবনভোগী মানুষের অভিজ্ঞতার কিয়দংশও কারও জীবনচরিত পাঠে জানা যাবে না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। আমিও তা–ই মানি। আমি ভাবতে চাইছি, মানবজীবনে সেই উদ্বাস্তু জীবনযাপনের দুঃসহ-দুর্ভাগ্য যেন কারও জীবনে নেমে না আসে, তার কারণ ও করণীয় কি খুঁজে দেখতে।
তা বোঝার জন্য একটু পেছনে ফিরে তাকাতে চাই। ব্রিটিশ–শাসিত এই অখণ্ড বাংলার নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, যার প্রধান অংশ কৃষিজীবী ও বাঙালি মুসলমান, তারা মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র চাইলেন। অবশেষে ১৯৪৭ সালে শুধু পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে পারলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নে বিভিন্ন জাতির মুসলমানদের মধ্যে ভাই ভাই সম্প্রীতি ও মর্যাদার সুর প্রধান হয়ে বাজলেও পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর সেই সুর ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। দেখা গেল পাকিস্তান রাষ্ট্রে পশ্চিম পাকিস্তানের নানান জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী ভূস্বামী ও সামরিক-বেসামরিক আমলারা রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদার হিসেবে এবং রাষ্ট্রের অধিকার ভোগে একই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে কিংবা বাঙালি মুসলমানদের সমমর্যাদায় ও সম–অধিকারে একই পঙ্ক্তিতে বসাতে রাজি নন।
১৯৭০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বাঙালিদের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিপুল বিজয় অর্জনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির সমমর্যাদা ও সম–অধিকারে রাষ্ট্রশাসনের অধিকার পাওয়া যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, তখন সেই ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার হীন চেষ্টা ও আঘাত থেকেই চরম বিরোধের সৃষ্টি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে সেই বিরোধ ও বাধা থেকেই অনিবার্য উঠেছিল সংঘর্ষ ও বিদ্রোহ। তখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল একাত্তরের জনযুদ্ধ এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উদ্বাস্তু জীবনের সূত্রপাত। সব কথাই আমাদের সবার জানা কথা। আমাদের রাজনীতিবিদদের আত্মবিস্মৃত স্বভাবের চরিত্রের জন্যই এই জানা কথার পুনরাবৃত্তি। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের জনগণের কারও কারও উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণ একই ঘটনার সূত্রে গ্রথিত।
১৯৭১ সালের জনযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর থেকে ১৯৯০ অভ্যুত্থান এবং ১৯৯১ থেকে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত বাংলাদেশের সব জাতি-গোষ্ঠী, সব ধর্ম-বর্ণ ও ধনী-নির্ধন জনগোষ্ঠীর মানুষকে নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমমর্যাদা ও সম–অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থাপনা থেকেই একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব ও ফ্যাসিবাদের জন্ম। রাষ্ট্রের সব জনগোষ্ঠীর ধর্ম–বর্ণ–জাতিনির্বিশেষে যার যার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে একত্রে মিলেমিশে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রে বসবাস করার ব্যবস্থাপনা তৈরি করার শাসক শ্রেণির যে দায়িত্ব ছিল তার ব্যর্থতা থেকেই ফ্যাসিবাদের জন্ম। সেই গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের বহু বাসনার দানা বেঁধেছিল একাত্তরে।
যে রাজনৈতিক চর্চা ও রাষ্ট্রশাসনের ব্যবস্থা অন্য সবাইকে বঞ্চিত করার প্ররোচনা দেয়, নিজের ভাবাদর্শে ও মতবাদে মিলে যেতে জবরদস্তি ও বল প্রয়োগ করে, পরিশেষে রাষ্ট্রের অন্য সবাইকে মর্যাদা ও অধিকার দিতে অস্বীকার করে, সেই ধরনের রাষ্ট্র গড়ে তোলার চর্চার মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাষ্ট্রের কারও না কারও উদ্বাস্তু হওয়ার বীজ। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানেই যার যার চিন্তা, যার যার ভিন্নতা ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই একটি জনগোষ্ঠীর একজন হয়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে নাগরিক অধিকার ভোগবাসনার বন্দোবস্ত।
বহু ব্যর্থতা ও ত্যাগের পর ২০২৪ জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্র গড়ে তোলার আবার সুযোগ এসেছে। আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জনগণ বহু জাতির, বহু ধর্মের এবং বহু বৈচিত্র্যের। যার যার সৌন্দর্য ও মর্যাদা তার তার। কারও শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করে অন্যদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, অন্যের অধিকার খর্ব করার চেষ্টা এবং সর্বোপরি সেই অপচেষ্টা রাষ্ট্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার চেষ্টার মধ্যেই নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। রাষ্ট্রের মাধ্যমে কোনো জনগোষ্ঠীর সব নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে নাগরিকের বিভিন্নতার বিসর্জনের প্রয়োজন পড়ে না। বিভিন্নতা নিয়ে নাগরিকের সমবিকাশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
নাগরিকের সমবিকাশের অধিকারহীনতা থেকেই জন্ম নেয় বৈষম্যের। অন্য অধিকাংশ মানুষকে অধিকারহীন করে তোলার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ফলে সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক এই বৈষম্য সৃষ্টির ফলে প্রতিনিয়ত দেশের মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে যারা উদ্বাস্তু হচ্ছে, আমরা তাদেরকেই শরণার্থী দিবসের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করছি। কিন্তু যে মানুষটি বাপ-দাতার ভিটায় জন্ম নিয়ে, সেই পরিবেশের আলো–হাওয়ায় বেড়ে উঠে জীবন শুরু করেছিল, রাষ্ট্রের বৈষম্য-নীতির ফলে দারিদ্র্যের কশাঘাতে অনেকেই বাস্তুচ্যুত হয়ে কোনো বড় শহরের ফুটপাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে কিংবা কোনো বস্তির গলির আস্তানায় ঠাঁই নিতে হয়েছে। তারাও উদ্বাস্তু হওয়ার কম কিসে?
রাষ্ট্রের উন্নয়ন নীতির বৈষম্যের কারণে বেড়িবাঁধের অভাবে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে যার পৈতৃক বাস্তুভিটা ভাসিয়ে নিয়ে যাকে কোনো শহরের ফুটপাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে, সত্যিকার অর্থে সে–ও বাস্তুচ্যুত।
দেশের অভ্যন্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বা প্রাকৃতিক দুযোগের কারণে বা দারিদ্র্যের কারণে যারা উপকূল থেকে হোক কিংবা প্রত্যন্ত কোনো গ্রাম থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তারা সবাই উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তু হওয়া এসব নাগরিক যারা শহরের ফুটপাত বা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে, তারা রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রের সুশাসন দূরে থাক, সকল ধরনের শাসন ও সেবা থেকে বঞ্চিত।
রাজনৈতিক কারণে যারা উদ্বাস্তু হয়েছে, তারা কোনো না কোনো আইনের আওতায়, কোনো না কোনো কর্তৃপক্ষের বা সংস্থার সেবা পায়। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ও অতি দারিদ্র্যে পতিত হয়ে যারা উদ্বাস্তু হয়ে নিজেদের সমাজ ও গ্রাম হারিয়ে শহরের ফুটপাতে বিচ্ছিন্নভাবে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের উদ্বাস্তু জীবনের যাতনা কম নয়।
একাত্তরে উদ্বাস্তু হওয়ার মর্মে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সব নাগরিককে সমান মর্যাদা ও অধিকার না দিতে চাওয়া শাসকশ্রেণির উদ্যত ও বাড়াবাড়ির মধ্যে আমরা খুঁজে পাব। আমরা কি ২০২৪ সালে আমাদের প্রতিবেশী, পরিচিতজন ও বন্ধুদের উদ্বাস্তু হওয়ার পেছনের কারণ তাদের নিজেদের, নিজেদের দলের ও দলের নেতাদের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াইয়ের এবং অন্যদের বঞ্চিত করার রাজনৈতিক চর্চার ভুলের মধ্যে খুঁজে পেতে চেষ্টা করব না?
আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আমাদের নিজেদের উদ্বাস্তু হওয়ার কারণ খুঁজে দেখতে চেষ্টা করব। বর্তমানে, নতুন পর্যায়ের রাষ্ট্র গড়ার সন্ধিক্ষণে রাজনৈতিক কর্মী ও দলনেতারা যদি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই, আমরা যদি আমাদের সমাজের বিভিন্নতাকে, বৈচিত্র্যকে সানন্দে মেনে নিয়ে সবাইকে সমান মর্যাদার চোখে সম–অধিকার নিশ্চিত করে রাষ্ট্র গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই, এবং সেই অঙ্গীকার নিয়ে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনধারার চর্চা না করি, তাহলে একই সঙ্গে আমাদের উদ্বাস্তু হওয়ার বীজ আমরাই বপন করব।
মকবুল আহমেদ সাবেক অধ্যক্ষ ও লেখক