পাথর ভাঙা কলের বিরুদ্ধে সিলেটজুড়ে অভিযান
Published: 20th, June 2025 GMT
সিলেট নগরীর আশপাশের এলাকা থেকে শুরু করে ফসলি জমি, প্রতিটি স্থানে পাথর ভাঙার (স্টোন ক্রাশার মেশিন) যন্ত্র স্থাপনে এক অসুস্থ পরিবেশ বিরাজ করছিল নগরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায়; যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল গোয়াইনঘাট উপজেলায়।
স্থানীয় বাসিন্দা, সুশীল সমাজ ও পরিবেশবাদীদের আপত্তি, অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পাথর কোয়ারি ও রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের বলয়ে থাকায় এসব ক্রাশার মেশিনের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল না। এক্ষেত্রে অবশেষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে প্রশাসন। অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে যত্রতত্র ক্রাশার মেশিন স্থাপন ও এর ব্যবসা। একই সঙ্গে অবৈধ ক্রাশার মেশিন বন্ধ করা হচ্ছে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের তৎপরতায়।
সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি থেকে উত্তোলিত পাথর এসব কলেই ভাঙানো হতো। পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি করা পাথর ও ইটও ভাঙা হতো কলগুলোতে। এসব কলের কারণে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল আশপাশের পরিবেশ। তীব্র ও শব্দদূষণের পাশাপাশি মেশিন থেকে বের হওয়া পাথর ও ইটের গুঁড়া বাতাস ভারী করে রাখত। শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়দের পথে চলাচল করতে হতো নাকে রুমাল চেপে।
স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, পাথর ভাঙার জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করে দেওয়ার পরেও যেখানে সেখানে ক্রাশার স্থাপন করা হয়েছে। পাথর কোয়ারি ও রাজনৈতিক মহলের প্রভাবশালীদের সুনজরে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। প্রশাসনের চেষ্টা থাকলেও প্রতিবন্ধকতা ছিল তাদের কাজে। সম্প্রতি এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে প্রশাসন।
গত ১৪ জুন জাফলং এলাকা পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের গাড়িবহরের পথরোধ করে জাফলং পাথর কোয়ারি চালুর দাবি তোলেন স্থানীয় কিছু লোকজন। প্রাথমিকভাবে তাদের সাধারণ শ্রমিক দাবি করা হলেও পরে জানা যায়, স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মীর নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটে। তারা পাথর কোয়ারির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ঘটনার পর গত দু’দিনে দেড় শতাধিক ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খানকে বহিষ্কার এবং জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদল সভাপতি আজির উদ্দিনকে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শোকজ করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে পাথর কোয়ারি ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত অননুমদিত এবং অবৈধ বিষয়গুলো নিয়ে হার্ডলাইনে যায় প্রশাসন; যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অবৈধ ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ সরবরাহের সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং মেশিন উচ্ছেদ করা। ১৪ জুনের পর থেকে কয়েক দফা অভিযানে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে শতাধিক পাথর ভাঙার কলের বিদ্যুৎ সংযোগ।
সিলেট-তামাবিল-জাফলং মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যথেচ্ছ স্থাপন করা হয়েছে পাথর ভাঙার কল। বিশেষ করে জৈন্তাপুরের ৪ নম্বর বাল্লাবাজার, চাংগিল, কদমখাল, বিরাইমারা, আসামপাড়া আদর্শ গ্রাম, শ্রীপুর, মোকামপুঞ্জি এলাকায় শতাধিক কল রয়েছে। এসব কলের কোনোটি বাজারে, কোনোটি জনবসতিপূর্ণ এলাকায়।
নীতিমালা বলছে, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫০০ মিটার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ির ১০০ মিটার এবং প্রধান সড়ক-মহাসড়কের ৫০ মিটারের মধ্যে পাথর ভাঙার কল করা যাবে না। এসব কলের অধিকাংশই নীতিমালা অগ্রাহ্য করে স্থাপন করা হয়েছে। সিলেটের পাঁচ উপজেলায় এমন দেড় হাজারেরও বেশি পাথর ভাঙার কল গড়েছেন মালিকরা। প্রান্তিক এলাকা ছাড়াও সিলেটের শহরতলির ধোপাগুলে ওসমানী বিমানবন্দরের সীমানাপ্রাচীর-সংলগ্ন এলাকায় বছরের পর বছর চলছে অর্ধশতাধিক মেশিন। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ উদ্দিন জানিয়েছেন, তারা বেশ কয়েকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করলেও কোনো কাজ হয়নি।
সিলেট-তামাবিল সড়কের জৈন্তাপুর অংশের মতো পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের চিত্রও নাজুক। ওই এলাকার মোহাম্মদপুর, মামার বাজার ও বল্লাঘাটে সড়কের পাশে চলছে অর্ধশতাধিক মিল। কোম্পানীগঞ্জের সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কের পারুয়া বাজার এলাকা থেকে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি পর্যন্ত শতাধিক ক্রাশার মেশিন চলছে। একইভাবে কানাইঘাট ও সিলেট সদরের লোভাছড়া, ধোপাগুল ও দক্ষিণ সুরমার কুচাই এলাকায়ও গড়ে উঠেছে অসংখ্য মিল।
পাথর ভাঙার শব্দ ও পাথরের গুঁড়ায় স্থানীয়দের নাভিশ্বাস ওঠেছে।
সাহেববাজার এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন বলেন, তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধোপাগুল এলাকায়। কিছু সময় পর পর পানি দিয়ে ধুলো ঢেকে রাখছেন। দিন দিন ব্যবসা করা কঠিন হয়ে উঠছে। ভোলাগঞ্জের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হামিদ বলেন, এখানে মানুষ কীভাবে বাঁচে একটু দেখে যাক সবাই। অভিযান শুরু হয়েছে বলে শুনেছেন। আশা করছেন এবার এই দুর্ভোগ ঘুচবে।
সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ কল বসানো হয়েছে ফসলি জমিতে। এতে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। ফসল চাষ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কমছে কৃষি আয়ের ক্ষেত্র। স্থানীয়দের অভিযোগ, কল বসানোর পর থেকে এখানকার জমিগুলোতে ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। দু’দশক ধরে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় রাজত্ব চালাচ্ছে এসব পাথর ভাঙার কল। সড়ক, মহাসড়কের পাশের জমিতে এমনকি স্কুল-কলেজের সামনেও কল আছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, অধিকাংশ কল গড়ে উঠেছে অনুমোদন ছাড়া। এছাড়া ফসলি জমি নষ্ট করে অপরিকল্পিত এসব কলের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। পাথর ভাঙার শ্রমিক ছাড়াও স্থানীয়রা আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগ-ব্যাধিতে।
এদিকে দুই উপদেষ্টার সঙ্গে গোয়াইনঘাটের ঘটনার পর থেকে এ বিষয়ে প্রশাসনের যে তৎপরতা তা এতদিন কেন ছিল না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েক বাসিন্দা বলেন, উপদেষ্টাদের সঙ্গে সেদিনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলে প্রশাসন কি এমন তৎপর হতো এ ব্যাপারে? সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কি কোনো মূল্য নেই? ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালীদের ভোগান্তি হলে প্রশাসন বেশ শক্ত। এ সময় তারা বদলে যাওয়া বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জনগণের স্বার্থ ও ভোগান্তি সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার অনুরোধ জানান।
সর্বশেষ ধোপাগুল এলাকায় ক্রাশার বন্ধে অভিযান চালায় প্রশাসন। এর আগে বুধবার গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং পাথর কোয়ারি এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে টাস্কফোর্স। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিদ্যুৎ বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি ও বন বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স অভিযান চালায়। এ সময় ৬৭টি ক্রাশার মিলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া গোয়াইনঘাটের ইউএনও রতন কুমার অধিকারী বলেন, অবৈধ স্থাপনা ও পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান চলমান থাকবে। কোনোভাবেই আইন অমান্যকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অভ য ন গ য় ইনঘ ট উপজ ল ব চ ছ ন ন কর ন র পর থ ক ঘটন র পর উপদ ষ ট শত ধ ক ন এল ক পর ব শ এল ক য় ব যবস এ ঘটন এসব ক সড়ক র
এছাড়াও পড়ুন:
কিশোরগঞ্জে হেযবুত তওহীদের গোলটেবিল বৈঠকে পুলিশি বাধা, সভা পণ্ড
কিশোরগঞ্জে হেযবুত তওহীদের একটি গোলটেবিল বৈঠক পুলিশের বাধার কারণে পণ্ড হয়ে যায়। কেন্দ্রঘোষিত ‘রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবনা—তওহীদভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা’ শিরোনামে আজ সোমবার বেলা ১১টায় শহরের একটি রেস্তোরাঁর পার্টি সেন্টারে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তবে পুলিশের বাধার কারণে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি পণ্ড হয়ে গেছে।
আয়োজনের কয়েক দিন আগে থেকেই জেলায় কর্মরত সাংবাদিকদেরও দাওয়াত দিয়েছিল হেযবুত তওহীদ। সংগঠনের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনুষ্ঠান সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়।
সংগঠন ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সোমবার বেলা ১১টার দিকে গোলটেবিল বৈঠক শুরু হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয় কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল। এ আয়োজনের জন্য প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয়নি জানিয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেয় পুলিশ। এ সময় নেতারা বৈঠকে উপস্থিত লোকদের কাছে বিদায় নেওয়ার জন্য পুলিশের কাছে একটু সময় চান। তবে পুলিশ তাৎক্ষণিক সভা বন্ধ করতে বলে। ফলে হেযবুত তওহীদের নেতা-কর্মীরা বৈঠক করতে পারেননি। পরে সংগঠনের প্রচারপত্র বিতরণ করে উপস্থিতি লোকজনকে বিদায় দেন বৈঠকের আয়োজকেরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, এ অনুষ্ঠান করার জন্য প্রশাসনের কাছ থেকে হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। অনুমতি ছাড়া সভা করা উচিত হয়নি। যে কারণে তাদের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এ সময় কিশোরগঞ্জ জেলা হেযবুত তওহীদের সভাপতি সোহানুর রহমানের সভাপতিত্বে আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল আলম। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় সভাপতি এনামুল হক, ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি তসলিম উদ্দিন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন জেলার নারী সম্পাদক সাথী আক্তার।
এ বিষয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মাহফুজুল আলম বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র গঠনে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। আমরাও আমাদের প্রস্তাব সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজের কাছে দিয়েছি। এই প্রস্তাব বিষয়েই আমরা সারা দেশে আলোচনা সভা ও বৈঠক করে যাচ্ছি। তবে কোথাও কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। জাতীয় প্রেসক্লাবেও অনুষ্ঠান করেছি। কিন্তু কিশোরগঞ্জে আমাদের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াটা খুবই দুঃখজনক।’