জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় নিরস্ত্র, নিরীহ আন্দোলনকারীদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে রাষ্ট্রীয় সব বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসের শুরুতে দেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী সব অপরাধের প্রধান মাস্টারমাইন্ড (পরিকল্পনাকারী), হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার (সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা) ছিলেন তিনি।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তদন্ত প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার পাশাপাশি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’সহ (শীর্ষ নেতৃত্বের দায়) বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলার তদন্তে সময় লেগেছে ৬ মাস ২৮ দিন।

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের কাছে গতকাল সোমবার সকালে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক (প্রধান) আনসার উদ্দিন খান পাঠান।

নিয়ম অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রথমে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর চিফ প্রসিকিউটর সেই তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেন এবং আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আকারে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন।

তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার বিষয়ে গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে দাখিল করা তথ্যপ্রমাণাদি, আলামত—সবকিছু বিশ্লেষণ করার পর যদি মনে হয় যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া গেছে, তাহলে সেসবের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনাল বরাবর দাখিল করবেন। ফরমাল চার্জ গঠনের পর আনুষ্ঠানিক বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে। ফরমাল চার্জ দাখিল করতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ লাগতে পারে।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেশব্যাপী সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গুলি করে আহত করা, লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা। গত জুলাই ও আগস্টে যত মানুষ শহীদ হয়েছেন, যত মানুষ আহত হয়েছেন, প্রতিটি ঘটনায় তাঁর (শেখ হাসিনা) জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

তাজুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন কল রেকর্ড, অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ, আহতদের শরীর থেকে উদ্ধার হওয়া গুলি, যেসব হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর ফ্লাইট শিডিউল (উড্ডয়ন-অবতরণ সূচি), হেলিকপ্টার থেকে ব্যবহার করা অস্ত্র, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে যুক্ত করেছে তদন্ত সংস্থা। আহতদের সাক্ষ্য, গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের স্বীকারোক্তি তদন্ত প্রতিবেদনে রয়েছে।

আসাদুজ্জামান খান.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফরম ল চ র জ তদন ত স স থ ম নবত ব র ধ দ খ ল কর অপর ধ র

এছাড়াও পড়ুন:

নিবন্ধন স্থগিত, ভোটে যেতে পারছে না আওয়ামী লীগ

দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর এবার নির্বাচন থেকেও ছিটকে পড়ল আওয়ামী লীগ। গতকাল সোমবার রাতে দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর আগে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। 

এই স্থগিতাদেশ বহাল থাকলে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলগতভাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে না জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত দলটির। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ দলের নিবন্ধন বাতিলের বিধান রয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেজেটে আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে ইসি কোন আইনের অধীনে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে– তা স্পষ্ট নয়।   

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল বিকেলে গেজেট প্রকাশের পরপরই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে জরুরি কমিশন সভা বসে। সাড়ে তিন ঘণ্টারও বেশি বৈঠকের পর রাত সোয়া ৯টায় ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘আপনারা জানেন, আজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গসংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কীসের ভিত্তিতে নিবন্ধন স্থগিত করা হলো– জানতে চাইলে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে প্রজ্ঞাপন, তার ধারাবাহিকতায় আমরা এটা করেছি।’

বৈঠকে সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম, আব্দুর রহমানেল মাছউদ, সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ ও সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। 

সচিবের এই বক্তব্যের আধা ঘণ্টার মধ্যে ইসি সচিবালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু তাতে কোন আইন বা বিধিমালায় নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে, তা বলা হয়নি। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করায় ইসিও আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। যদিও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালার কোথাও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের সংস্কার-বিষয়ক জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইসির প্রজ্ঞাপনে কোন আইনবলে এটা করা হয়েছে, তা উল্লেখ থাকলে ভালো হতো। তিনি বলেন, নিবন্ধন স্থগিত হওয়ার পরে কোনো দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে না।  

ইসি-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলগতভাবে অংশ নিতে হলে ইসির নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। এই মুহূর্ত থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত কোনো প্রার্থী দলীয় প্রতীকে কোনো ধরনের নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। 

২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধন প্রথা চালু করে ইসি। এ পর্যন্ত ৫৫টি রাজনৈতিক দল ইসির নিবন্ধন পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ ছিল ইসির ৬ নম্বর নিবন্ধিত দল। বর্তমানে ৪৯টি দলের নিবন্ধন আছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে জামায়াতসহ পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল করা হয়। আওয়ামী লীগের আগে নিবন্ধনের শর্ত পূরণ, শর্ত পালনে ব্যর্থতা এবং আদালতের নির্দেশে জামায়াতে ইসলামী, ফ্রিডম পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, পিডিপি ও জাগপার নিবন্ধন বাতিল করা হয়।

আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত বিষয়ে ইসির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘সরকার যেহেতু সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সব ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, সেহেতু বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন (নম্বর-০০৬ তারিখ: ০৩/১১/২০০৮) স্থগিত করল।’

জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের দাবির মুখে গত শনিবার আওয়ামী লীগের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। একই বৈঠকে জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে রোববার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর পর সোমবার বিকেলে আসে নিষেধাজ্ঞার প্রজ্ঞাপন। 

সেখানে বলা হয়, ‘ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক যে কোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল।’

এর আগে বিকেলে সরকারের প্রজ্ঞাপনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পেছনে গত ১৬ বছরে দলটির নানা নেতিবাচক কার্যক্রম ও জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় দলটির ভূমিকার কথাও তুলে ধরা হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনে যায় এনসিপি, ছাত্রশিবিরসহ বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন। প্রথমে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে টানা অবস্থান ও শাহবাগে ব্লকেড কর্মসূচি পালনের পর শনিবার রাতে জরুরি বৈঠকে বসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

এর আগে সোমবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘যখন দেখবেন আকাশে সূর্য উঠে গেছে, তখন পরিষ্কার হয়ে যাবে, অপেক্ষা করেন।’

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ