২০২৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পুরোনো রাজনৈতিক ধারা আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ) শত বছর পূর্তি হচ্ছে। মুহূর্তটি বর্ণিল কোনো কায়দায় উদ্‌যাপন করতে চান করপোরেট ধাঁচের এই সংগঠনের কর্তারা। ভারতের কেন্দ্রে তাঁদের দল বিজেপি ইতিমধ্যে ক্ষমতায় আছে। তাহলে উদ্‌যাপনের বিকল্প আর কী হতে পারে—সেটাই এখন ভাবাচ্ছে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের।

কারও কারও অনুমান, পশ্চিমবঙ্গের আগামী নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিজেপি ‘সংঘ’ পরিবারের শত বছর পূর্তি উৎসবের ‘তারাবাজিতে আগুনের ছোঁয়া’ দিতে চায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ কেন টিম আরএসএসের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ? কীভাবে এগোচ্ছে তারা পশ্চিমবঙ্গ জয়ের দিকে? যুদ্ধ কি তাতে বাড়তি জ্বালানি জোগাচ্ছে? বাংলাদেশ প্রসঙ্গই-বা আসছে কেন বারবার?

পশ্চিমবঙ্গ যে কারণে আরএসএসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ

ভারতে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট সংখ্যা ৩৬। এর মধ্যে ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিজেপি ও তার মিত্ররা এখন ক্ষমতায় আছে। তার মধ্যে বিজেপি নিজ শক্তিতে ক্ষমতায় আছে ১৫ জায়গায়। সুতরাং জাতীয় ক্ষমতার গণিতে পশ্চিমবঙ্গ সংঘ পরিবারের জন্য জরুরি কিছু নয়। তবে ভাবাদর্শিক ও আবেগের জায়গা থেকে আরএসএস মনে করে, পশ্চিমবঙ্গ তাদের সেই ‘পবিত্র ভূমি’, যা আরও আগে তাদের পদানত হওয়া প্রয়োজন ছিল।

মারাঠি ব্রাহ্মণ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তাঁর জীবনের বড় সময় কেটেছে কলকাতায়। এখানেই ডাক্তারি পড়েছেন তিনি। এখানেই রাজনৈতিক সংগঠনের কলাকৌশল শিখেছেন তিনি তখনকার স্থানীয় বিপ্লবীদের কাছে। আবার বাংলা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিরও প্রদেশ। শ্যামাপ্রসাদই আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা জনসংঘ গড়ে তুলেছিলেন। যে জনসংঘ ১৯৭৭ সালে বিজেপিতে রূপান্তরিত হয়।

আরএসএস তাত্ত্বিকেরা এটাও বলেন, ‘ভারতমাতা’ কিংবা ‘হিন্দুত্বভা’র মতো এখনকার অতি চালু রাজনৈতিক ধারণাগুলো বাংলাভাষীদেরই উদ্ভাবন। হুগলির গবেষক চন্দ্রনাথ বসু ইতিহাসে প্রথম ‘হিন্দুত্বভা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এ রকম জনপদে যে আরএসএস বিজেপিকে ক্ষমতায় বসাতে পারল না আজও—সেটা তাদের জন্য আফসোসের ব্যাপার।

বলা বাহুল্য শতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে দলীয় এই অবস্থা বদলাতে চাইছে হিন্দুত্ববাদীরা। মর্যাদার পুরোনো লড়াইয়ে তারা এবার পশ্চিমবঙ্গে জিততে চায়। সে জন্য মরণপণ করে কাজে নেমেছে। সীমান্তের অপর দিকের বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকেও তারা আসন্ন লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজে ব্যবহার করতে পারবে মনে করছে। বাড়তি হিসেবে আছে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ-উন্মাদনা।

আরএসএস যেভাবে ‘মিশন বাংলা’য় এগোচ্ছে

গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ৪২ আসনের মধ্যে পায় ১২টি। এটা এখানকার মোট আসনসংখ্যার ৩০ শতাংশও নয়। আগের লোকসভা নির্বাচনে পেয়েছিল ১৮টি।

সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে তারা এখানে ভোট পেয়েছিল ৩৯ শতাংশ। তার আগে যে বিধানসভা নির্বাচন হয়, সেখানে তারা ২৯৪টির মধ্যে ৭৭টি আসন পায়। ওই নির্বাচনে ভোট পেয়েছিল ৩৮ শতাংশ।

গত এক বছর আরএসএস-বিশ্লেষকেরা ভোট ও আসনের এসব হিসাব খতিয়ে দেখেছেন। তাঁদের বিশ্লেষণে দলের ৩৮-৩৯ শতাংশ ভোটের অল্প অংশ আছে ভাসমান ভোট। রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী স্থায়ী ভোট আছে এখন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। এটা যদি ৫ শতাংশ কমে কিংবা ৫ শতাংশ বাড়ে, তাহলে আসনের হিসাবে কী ঘটতে পারে, সেসব হিসাব কষা হয়ে গেছে। তারপরই কেবল বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলো সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিল।

এর মধ্যে আছে ‘শাখা’র সংখ্যা বর্তমান থেকে দ্বিগুণ করা। অতি উচ্চাভিলাষী এক টার্গেট। মোহন ভাগবত তা-ই চান। গত ফেব্রুয়ারি এ রাজ্য সফর করে গেলেন তিনি। উচ্চাভিলাষী হলেও দুরূহ কোনো লক্ষ্য নয় এটা। ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সংঘের ৫০০ নতুন শাখা হলো এই রাজ্যে। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালে দেশব্যাপী এটা বেড়েছে ৬২ শতাংশ। ‘শাখা’ হলো মাঠপর্যায়ে হিন্দুত্ববাদী সর্বনিম্ন ইউনিট।

পশ্চিমবঙ্গে শাখাসংখ্যা বাড়ানো নিয়ে মোহন ভাগবতদের বড় লক্ষ্য এবং বড় আশার ভিন্ন কারণও আছে। এখানে হিন্দুত্ববাদের সামাজিক উত্থান ঘটছে রকেটগতিতে। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির আসন বেড়েছিল আগের নির্বাচনের ৩টি থেকে ৭৭টিতে, আর ভোট বেড়েছিল ১০ শতাংশ থেকে ৩৮ শতাংশ। এ রকম অগ্রগতি সামান্য বাড়তি গতি পেলেই মমতার প্রায় ১৫ বছরের সাজানো-গোছানো ছক উপড়ে ফেলা যাবে বলে ভাবছেন পদ্ম প্রতীকপ্রেমীরা।

সেই লক্ষ্যে সাংগঠনিক নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নানা ইস্যুকেও প্রচারের কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে চায় আরএসএস। এটা নতুন অগ্রাধিকার হিসেবে নিচ্ছে তারা। গত মার্চে বেঙ্গালুরুতে আরএসএসের যে প্রতিনিধিসভা হয়, যাকে তারা ‘বৈঠক’ বলে, সেখানে বাংলাদেশ বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার বিষয়ে আরএসএসের কর্তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

সংঘ পরিবারের ৩২টি সহযোগী সংগঠনের নীতিনির্ধারকেরা ওই বৈঠকে যোগ দেন এবং তাতে বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আলোচনা হয়। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের আগে আগে এসব আলোচনার পদ্ধতিগত কিছু ছাপ পড়বে, যা পদ্ম মার্কায় ‘বাড়তি হিন্দু ভোটের’ সিল পড়তে সহায়তা করবে বলে তারা মনে করছে।

তবে আরএসএস জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির বাইরের সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা কর্মসূচির মাধ্যমেও তাদের সংগঠন এবং ভোট বাড়ানোর চেষ্টা করে। যেমন বিদ্যাভারতী নামে তাদের যে শিক্ষা বিভাগ রয়েছে, তাতে কেবল পশ্চিমবঙ্গের ৯০ হাজার শিক্ষার্থী পড়ছেন। এ রকম প্রায় ৩০০ বিদ্যাপীঠ আছে এখানে। আট বছর আগে এটা ছিল এক শর মতো। এসব তথ্য জানাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে কী গতিতে সামাজিক বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।

মমতার সরকার একবার এ রকম কিছু স্কুল বন্ধ করতে গিয়ে আদালতের বাধায় পড়ে। তাতে এটাও বোঝা যায়, সমাজের অন্যান্য স্তরেও হিন্দুত্ববাদী প্রভাব বাড়ছে। আইন অঙ্গন থেকে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক পর্যন্ত সমাজের সব পর্যায়ে তাদের সংগঠন আছে। যেমন আইন অঙ্গনে কাজ করে আদিভক্ত পরিষদ, সাবেক সেনাদের মধ্যে কাজ করছে পূর্ব সৈনিক পরিষদ। কাজের গুণগত ধরনও বেশ ভালো।

যেমন পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্কুলগুলো থেকে আরএসএসের স্কুলগুলো দরিদ্র সমাজের জন্য বেশি সুবিধাজনক। এ রকম স্কুলগুলো কীভাবে ভোট বাড়ায়, তার একটা নজির হতে পারে মেদিনীপুরের ট্রাইবাল এলাকা। এখানকার জেলাগুলোয় (পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া) ২০১৫ সালে বিজেপি বিধানসভায় আসন পেয়েছিল ১টি। ২০২১ সালে পায় ২২টি। মমতার জন্য এ রকম আয়োজন ঠেকিয়ে রাখা সহজ নয়।

মমতার ‘খেলা’র ছকে নতুনত্ব এল

স্কুল ও অন্যান্য সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে আরএসএস মূলত বোঝাতে চায়, শুধু ভোট এবং বিধানসভাই তাদের লক্ষ্য নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতা অবশ্যই প্রধান এক লক্ষ্যবস্তু। তৃণমূল নেত্রীও সে অনুযায়ী লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

মমতা মূলত তাঁর মাঠে গতবারের আসন (২১৫) ধরে রাখতে চান। ইতিমধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় দলের এক বড় সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়েছেন ‘খেলা আবার হবে’। অর্থাৎ যুদ্ধের জন্য তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেই জানিয়ে দিলেন। তবে এ রকম হুংকার সত্ত্বেও মমতা সামাজিক ইমেজে বেশ পিছিয়ে আছেন।

কলকাতায় আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা শহুরে ভোটারদের মধ্যে তৃণমূলবৈরিতা বাড়িয়েছে। তাঁর প্রশাসনের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতিরও অভিযোগ উঠেছে। তবে এসবের চেয়ে তাঁর জন্য উদ্বেগের জায়গা হলো বাংলাদেশ নিয়ে শহুরে দরিদ্র হিন্দু ভোটারদের মেরুকরণ। বিজেপি এখানে মমতার পুরোনো ভোটব্যাংকে ঘা দিচ্ছে। তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে মমতার পুরোনো সখ্যকে বাংলাদেশের সঙ্গে মিলিয়ে হাজির করার কৌশল নিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ তাতে খেলার ভারসাম্য তাদের দিকে রেখেছে।

এ রকম অবস্থার চাপে পড়েই ইতিমধ্যে মমতাকে জোর গলায় জানাতে হচ্ছে তিনি হিন্দু ব্রাহ্মণ। তবে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে ‘উঁচু জাত’ ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থরা সংখ্যায় এত নয় যে শুধু এটা দিয়ে ভোটের দিন দাপট দেখানো যাবে; বরং এখানে অন্য পিছিয়ে থাকা জাতই বেশি। বাংলাদেশে চিন্ময়ের আটকের ঘটনায় নিচুতলার ওই হিন্দুদের আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল স্থানীয় ইসকন ও তার সংগঠক রাধারমণ দাস।

হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কলকাতা ও ভারতে বাংলাদেশকেন্দ্রিক প্রচারণার বড় এক ‘প্রযোজক’ রাধারমণ ও ইসকন। বিজেপি তা থেকে শুরুতে লাভবান হলেও বুদ্ধিমতী-ব্রাহ্মণ মমতা এই উভয়কে হাত করে নিয়েছেন। উপরন্তু রাধারমণকে দিঘা মন্দিরের দায়িত্ব দিয়ে হিন্দু ভোট ব্যাংকে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে চাইছেন তিনি। কিছুটা সফলও হয়েছেন।

দিঘায় প্রথম তিন দিনে ১০ লাখ দর্শনার্থী গেছেন বলে আনন্দবাজার ও মমতা উভয়ে উচ্ছ্বসিত। মুখ্যমন্ত্রীর ভবিষ্যৎ পাটিগণিত হলো: ২৮ শতাংশ মুসলমান ভোটের ২৫ শতাংশ তিনি আবার পেতে চান এবং বাকি ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোটের ২৫ শতাংশ পেলেই চলবে।

বিজেপির হিসাবও কম স্পষ্ট নয়। তারা আগের ৩০-৩৫ শতাংশ থেকে ভোটের অঙ্ক ৪০-এর ওপরে তুলতে চায়। ৪০ ছুঁতে পারলেও চলবে। এ জন্য তাদের বড় ভরসা বাংলাদেশের আগামী মাসগুলোর ‘ঘটনা-দুর্ঘটনা’। মমতার ভরসা রাধারমণ ও ইসকনমণ্ডলী।

বাংলাদেশ যেভাবে ২৬-এর পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্ববহ

পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের জন্য ৯৯তম বছরটি বেশ পয়া। প্রায়ই মেঘ না চাইতে জল মিলছে। বাংলাদেশে ৩ মের বহুল আলোচিত জনসভায় নেতাদের মুখে ও ছবিতে নারীর লাঞ্ছনা বিজেপি প্রচারকদের তুমুল খোরাক জোগাল। তারা একে ‘তালেবান-জুজু’ হিসেবে ব্যবহার করছে। বিজেপি মনে করছে, আগামী মাসগুলোয় বাংলাদেশে এ রকম যা কিছু ঘটবে, সেটাই তাদের ভোটের প্রচারে এগিয়ে রাখবে।

আবার এই প্রশ্নও আছে, মমতা যেভাবে দিঘার জগন্নাথ ধাম নিয়ে রাজনীতিতে মেতেছেন, ইসকনকে যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তাতে আগের মতো তাঁকে মুসলমান সমাজ ভোট দেবে তো? বিশেষ করে সিপিএম ও কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলো থাকার পরও মমতার সঙ্গে মুসলমানদের লেপটে থাকার নিশ্চয়ই গূঢ় অন্য কারণও আছে।

বিজেপির সঙ্গে মমতার পুরোনো সখ্যের কাহিনি তুলে ধরে বামরা অনেক সময় বিজেপিপন্থী সাংবাদিক বলবীর পুঞ্জকে উদ্ধৃত করে বলে, ‘মমতা হলেন আরএসএসের দুর্গা’মাত্র। প্রয়াত জ্যোতি বসুও বলতেন, মমতাই বাংলায় বিজেপিকে টেনে এনেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় সিপিএম এখনো জোরের সঙ্গে বলে মমতার হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুক্তি দরকার। কিন্তু মুসলমান-সমাজ কি এই আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে?

সংখ্যালঘু সমাজ থেকে এ প্রশ্নের যে ব্যাখ্যা মেলে, তার সারকথা হলো নিরাপত্তার জন্য তাঁরা মমতার সঙ্গে থাকতে চাইছেন; যদিও এই রাজ্যেও মুসলমানরা উন্নয়নবঞ্চনার শিকার নানাভাবে। কিন্তু টুপি পরে নির্বিঘ্নে এখানে চলাফেরা করা যায়। যুদ্ধ-উন্মাদনার মধ্যে যে ভরসা মেলে না উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোয়।

স্থানীয় মুসলমানদের এই বোধ বাড়তি জোর পাচ্ছে চলতি সময়ে গুজরাট-ওডিশা-মহারাষ্ট্রে বাংলাভাষী মুসলমানদের হেনস্তায়। তবে মুসলমানদের এ রকম এককাট্টার বিরুদ্ধে হিন্দু যৌথতাও বাড়তে দেখা গেল মুর্শিদাবাদসহ আশপাশে। ওদিকের জেলাগুলোয় যদিও হিন্দু ভোট বেশি নয়, কিন্তু সাম্প্রতিক দাঙ্গায় সেখানে তাঁরা খানিক কোণঠাসা হয়ে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ফেলে ধর্মীয় মেরুকরণে সমবেত হচ্ছেন মানসিকভাবে। বিজেপি এ রকমটায় ভবিষ্যতের ‘শুভবার্তা’ দেখছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেখাদেখির পর বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার উগ্রতা খানিক কমলেও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধায় সেটা নতুন ধর্মীয় ঘৃণার চেহারায় ফিরে আসছে। ফলে গত অক্টোবরে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পরপর অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে এসে বিজেপিকে এক কোটি নতুন সদস্য তৈরির যে লক্ষ্য দিলেন, তা সংঘ পরিবার বেশ সহজে পূরণ করতে পারবে বলেই এখন মনে হচ্ছে।

ছয় বছরের ব্যবধানে বঙ্গের গেরুয়া শিবির আবার সদস্য সংগ্রহে নামল। সংগঠন ও ভোট একসঙ্গে ঘুচিয়ে এভাবেই শতবর্ষ পূর্তি উৎসবের পথে হাঁটছে সংঘ। সামনে শুধু আট-নয় মাসের অপেক্ষা। বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের এই নির্বাচনে চোখ রাখতে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষদেরও। আরএসএসের দিল্লিজয়ের চেয়েও কলকাতাজয় সীমান্তের এদিকে বেশি তাৎপর্যবহ।

আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর আরএসএস র মমত র প র ব র হ মণ র জন ত ক ম সলম ন ক ষমত য় ব ধ নসভ র জন য পর ব র লক ষ য স গঠন অবস থ এ রকম কলক ত

এছাড়াও পড়ুন:

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রসায়নে যুদ্ধ, ইসকন এবং বাংলাদেশ

২০২৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পুরোনো রাজনৈতিক ধারা আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ) শত বছর পূর্তি হচ্ছে। মুহূর্তটি বর্ণিল কোনো কায়দায় উদ্‌যাপন করতে চান করপোরেট ধাঁচের এই সংগঠনের কর্তারা। ভারতের কেন্দ্রে তাঁদের দল বিজেপি ইতিমধ্যে ক্ষমতায় আছে। তাহলে উদ্‌যাপনের বিকল্প আর কী হতে পারে—সেটাই এখন ভাবাচ্ছে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের।

কারও কারও অনুমান, পশ্চিমবঙ্গের আগামী নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিজেপি ‘সংঘ’ পরিবারের শত বছর পূর্তি উৎসবের ‘তারাবাজিতে আগুনের ছোঁয়া’ দিতে চায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ কেন টিম আরএসএসের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ? কীভাবে এগোচ্ছে তারা পশ্চিমবঙ্গ জয়ের দিকে? যুদ্ধ কি তাতে বাড়তি জ্বালানি জোগাচ্ছে? বাংলাদেশ প্রসঙ্গই-বা আসছে কেন বারবার?

পশ্চিমবঙ্গ যে কারণে আরএসএসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ

ভারতে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট সংখ্যা ৩৬। এর মধ্যে ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিজেপি ও তার মিত্ররা এখন ক্ষমতায় আছে। তার মধ্যে বিজেপি নিজ শক্তিতে ক্ষমতায় আছে ১৫ জায়গায়। সুতরাং জাতীয় ক্ষমতার গণিতে পশ্চিমবঙ্গ সংঘ পরিবারের জন্য জরুরি কিছু নয়। তবে ভাবাদর্শিক ও আবেগের জায়গা থেকে আরএসএস মনে করে, পশ্চিমবঙ্গ তাদের সেই ‘পবিত্র ভূমি’, যা আরও আগে তাদের পদানত হওয়া প্রয়োজন ছিল।

মারাঠি ব্রাহ্মণ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তাঁর জীবনের বড় সময় কেটেছে কলকাতায়। এখানেই ডাক্তারি পড়েছেন তিনি। এখানেই রাজনৈতিক সংগঠনের কলাকৌশল শিখেছেন তিনি তখনকার স্থানীয় বিপ্লবীদের কাছে। আবার বাংলা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিরও প্রদেশ। শ্যামাপ্রসাদই আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা জনসংঘ গড়ে তুলেছিলেন। যে জনসংঘ ১৯৭৭ সালে বিজেপিতে রূপান্তরিত হয়।

আরএসএস তাত্ত্বিকেরা এটাও বলেন, ‘ভারতমাতা’ কিংবা ‘হিন্দুত্বভা’র মতো এখনকার অতি চালু রাজনৈতিক ধারণাগুলো বাংলাভাষীদেরই উদ্ভাবন। হুগলির গবেষক চন্দ্রনাথ বসু ইতিহাসে প্রথম ‘হিন্দুত্বভা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এ রকম জনপদে যে আরএসএস বিজেপিকে ক্ষমতায় বসাতে পারল না আজও—সেটা তাদের জন্য আফসোসের ব্যাপার।

বলা বাহুল্য শতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে দলীয় এই অবস্থা বদলাতে চাইছে হিন্দুত্ববাদীরা। মর্যাদার পুরোনো লড়াইয়ে তারা এবার পশ্চিমবঙ্গে জিততে চায়। সে জন্য মরণপণ করে কাজে নেমেছে। সীমান্তের অপর দিকের বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকেও তারা আসন্ন লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজে ব্যবহার করতে পারবে মনে করছে। বাড়তি হিসেবে আছে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ-উন্মাদনা।

আরএসএস যেভাবে ‘মিশন বাংলা’য় এগোচ্ছে

গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ৪২ আসনের মধ্যে পায় ১২টি। এটা এখানকার মোট আসনসংখ্যার ৩০ শতাংশও নয়। আগের লোকসভা নির্বাচনে পেয়েছিল ১৮টি।

সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে তারা এখানে ভোট পেয়েছিল ৩৯ শতাংশ। তার আগে যে বিধানসভা নির্বাচন হয়, সেখানে তারা ২৯৪টির মধ্যে ৭৭টি আসন পায়। ওই নির্বাচনে ভোট পেয়েছিল ৩৮ শতাংশ।

গত এক বছর আরএসএস-বিশ্লেষকেরা ভোট ও আসনের এসব হিসাব খতিয়ে দেখেছেন। তাঁদের বিশ্লেষণে দলের ৩৮-৩৯ শতাংশ ভোটের অল্প অংশ আছে ভাসমান ভোট। রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী স্থায়ী ভোট আছে এখন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। এটা যদি ৫ শতাংশ কমে কিংবা ৫ শতাংশ বাড়ে, তাহলে আসনের হিসাবে কী ঘটতে পারে, সেসব হিসাব কষা হয়ে গেছে। তারপরই কেবল বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলো সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিল।

এর মধ্যে আছে ‘শাখা’র সংখ্যা বর্তমান থেকে দ্বিগুণ করা। অতি উচ্চাভিলাষী এক টার্গেট। মোহন ভাগবত তা-ই চান। গত ফেব্রুয়ারি এ রাজ্য সফর করে গেলেন তিনি। উচ্চাভিলাষী হলেও দুরূহ কোনো লক্ষ্য নয় এটা। ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সংঘের ৫০০ নতুন শাখা হলো এই রাজ্যে। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালে দেশব্যাপী এটা বেড়েছে ৬২ শতাংশ। ‘শাখা’ হলো মাঠপর্যায়ে হিন্দুত্ববাদী সর্বনিম্ন ইউনিট।

পশ্চিমবঙ্গে শাখাসংখ্যা বাড়ানো নিয়ে মোহন ভাগবতদের বড় লক্ষ্য এবং বড় আশার ভিন্ন কারণও আছে। এখানে হিন্দুত্ববাদের সামাজিক উত্থান ঘটছে রকেটগতিতে। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির আসন বেড়েছিল আগের নির্বাচনের ৩টি থেকে ৭৭টিতে, আর ভোট বেড়েছিল ১০ শতাংশ থেকে ৩৮ শতাংশ। এ রকম অগ্রগতি সামান্য বাড়তি গতি পেলেই মমতার প্রায় ১৫ বছরের সাজানো-গোছানো ছক উপড়ে ফেলা যাবে বলে ভাবছেন পদ্ম প্রতীকপ্রেমীরা।

সেই লক্ষ্যে সাংগঠনিক নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নানা ইস্যুকেও প্রচারের কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে চায় আরএসএস। এটা নতুন অগ্রাধিকার হিসেবে নিচ্ছে তারা। গত মার্চে বেঙ্গালুরুতে আরএসএসের যে প্রতিনিধিসভা হয়, যাকে তারা ‘বৈঠক’ বলে, সেখানে বাংলাদেশ বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার বিষয়ে আরএসএসের কর্তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

সংঘ পরিবারের ৩২টি সহযোগী সংগঠনের নীতিনির্ধারকেরা ওই বৈঠকে যোগ দেন এবং তাতে বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আলোচনা হয়। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের আগে আগে এসব আলোচনার পদ্ধতিগত কিছু ছাপ পড়বে, যা পদ্ম মার্কায় ‘বাড়তি হিন্দু ভোটের’ সিল পড়তে সহায়তা করবে বলে তারা মনে করছে।

তবে আরএসএস জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির বাইরের সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা কর্মসূচির মাধ্যমেও তাদের সংগঠন এবং ভোট বাড়ানোর চেষ্টা করে। যেমন বিদ্যাভারতী নামে তাদের যে শিক্ষা বিভাগ রয়েছে, তাতে কেবল পশ্চিমবঙ্গের ৯০ হাজার শিক্ষার্থী পড়ছেন। এ রকম প্রায় ৩০০ বিদ্যাপীঠ আছে এখানে। আট বছর আগে এটা ছিল এক শর মতো। এসব তথ্য জানাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে কী গতিতে সামাজিক বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।

মমতার সরকার একবার এ রকম কিছু স্কুল বন্ধ করতে গিয়ে আদালতের বাধায় পড়ে। তাতে এটাও বোঝা যায়, সমাজের অন্যান্য স্তরেও হিন্দুত্ববাদী প্রভাব বাড়ছে। আইন অঙ্গন থেকে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক পর্যন্ত সমাজের সব পর্যায়ে তাদের সংগঠন আছে। যেমন আইন অঙ্গনে কাজ করে আদিভক্ত পরিষদ, সাবেক সেনাদের মধ্যে কাজ করছে পূর্ব সৈনিক পরিষদ। কাজের গুণগত ধরনও বেশ ভালো।

যেমন পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্কুলগুলো থেকে আরএসএসের স্কুলগুলো দরিদ্র সমাজের জন্য বেশি সুবিধাজনক। এ রকম স্কুলগুলো কীভাবে ভোট বাড়ায়, তার একটা নজির হতে পারে মেদিনীপুরের ট্রাইবাল এলাকা। এখানকার জেলাগুলোয় (পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া) ২০১৫ সালে বিজেপি বিধানসভায় আসন পেয়েছিল ১টি। ২০২১ সালে পায় ২২টি। মমতার জন্য এ রকম আয়োজন ঠেকিয়ে রাখা সহজ নয়।

মমতার ‘খেলা’র ছকে নতুনত্ব এল

স্কুল ও অন্যান্য সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে আরএসএস মূলত বোঝাতে চায়, শুধু ভোট এবং বিধানসভাই তাদের লক্ষ্য নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতা অবশ্যই প্রধান এক লক্ষ্যবস্তু। তৃণমূল নেত্রীও সে অনুযায়ী লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

মমতা মূলত তাঁর মাঠে গতবারের আসন (২১৫) ধরে রাখতে চান। ইতিমধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় দলের এক বড় সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়েছেন ‘খেলা আবার হবে’। অর্থাৎ যুদ্ধের জন্য তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেই জানিয়ে দিলেন। তবে এ রকম হুংকার সত্ত্বেও মমতা সামাজিক ইমেজে বেশ পিছিয়ে আছেন।

কলকাতায় আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা শহুরে ভোটারদের মধ্যে তৃণমূলবৈরিতা বাড়িয়েছে। তাঁর প্রশাসনের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতিরও অভিযোগ উঠেছে। তবে এসবের চেয়ে তাঁর জন্য উদ্বেগের জায়গা হলো বাংলাদেশ নিয়ে শহুরে দরিদ্র হিন্দু ভোটারদের মেরুকরণ। বিজেপি এখানে মমতার পুরোনো ভোটব্যাংকে ঘা দিচ্ছে। তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে মমতার পুরোনো সখ্যকে বাংলাদেশের সঙ্গে মিলিয়ে হাজির করার কৌশল নিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ তাতে খেলার ভারসাম্য তাদের দিকে রেখেছে।

এ রকম অবস্থার চাপে পড়েই ইতিমধ্যে মমতাকে জোর গলায় জানাতে হচ্ছে তিনি হিন্দু ব্রাহ্মণ। তবে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে ‘উঁচু জাত’ ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থরা সংখ্যায় এত নয় যে শুধু এটা দিয়ে ভোটের দিন দাপট দেখানো যাবে; বরং এখানে অন্য পিছিয়ে থাকা জাতই বেশি। বাংলাদেশে চিন্ময়ের আটকের ঘটনায় নিচুতলার ওই হিন্দুদের আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল স্থানীয় ইসকন ও তার সংগঠক রাধারমণ দাস।

হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কলকাতা ও ভারতে বাংলাদেশকেন্দ্রিক প্রচারণার বড় এক ‘প্রযোজক’ রাধারমণ ও ইসকন। বিজেপি তা থেকে শুরুতে লাভবান হলেও বুদ্ধিমতী-ব্রাহ্মণ মমতা এই উভয়কে হাত করে নিয়েছেন। উপরন্তু রাধারমণকে দিঘা মন্দিরের দায়িত্ব দিয়ে হিন্দু ভোট ব্যাংকে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে চাইছেন তিনি। কিছুটা সফলও হয়েছেন।

দিঘায় প্রথম তিন দিনে ১০ লাখ দর্শনার্থী গেছেন বলে আনন্দবাজার ও মমতা উভয়ে উচ্ছ্বসিত। মুখ্যমন্ত্রীর ভবিষ্যৎ পাটিগণিত হলো: ২৮ শতাংশ মুসলমান ভোটের ২৫ শতাংশ তিনি আবার পেতে চান এবং বাকি ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোটের ২৫ শতাংশ পেলেই চলবে।

বিজেপির হিসাবও কম স্পষ্ট নয়। তারা আগের ৩০-৩৫ শতাংশ থেকে ভোটের অঙ্ক ৪০-এর ওপরে তুলতে চায়। ৪০ ছুঁতে পারলেও চলবে। এ জন্য তাদের বড় ভরসা বাংলাদেশের আগামী মাসগুলোর ‘ঘটনা-দুর্ঘটনা’। মমতার ভরসা রাধারমণ ও ইসকনমণ্ডলী।

বাংলাদেশ যেভাবে ২৬-এর পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্ববহ

পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের জন্য ৯৯তম বছরটি বেশ পয়া। প্রায়ই মেঘ না চাইতে জল মিলছে। বাংলাদেশে ৩ মের বহুল আলোচিত জনসভায় নেতাদের মুখে ও ছবিতে নারীর লাঞ্ছনা বিজেপি প্রচারকদের তুমুল খোরাক জোগাল। তারা একে ‘তালেবান-জুজু’ হিসেবে ব্যবহার করছে। বিজেপি মনে করছে, আগামী মাসগুলোয় বাংলাদেশে এ রকম যা কিছু ঘটবে, সেটাই তাদের ভোটের প্রচারে এগিয়ে রাখবে।

আবার এই প্রশ্নও আছে, মমতা যেভাবে দিঘার জগন্নাথ ধাম নিয়ে রাজনীতিতে মেতেছেন, ইসকনকে যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তাতে আগের মতো তাঁকে মুসলমান সমাজ ভোট দেবে তো? বিশেষ করে সিপিএম ও কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলো থাকার পরও মমতার সঙ্গে মুসলমানদের লেপটে থাকার নিশ্চয়ই গূঢ় অন্য কারণও আছে।

বিজেপির সঙ্গে মমতার পুরোনো সখ্যের কাহিনি তুলে ধরে বামরা অনেক সময় বিজেপিপন্থী সাংবাদিক বলবীর পুঞ্জকে উদ্ধৃত করে বলে, ‘মমতা হলেন আরএসএসের দুর্গা’মাত্র। প্রয়াত জ্যোতি বসুও বলতেন, মমতাই বাংলায় বিজেপিকে টেনে এনেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় সিপিএম এখনো জোরের সঙ্গে বলে মমতার হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুক্তি দরকার। কিন্তু মুসলমান-সমাজ কি এই আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে?

সংখ্যালঘু সমাজ থেকে এ প্রশ্নের যে ব্যাখ্যা মেলে, তার সারকথা হলো নিরাপত্তার জন্য তাঁরা মমতার সঙ্গে থাকতে চাইছেন; যদিও এই রাজ্যেও মুসলমানরা উন্নয়নবঞ্চনার শিকার নানাভাবে। কিন্তু টুপি পরে নির্বিঘ্নে এখানে চলাফেরা করা যায়। যুদ্ধ-উন্মাদনার মধ্যে যে ভরসা মেলে না উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোয়।

স্থানীয় মুসলমানদের এই বোধ বাড়তি জোর পাচ্ছে চলতি সময়ে গুজরাট-ওডিশা-মহারাষ্ট্রে বাংলাভাষী মুসলমানদের হেনস্তায়। তবে মুসলমানদের এ রকম এককাট্টার বিরুদ্ধে হিন্দু যৌথতাও বাড়তে দেখা গেল মুর্শিদাবাদসহ আশপাশে। ওদিকের জেলাগুলোয় যদিও হিন্দু ভোট বেশি নয়, কিন্তু সাম্প্রতিক দাঙ্গায় সেখানে তাঁরা খানিক কোণঠাসা হয়ে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ফেলে ধর্মীয় মেরুকরণে সমবেত হচ্ছেন মানসিকভাবে। বিজেপি এ রকমটায় ভবিষ্যতের ‘শুভবার্তা’ দেখছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেখাদেখির পর বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার উগ্রতা খানিক কমলেও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধায় সেটা নতুন ধর্মীয় ঘৃণার চেহারায় ফিরে আসছে। ফলে গত অক্টোবরে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পরপর অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে এসে বিজেপিকে এক কোটি নতুন সদস্য তৈরির যে লক্ষ্য দিলেন, তা সংঘ পরিবার বেশ সহজে পূরণ করতে পারবে বলেই এখন মনে হচ্ছে।

ছয় বছরের ব্যবধানে বঙ্গের গেরুয়া শিবির আবার সদস্য সংগ্রহে নামল। সংগঠন ও ভোট একসঙ্গে ঘুচিয়ে এভাবেই শতবর্ষ পূর্তি উৎসবের পথে হাঁটছে সংঘ। সামনে শুধু আট-নয় মাসের অপেক্ষা। বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের এই নির্বাচনে চোখ রাখতে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষদেরও। আরএসএসের দিল্লিজয়ের চেয়েও কলকাতাজয় সীমান্তের এদিকে বেশি তাৎপর্যবহ।

আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ