ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে বৃহস্পতিবার রাতভর বিক্ষোভের পর গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে সমাবেশ করে শাহবাগে যান তারা। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা এ বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে রাজনৈতিক ঐক্য চেয়ে তারা ঘোষণা দিয়েছেন– দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান চলবে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

কর্মসূচির মধ্যে গতকাল রাত ১১টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ তিন দাবিতে শনিবার সারাদেশে গণজমায়েত কর্মসূচি ঘোষণা করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ।
দাবি আদায়ে অবস্থান কর্মসূচি চলমান থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, শনিবার বিকেল ৩টায় গণজমায়েত, সারা ঢাকায় ফ্যাসিবাদবিরোধী জনতা গণজমায়েতে যুক্ত হবেন। সারাদেশে জুলাই আন্দোলনের পয়েন্টে গণজমায়েত হবে। 

এ লড়াই ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশপন্থিদের লড়াই। ৫ আগস্ট জনগণ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার আইনি ভিত্তি দেওয়ার লড়াই।
বাকি দুই দাবি হলো– আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আওয়ামী লীগের দলগত বিচারের বিধান যুক্ত করা এবং জুলাই ঘোষণাপত্র জারি। এসব দাবিতে রাতে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন জুলাই ঐক্যের এবি জুবায়ের। আর রাত সাড়ে ১১টার দিকে অভ্যুত্থান নিয়ে ভিডিওচিত্র প্রদর্শনী করে ইনকিলাব মঞ্চ।
শাহবাগের এবারের আন্দোলনে বিএনপি দূরত্ব বজায় রেখেছে। জামায়াতে ইসলামীর মধ্যম সারির নেতাকর্মী বিক্ষোভে যোগ দিলেও দলটি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দলগুলো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি খোলাখুলি জানিয়েছে। এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দল একই অবস্থান জানিয়েছে।
বিএনপি আগেই জানিয়েছিল– নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। গতকালও একই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড.

আব্দুল মঈন খান বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কিনা– জনগণ ঠিক করবে।

যোগাযোগ করা হলেও জামায়াত নেতারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেননি। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের বিচারে আইন সংশোধনের চিন্তা সরকারের রয়েছে।
এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ফেসবুকে লেখেন, ‘বিএনপি এবং তার অঙ্গ সংগঠন ব্যতীত সব রাজনৈতিক দল এখন শাহবাগে। বিএনপি এলে জুলাইয়ের ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায়।’

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘শাহবাগের অবস্থান চলমান থাকবে। দলমত নির্বিশেষে আওয়ামী লীগ ও দেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে জুলাইয়ের সব শক্তি এক থাকবে– এটাই প্রত্যাশা। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্লকেড চালু হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত না এলে সমগ্র বাংলাদেশ আবারও ঢাকা শহরে মার্চ করবে।’
মামলার আসামি হয়েও আওয়ামী লীগ মনোনীত সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের দেশত্যাগের খবরে গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী উপেক্ষা করে এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন নেতাকর্মী। স্লোগান, বিক্ষোভে সারারাত সেখানেই কাটান তারা।

শাহবাগে অবস্থান 
যমুনা থেকে ৩০-২৫ গজ দূরে সড়কের মোড়ে ফোয়ারার সামনে ট্রাকের ওপর নির্মিত মঞ্চে সমাবেশ হয় জুমার পর। এর পর সমাবেশকারীরা শাহবাগে অবস্থান নেন। রাত এবং সকালে জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ডা. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আলী আশরাফ আকনসহ বিভিন্ন দলের নেতারা সংহতি জানান। মাসুদ বলেন, দুপুরের মধ্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
গতকাল নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধে এনসিপিতে যোগ না দেওয়া অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারাও আগের রাতের মতো শাহবাগের বিক্ষোভে যোগ দেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে  ইউনাইটেড পিপলস (আপ) বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পর সংগঠনটির মিছিল গিয়ে শাহবাগে যোগ দেয় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে। হেফাজত নেতাদের ডাকে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আসেন। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী শাহবাগে যোগ দেন। এতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে শাহবাগমুখী সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। যান চলাচল বিঘ্নিত হলে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। সন্ধ্যার পর শাহবাগ মোড়ের চারদিকেই হাজার হাজার মানুষের জমায়েত ছিল। তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এবং জুলাই গণহত্যার বিচার চেয়ে স্লোগান দেন।

যমুনার সামনে সমাবেশ
গতকাল জুমার পরপরই তীব্র রোদ উপেক্ষা করে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসেন নেতাকর্মী। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দুটি গাড়ি থেকে সমাবেশস্থলে পানি স্প্রে করা হয়। ওয়াসা পানি সরবরাহ করে। উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ায় নাগরিকদের সুবিধার্থে ঠান্ডা পানি স্প্রে করা হচ্ছে। একই কারণে মিন্টো রোডে মানুষের জমায়েতে পানি ছিটানো হয়েছে।
জুমার পর এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফউদ্দিন মাহাদীর কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি-সংবলিত প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। সমাবেশে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ইন্টেরিমের (অন্তর্বর্তী সরকার) কানে আমাদের দাবি পৌঁছায়নি। তাই আমরা সমাবেশস্থল থেকে শাহবাগ অবরোধে যাচ্ছি। দাবি না আদায় পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করব।’

তিনি বলেন, ‘১০০টা ফেরাউন একসঙ্গে করলেও একটা হাসিনা পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগকে কেন রাজনৈতিক দল বলা হয়? শুনতে পাচ্ছি, প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসার চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে তিনি নাকি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তাঁর বসা উচিত শহীদ মুগ্ধর ভাইয়ের সঙ্গে, শহীদ আবু সাঈদের বাবার সঙ্গে, শহীদ ওয়াসিমের পরিবারের সঙ্গে। আওয়ামী লীগ নামক ভাইরাস নিয়ে এ বাংলাদেশে থাকতে চাই না।’

সমাবেশ থেকে হাসনাত শাহবাগ ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আগ পর্যন্ত এই ব্লকেড চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব আতাউল্লাহ আমীন, বিএনপির সমমনা দল হিসেবে পরিচিত লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদি, ইসলামী যুব মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি তাওহীদুল ইসলাম তুহিন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি ইউসুফ আহমাদ মানসুর, জুলাই ঐক্যের উদ্যোক্তা এবি জুবায়ের, শহীদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি, জুলাই যোদ্ধা খোকন চন্দ্র বর্মণ প্রমুখ সমাবেশে বক্তব্য দেন।

এনডিএম মহাসচিব মমিনুল হক, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি আব্দুল কাদের, অনলাইনে জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা আসিফ আদনান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতাকর্মীও।
শুরুর দিকে জুলাই ঐক্যের এবি জুবায়ের, মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ, ইনকিলাব মঞ্চের শরীফ ওসমান হাদি কর্মসূচিতে অবস্থান নেন। বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে নাহিদ ইসলাম, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন যোগ দেন। একই সঙ্গে শিবিরের দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ সিবগা, আপ বাংলাদেশের আলী আহসান জুনায়েদ, রাফে সালমান রিফাত, মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ, খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনের নেতা, জুলাইয়ের আহতের একটি দল, জুলাই মঞ্চ, ছাত্রপক্ষসহ বিভিন্ন সংগঠন অংশ নেয়।

বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ
তিন দাবিতে খুলনা নগরীর শিববাড়ী মোড়ে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার ব্যানারে ব্লকেড পালন করা হয়। জুমার নামাজের পর বিভিন্ন স্থান থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে শিববাড়ী মোড়ে জড়ো হন আন্দোলনকারীরা। কর্মসূচিতে এনসিপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, দ্য রেড জুলাই, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ছাত্রশিবির ও ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
সিলেটে বিক্ষোভ করেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী। বৃহস্পতিবার রাতে সিলেটের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থানের পর গতকাল বিকেলে আবার একই স্থানে অবস্থান করা হয়। কর্মসূচিতে সংহতি জানায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম।
কিশোরগঞ্জে ‘জুলাই বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। জুমার পরে শহরের শহীদি মসজিদের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ইকরাম হোসেন, সদস্য সচিব ফয়সাল প্রিন্স প্রমুখ। গাজীপুরের কাপাসিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে। এতে এনসিপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী অংশ নেন।

চট্টগ্রামে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি হয়েছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নগরীর চকবাজার গুলজার মোড়ে এ কর্মসূচি পালন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এনসিপি নেতাকর্মী। একই দাবিতে কুমিল্লায় বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। পটুয়াখালী শহরের ঝাউতলা শহীদ হৃদয় তরুয়া চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।
রংপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, ফেনী, হবিগঞ্জ, ঢাকার সাভার, গাজীপুরের টঙ্গীতেও ব্লকেড, সড়ক অবরোধ এবং বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।
এ ছাড়া বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে রাজশাহী নগরীর তালাইমারী এলাকায় এ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক আধা ঘণ্টা অবরোধ করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) বরিশাল ক্যাম্পাসেও বিক্ষোভ মিছিল হয়।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যুরো, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতা)

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আওয ম ল গ র ন ত কর ম ন উপদ ষ ট অবস থ ন ন ম হ ম মদ জ ম র পর দল র ন ত এনস প র ব লক ড শ হব গ র স মন গতক ল দলগ ল মজল স ব এনপ অবর ধ সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

বরেণ্য সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী মারা গেছেন

বরেণ্য সংগীতশিল্পী, গবেষক, লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭।

শনিবার সকাল সাতটায় বনানীর একটি হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তার কন্যা শারমিন আব্বাসী। 

বেশ কিছুদিন ধরে বাধ্যর্কজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। সর্বশেষ গতকাল শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী উপমহাদেশের এক প্রখ্যাত সংগীত পরিবারের সন্তান। পিতা আব্বাস উদ্দীন আহমেদ পল্লীগীতির কিংবদন্তী শিল্পী। এদেশের পল্লীসংগীতকে তিনিই প্রথম বিশ্বের দেশে দেশে জনপ্রিয় করেছেন। চাচা আব্দুল করিম ছিলেন পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি গানের জনপ্রিয় শিল্পী। বড় ভাই বিচারপতি মোস্তফা কামাল আইনবিশারদ। মোস্তফা কামালের কন্যা নাশিদ কামালও একজন বরেণ্য শিল্পী। বোন ফেরদৌসী রহমান দেশের প্রথিতযশা বহুমাত্রিক প্রতিভার সংগীতজ্ঞ হিসেবে সমাদৃত।

মোস্তফা জামান আব্বাসী ভারতের কোচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে ৮ ডিসেম্বর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও কৈশোর কাল কলকাতায় কাটে। এই পরিবারটির সাথে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। মুস্তাফা জামানের শিক্ষাজীবন কলকাতায় শুরু হয়। তিনি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পাস করেন। তিনি সঙ্গীতসাধনা ও সাহিত্যচর্চায় নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। সঙ্গীত বিষয়ক গবেষণাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি বেতার ও টেলিভিশনে সঙ্গীতবিষয়ক অনেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। পত্র-পত্রিকাতে তিনি একজন সুখপাঠ্য কলাম লেখক হিসেবেও সুপরিচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ও এমএ, হার্ভার্ড গ্রুপ থেকে মার্কেটিং অধ্যয়ন, দীর্ঘদিন শিল্পগোষ্ঠীর মহাব্যবস্থাপক ছিলেন, ছিলেন ব্যবসা সফল ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন তিনি। পঁচিশটি দেশে ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, ভাওয়াইয়া, চটকা, নজরুলগীতি পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব ও সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ইউনেস্কোর ছত্রছায়ায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি অব মিউজিকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এগারো বছর, একাধিকবার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন সঙ্গীতজ্ঞদের বিশ্ব অধিবেশনে।

দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক ও সংগ্রাহক হিসেবে কয়েক হাজার গান তার সংগ্রহে ছিল। বাংলা লোকসঙ্গীতের মূল্যবান লালনের গান, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, ভাওয়াইয়া, চটকা ছিল তার সংগ্রহে। সম্পাদিত ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’ ও স্বাধীনতা দিনের গান’ উল্লেখযোগ্য সংকলন গ্রন্থ। ‘জার্নাল অব ফোক মিউজিকের’র সম্পাদক ছিলেন তিনি। ‘লোকসংগীতের ইতিহাস’, ‘ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি’, (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি’ প্রথম খণ্ডে সর্বমোট ছ’শত গান স্বরলিপি ও বিবক্ষণসহ প্রকাশিত, দেশে বিদেশে প্রশংসিত। 

কবি, লেখক ও গবেষক মুস্তফা জামান আব্বাসীর ২১টি গ্রন্থ পাঠকনন্দিত। জীবনকালে তিনি নানা পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, লালন পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কার, আব্বাসউদ্দিন গোল্ড মেডেল, এ্যাপেক্স ফাউন্ডেশন পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখক পুরস্কার, সিলেট মিউজিক পুরস্কার, মানিক মিয়া পুরস্কার, নাট্যসভা উপস্থাপক পুরস্কার, বাংলা সন চৌদ্দশতবার্ষিকী পুরস্কার ইত্যাদি। এশিয়া মিডিয়া সামিট, আন্তর্জাতিক রুমি কর্মকাণ্ড, আন্তর্জাতিক সুফি সম্মেলন, লোকসংস্কৃতি সেমিনার, রেডিও টেলিভিশনে বক্তব্য ও গানের জলসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ