এলএনজি, তুলা, উড়োজাহাজ আমদানি বাড়াবে বাংলাদেশ
Published: 17th, May 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক থেকে রেহাই পেতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি বাড়াবে সরকার। একই সঙ্গে উড়োজাহাজ, তুলা, সয়াবিন তেলসহ আরও কিছু পণ্য আমদানি বাড়ানো হবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের যেসব ব্র্যান্ডের পণ্য অন্য দেশ থেকে আমদানি করা হয়, সেগুলো সরাসরি দেশটি থেকে আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর বিষয়টি মাথায় রেখে আরও ১০০ পণ্যও শূন্য শুল্কের তালিকায় যুক্ত করা হচ্ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরে পাঠানো এক চিঠিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব প্রস্তাব দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গতকাল শনিবার সমকালকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে পণ্যের তালিকাসহ চিঠি যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বাণিজ্য ঘাটতি নির্ধারণের সেবা আমদানিকেও অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ করা হয়েছে।
বাণিজ্য সচিব আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়িয়ে দু’দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ আগ্রহী এবং এ লক্ষ্যে দ্বিপক্ষীয় কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানির চুক্তি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বাড়তি এক বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের এলএনজি আমদানি করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা তুলার জন্য বাংলাদেশে ওয়ারহাউস স্থাপনের কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ওয়ারহাউসে ৪৫ দিন পর্যন্ত তুলা সংরক্ষণ করা যাবে।
বাণিজ্য সচিব জানান, বাংলাদেশের সামরিক কেনাকাটার মূল উৎস হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ বিমানের বোয়িংয়ের প্রায় সবগুলো যুক্তরাষ্ট্রের। সে দেশ থেকে আরও কিছু উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব কেনাকাটায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে।
পাল্টা শুল্ক আরোপ নিয়ে দরকষাকষি করতে গত ৭ মে লিখিত প্রস্তাব চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনকে চিঠি দেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব পেলে আনুষ্ঠানিক দরকষাকষি শুরু হবে। এ প্রেক্ষিতেই এই চিঠি দেওয়া হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করে এমন অন্তত ৪১ পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি আনার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে পেট্রোলিয়াম পণ্য, এলএনজি, এলপিজি, সয়াবিন তেল, গম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এদিকে বাংলাদেশের শুল্ক তালিকায় বর্তমানে ১৯০টি পণ্যের ওপর শুল্কহার শূন্য অর্থাৎ কোনো শুল্ক নেই। বাংলাদেশের ট্যারিফ লাইনের আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী শূন্য শুল্ক বা শুল্ক কমানো হচ্ছে; যা অন্যান্য দেশের জন্যও প্রযোজ্য হবে। এসআরও জারির মাধ্যমে বাংলাদেশের অনেক পণ্য প্রকৃত অর্থে শূন্য শুল্কে আমদানি হয়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে কেউ শুল্ক দিয়ে যন্ত্রণাংশ আমদানি করেনি। এ ধরনের আরও কিছু পণ্য শূন্য শুল্কের আওতায় আনা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চিঠিতে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য কেনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ জেনারেল মোটরস থেকে গাড়ি এবং এলজি পণ্য কোরিয়া এবং ভারত থেকে আমদানি করে। এগুলো আমেরিকান ব্র্যান্ড। এ ছাড়া আরও কিছু আমেরিকান মেশিনারিজ ও ইলেকট্রনিকস পণ্য সিঙ্গাপুর, দুবাই ও ভারত থেকে আমদানি করা হয়। এসব পণ্য আমেরিকান হিসেবে গণ্য করে বাণিজ্য ঘাটতি নির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ করা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবে রাজি না হলে পরে বাংলাদেশ আমদানিনীতি সংশোধন করে আমেরিকান ব্র্যান্ড অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেবে। অর্থাৎ এসব পণ্য সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকেই আমদানি করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবসা সহজ করার জন্য বাংলাদেশ অ-শুল্ক বাধা দূর করা এবং বিভিন্ন অফিসে ‘কপি সফটওয়্যার’ ব্যবহার থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রস ত ব আম র ক ন আরও ক ছ ক ত কর আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
শিল্পে ন্যায্য জ্বালানির জন্য চাই সমন্বিত পথনকশা
বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত ক্রমবর্ধমানভাবে জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করে আসছে। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান দাম, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অনিশ্চিত গ্যাস সরবরাহ এবং পুরোনো অবকাঠামোর কারণে উৎপাদন সচল রাখতে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যদিও শিল্প উদ্যোক্তারা ব্যবসায় প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিজস্ব উদ্যোগে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এটা বালির বাঁধ নির্মাণের মতোই।
জ্বালানির অন্যতম চ্যালেঞ্জ গ্যাসের শুল্ক নিয়ে দ্বৈত নীতি। পুরোনো কারখানা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য বাবদ প্রায় ১৬ টাকা পরিশোধ করে। নতুন কারখানার জন্য যা ৩০ টাকা অথবা তার বেশি টাকা। দ্বৈত নীতি মিরসরাইয়ের মতো নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন বিনিয়োগকারীর টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। আবার বাংলাদেশে এলএনজি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বিতরণের অবকাঠামোর অভাবও রয়েছে। এলএনজির জন্য আমরা মহেশখালীর কাছে দুটি ভাসমান টার্মিনালের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করি, যেখানে কোনো জমিভিত্তিক স্টোরেজ বা রিজার্ভার নেই। যখন বিশ্বব্যাপী এলএনজির দাম বেড়ে যায় অথবা যখন জাহাজ আসতে দেরি হয়। আমাদের কোনো বাফার থাকে না। নতুন শিল্প এলাকায় প্রায়ই প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাসের চাপ পাওয়া যায় না। অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠানের জন্য এলএনজি ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। স্যাটেলাইট রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা মডুলার স্টোরেজ সমাধান না থাকায় তারা প্রায়ই ডিজেলের মতো ব্যয়বহুল এবং দূষণকারী বিকল্পের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আমাদের অগ্রগতি মন্থর। শিল্প যে জ্বালানি ব্যবহার করে, সেখানে সৌরবিদ্যুৎ এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্ন বিদ্যুতের অংশ এখনও নগণ্য। বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে অনেক কারখানা ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন বা অন-সাইট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নেট মিটারিং ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব– প্রভৃতি কারণে তারা এগোতে পারছে না।
লক্ষ্যণীয় বিষয়, বর্তমান সময়ে শিল্পে জ্বালানি-দক্ষ প্রযুক্তি যেমন ভ্যারিয়েবল স্পিড ড্রাইভস, উচ্চ দক্ষসম্পন্ন মোটর এবং আধুনিক বয়লারের ব্যবহার আর ঐচ্ছিক নয়। এগুলো ব্যবসার নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয়তা। যেহেতু বিদ্যুতের দাম ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে, তাই কারখানাগুলো দূরদর্শিতা সহকারে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কল্পনা করা যাক, একটি কারখানা মাসে এক লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। প্রতি কিলোওয়াট ১০ টাকা করে কারখানাটির মাসিক বিদ্যুৎ বিল হয় ১০ লাখ টাকা। জ্বালানি-দক্ষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কারখানাটি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারে। এভাবে প্রতি মাসে ১৫ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বা দেড় লাখ টাকা সাশ্রয় করতে পারে, যা বছরে ১৮ লাখ টাকা। সাশ্রয় করা অর্থ দিয়ে প্রযুক্তি মানোন্নয়ন, মজুরি বা সাসটেইনেবিলিটি ক্ষেত্রে পুনর্বিনিয়োগ করা যেতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়তা করবে। যেহেতু ক্রেতারা ক্রমবর্ধমানভাবে সাপ্লাই চেইন-জুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর দাবি করছে, তাই জ্বালানি দক্ষতা শুধু অর্থ সাশ্রয় নয়, বরং শিল্পের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়।
গ্যাসের শুল্কনীতি এমন করে প্রণয়ন করতে হবে, যাতে করে শিল্পে নতুন উদ্যোক্তারা বৈষম্য বা হয়রানির সম্মুখীন না হন। আরও কিছু করণীয় রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ল্যান্ড টার্মিনাল, স্টোরেজ ট্যাঙ্ক এবং মডুলার ডিস্ট্রিবিউশন ইউনিটসহ এলএনজি অবকাঠামো তৈরি করা। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্থানান্তর ত্বরান্বিত করা, বিশেষ করে কারখানা ভবনের ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্ন নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কারখানাগুলোকে প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরে কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাস্তবসম্মত; কিন্তু উচ্চাভিলাষী জ্বালানি লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য সরকারের উচিত হবে শিল্প, উন্নয়ন অংশীদার এবং সুশীল সমাজকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা। ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণ এবং এলডিসি থেকে উত্তরণ মসৃণ রাখার জন্য সুস্পষ্ট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা দরকার। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চাপের সময়টিতে যদি আমাদের জ্বালানি ব্যবস্থা শিল্পের একটি বড় অংশকে দুর্বল করে রাখে, তাহলে আমরা সবুজ প্রবৃদ্ধিতে যেতে পারব না।
পরিশেষে, আমাদের জ্বালানি নীতিকে শিল্প কৌশল থেকে আলাদা করে ভাবা বন্ধ করতে হবে। যদি জ্বালানি খুব ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে বা অনিশ্চিত হয়, তাহলে ব্যবসা টিকে থাকবে না। শ্রমিকরা চাকরি হারাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়া আমাদের নাগালের বাইরে থেকে যাবে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেছে। এ মুহূর্তে দরকার একটি সাহসী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সুদূরপ্রসারী জ্বালানি পরিকল্পনা। ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর মানে শুধু পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠা বোঝায় না। আমরা যে ভবিষ্যৎ তৈরি করার চেষ্টা করছি, প্রত্যেকেই যেন সেই ভবিষ্যতের অংশ হতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্যও এটি দরকার।
লেখক : বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক