সিলেট নগরীর আশপাশের এলাকা থেকে শুরু করে ফসলি জমি, প্রতিটি স্থানে পাথর ভাঙার (স্টোন ক্রাশার মেশিন) যন্ত্র স্থাপনে এক অসুস্থ পরিবেশ বিরাজ করছিল নগরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায়; যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল গোয়াইনঘাট উপজেলায়।
স্থানীয় বাসিন্দা, সুশীল সমাজ ও পরিবেশবাদীদের আপত্তি, অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পাথর কোয়ারি ও রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের বলয়ে থাকায় এসব ক্রাশার মেশিনের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল না। এক্ষেত্রে অবশেষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে প্রশাসন। অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে যত্রতত্র ক্রাশার মেশিন স্থাপন ও এর ব্যবসা। একই সঙ্গে অবৈধ ক্রাশার মেশিন বন্ধ করা হচ্ছে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের তৎপরতায়।
সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি থেকে উত্তোলিত পাথর এসব কলেই ভাঙানো হতো। পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি করা পাথর ও ইটও ভাঙা হতো কলগুলোতে। এসব কলের কারণে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল আশপাশের পরিবেশ। তীব্র ও শব্দদূষণের পাশাপাশি মেশিন থেকে বের হওয়া পাথর ও ইটের গুঁড়া বাতাস ভারী করে রাখত। শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়দের পথে চলাচল করতে হতো নাকে রুমাল চেপে।
স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, পাথর ভাঙার জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করে দেওয়ার পরেও যেখানে সেখানে ক্রাশার স্থাপন করা হয়েছে। পাথর কোয়ারি ও রাজনৈতিক মহলের প্রভাবশালীদের সুনজরে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। প্রশাসনের চেষ্টা থাকলেও প্রতিবন্ধকতা ছিল তাদের কাজে। সম্প্রতি এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে প্রশাসন।
গত ১৪ জুন জাফলং এলাকা পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের গাড়িবহরের পথরোধ করে জাফলং পাথর কোয়ারি চালুর দাবি তোলেন স্থানীয় কিছু লোকজন। প্রাথমিকভাবে তাদের সাধারণ শ্রমিক দাবি করা হলেও পরে জানা যায়, স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মীর নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটে। তারা পাথর কোয়ারির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ঘটনার পর গত দু’দিনে দেড় শতাধিক ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খানকে বহিষ্কার এবং জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদল সভাপতি আজির উদ্দিনকে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শোকজ করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে পাথর কোয়ারি ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত অননুমদিত এবং অবৈধ বিষয়গুলো নিয়ে হার্ডলাইনে যায় প্রশাসন; যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অবৈধ ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ সরবরাহের সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং মেশিন উচ্ছেদ করা। ১৪ জুনের পর থেকে কয়েক দফা অভিযানে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে শতাধিক পাথর ভাঙার কলের বিদ্যুৎ সংযোগ।
সিলেট-তামাবিল-জাফলং মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যথেচ্ছ স্থাপন করা হয়েছে পাথর ভাঙার কল। বিশেষ করে জৈন্তাপুরের ৪ নম্বর বাল্লাবাজার, চাংগিল, কদমখাল, বিরাইমারা, আসামপাড়া আদর্শ গ্রাম, শ্রীপুর, মোকামপুঞ্জি এলাকায় শতাধিক কল রয়েছে। এসব কলের কোনোটি বাজারে, কোনোটি জনবসতিপূর্ণ এলাকায়।
নীতিমালা বলছে, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫০০ মিটার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ির ১০০ মিটার এবং প্রধান সড়ক-মহাসড়কের ৫০ মিটারের মধ্যে পাথর ভাঙার কল করা যাবে না। এসব কলের অধিকাংশই নীতিমালা অগ্রাহ্য করে স্থাপন করা হয়েছে। সিলেটের পাঁচ উপজেলায় এমন দেড় হাজারেরও বেশি পাথর ভাঙার কল গড়েছেন মালিকরা। প্রান্তিক এলাকা ছাড়াও সিলেটের শহরতলির ধোপাগুলে ওসমানী বিমানবন্দরের সীমানাপ্রাচীর-সংলগ্ন এলাকায় বছরের পর বছর চলছে অর্ধশতাধিক মেশিন। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ উদ্দিন জানিয়েছেন, তারা বেশ কয়েকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করলেও কোনো কাজ হয়নি।
সিলেট-তামাবিল সড়কের জৈন্তাপুর অংশের মতো পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের চিত্রও নাজুক। ওই এলাকার মোহাম্মদপুর, মামার বাজার ও বল্লাঘাটে সড়কের পাশে চলছে অর্ধশতাধিক মিল। কোম্পানীগঞ্জের সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কের পারুয়া বাজার এলাকা থেকে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি পর্যন্ত শতাধিক ক্রাশার মেশিন চলছে। একইভাবে কানাইঘাট ও সিলেট সদরের লোভাছড়া, ধোপাগুল ও দক্ষিণ সুরমার কুচাই এলাকায়ও গড়ে উঠেছে অসংখ্য মিল। 
পাথর ভাঙার শব্দ ও পাথরের গুঁড়ায় স্থানীয়দের নাভিশ্বাস ওঠেছে। 
সাহেববাজার এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন বলেন, তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধোপাগুল এলাকায়। কিছু সময় পর পর পানি দিয়ে ধুলো ঢেকে রাখছেন। দিন দিন ব্যবসা করা কঠিন হয়ে উঠছে। ভোলাগঞ্জের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হামিদ বলেন, এখানে মানুষ কীভাবে বাঁচে একটু দেখে যাক সবাই। অভিযান শুরু হয়েছে বলে শুনেছেন। আশা করছেন এবার এই দুর্ভোগ ঘুচবে।
সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ কল বসানো হয়েছে ফসলি জমিতে। এতে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। ফসল চাষ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কমছে কৃষি আয়ের ক্ষেত্র। স্থানীয়দের অভিযোগ, কল বসানোর পর থেকে এখানকার জমিগুলোতে ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। দু’দশক ধরে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় রাজত্ব চালাচ্ছে এসব পাথর ভাঙার কল। সড়ক, মহাসড়কের পাশের জমিতে এমনকি স্কুল-কলেজের সামনেও কল আছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, অধিকাংশ কল গড়ে উঠেছে অনুমোদন ছাড়া। এছাড়া ফসলি জমি নষ্ট করে অপরিকল্পিত এসব কলের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। পাথর ভাঙার শ্রমিক ছাড়াও স্থানীয়রা আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগ-ব্যাধিতে। 
এদিকে দুই উপদেষ্টার সঙ্গে গোয়াইনঘাটের ঘটনার পর থেকে এ বিষয়ে প্রশাসনের যে তৎপরতা তা এতদিন কেন ছিল না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েক বাসিন্দা বলেন, উপদেষ্টাদের সঙ্গে সেদিনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলে প্রশাসন কি এমন তৎপর হতো এ ব্যাপারে? সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কি কোনো মূল্য নেই? ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালীদের ভোগান্তি হলে প্রশাসন বেশ শক্ত। এ সময় তারা বদলে যাওয়া বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জনগণের স্বার্থ ও ভোগান্তি সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার অনুরোধ জানান।
সর্বশেষ ধোপাগুল এলাকায় ক্রাশার বন্ধে অভিযান চালায় প্রশাসন। এর আগে বুধবার গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং পাথর কোয়ারি এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে টাস্কফোর্স। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিদ্যুৎ বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি ও বন বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স অভিযান চালায়। এ সময় ৬৭টি ক্রাশার মিলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া গোয়াইনঘাটের ইউএনও রতন কুমার অধিকারী বলেন, অবৈধ স্থাপনা ও পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান চলমান থাকবে। কোনোভাবেই আইন অমান্যকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অভ য ন গ য় ইনঘ ট উপজ ল ব চ ছ ন ন কর ন র পর থ ক ঘটন র পর উপদ ষ ট শত ধ ক ন এল ক পর ব শ এল ক য় ব যবস এ ঘটন এসব ক সড়ক র

এছাড়াও পড়ুন:

চার শতাধিক প্রোগ্রামার নিয়ে রাজধানীতে ‘হিরোইউনিয়ন’

সারাদেশের চার শতাধিক প্রোগ্রামারকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্যতিক্রমী মিললমেলা। শুক্রবার রাজধানীর আইডিইবি অডিটোরিয়ামে দিনব্যাপী এ মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ‘হিরোইউনিয়ন’ শীর্ষক এ আয়োজনে সারাদেশের উদীয়মান প্রোগ্রামিং প্রফেশনালসরা অংশ নেয়। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এডটেক প্রতিষ্ঠান ‘প্রোগ্রামিং হিরো’।

অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন প্রোগ্রামার ও প্রোগ্রামিং হিরো–এর প্রধান নির্বাহী (সিইও) ঝংকার মাহবুব। আরও উপস্থিত ছিলেন সফটওয়্যার কোম্পানি ব্রেইন স্টেশন ২৩–এর সিইও রাইসুল কবির, ব্র্যাক আইটিস-এর সিনিয়র টেকনোলজি অ্যাডভাইজার শাহ আলি নেওয়াজ তপুসহ অন্যান্য প্রযুক্তিবিদ ও ইন্ডাস্ট্রি লিডাররা।

প্রধান আলোচকের বক্তব্যে ঝংকার মাহবুব বলেন, সামনে যতই এআই টুল আসুক না কেন, আমাদের সেটিকে কাজে লাগিয়ে নিজের কোডিং স্কিল ও প্রোডাক্টিভিটি বাড়িয়ে নিতে হবে। লিংকডইনের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে— গিটহাব কো-পাইলটের মতো এআই টুল ব্যবহার করলে একজন প্রোগ্রামারের কোড লেখার গতি গড়ে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে। তবে কোড লেখা যত সহজই হোক না কেন, ফিচার টেস্টিং, বাগ ফিক্সিংয়ের জন্য দক্ষ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন থেকেই যাবে। তাই প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে, এআইকে সহযোগী করে, নিজেদের দক্ষতা অব্যাহতভাবে বাড়াতে হবে।

অনুষ্ঠানের শেষে গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের মাঝে সার্টিফিকেট ও পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে ইন্টার‌অ্যাক্টিভ লার্নিং অ্যাপের মাধ্যমে ‘প্রোগ্রামিং হিরো’র যাত্রা শুরু হয়। এতে মজার ছলে প্রোগ্রামিং শেখার সুযোগ পেত শিক্ষার্থীরা। পরে এডটেক ইন্ডাস্ট্রির প্রচলিত কাঠামো থেকে বের হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডেড লার্নিং এনভায়রনমেন্ট গড়ে তোলে প্রতিষ্ঠানটি; যেখানে একজন শিক্ষার্থী শূন্য থেকে শুরু করে জব–রেডি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠার জন্য ধারাবাহিকভাবে উন্নত ট্রেনিং পেয়ে থাকে। গত পাঁচ বছরে প্রোগ্রামিং হিরো ইতিমধ্যে ৬০টিরও বেশি দেশে ২ হাজার ২৬০ কোম্পানিতে ৪ হাজার ৭০০ জনের শিক্ষার্থীকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ