যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় রাজত্ব করেছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ (১৯২৬-২০২২)। তাঁকে মানা হয় দৃঢ়, নির্ভীক ও স্থির শাসক হিসেবে। ৭০ বছরের শাসনামলে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন ১৫ জন প্রধানমন্ত্রী। রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত থেকেই হাসিমুখে মোকাবিলা করেছেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট, বৈশ্বিক মহামারি, প্রিন্স হ্যারি ও মেগানের রাজপরিবার ত্যাগ, এমনকি স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুর মতো ঘটনা। তবে প্রয়াত মহারানি কখনোই ধৈর্য হারাননি।

অথচ এমন কিছু একটা ছিল, যা তাঁকে প্রচণ্ড ভীত করে তুলত। যদিও জনসমক্ষে তিনি কাউকে তা বুঝতে দেননি। ফলে এটা আন্দাজ করা যে কারও পক্ষেই কঠিন। সম্প্রতি ব্রিটিশ রাজপরিবারের একজন জীবনীকার এক পডকাস্টে প্রকাশ করলেন এমন চমকপ্রদ তথ্য।

রানি এলিজাবেথের ভয়

ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ‘ডেইলি মেইল’-এর পডকাস্ট ‘কুইন্স, কিংস অ্যান্ড ডাস্টার্ডলি থিংস’-এ রাজপরিবারের জীবনীকার রবার্ট হার্ডম্যান বলেন, ‘তিনি (রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ) কেবল একটি জিনিসই ভয় পেতেন এবং সেটা ছিল হেলিকপ্টার।’ হার্ডম্যান যোগ করেন, ‘সয়ে নিতে পারতেন অন্য সবকিছু। তিনি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গেছেন, আরও না জানি কত কিছু সামলেছেন, কিন্তু সব সময়ই হেলিকপ্টার সম্পর্কে তাঁর মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার কাজ করত।’

অথচ প্রয়াত রানির নাতিসহ ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের অন্যতম প্রধান ও প্রিয় যানই হলো হেলিকপ্টার।

কেন এই ভয়

হার্ডম্যানের মতে, ভয়ের শুরু ১৯৬৭ সালে। সে বছর রানির ফ্লাইট ক্যাপ্টেন জে এইচ এল ব্লাউন্ট তিনজন যাত্রীসহ একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা যান। ওয়েস্টল্যান্ড ওয়ার্লউইন্ড এইচসিসি.

১২ হেলিকপ্টারটি সে বছরের ৭ ডিসেম্বর পশ্চিম লন্ডনের অক্সফোর্ডশায়ার থেকে সামারসেটের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। আকস্মিকভাবে প্রধান রোটর ও ব্লেড আলাদা হয়ে যাওয়ায় হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয় একটি মাঠে। হার্ডম্যান উল্লেখ করেন, এ দুর্ঘটনা রানির মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তিনি মর্মাহত হন। তখন থেকে, সম্ভব হলেই রানি এলিজাবেথ হেলিকপ্টার ভ্রমণ এড়িয়ে চলতেন।

অবশ্য রানি হওয়ায় এবং ভীষণ ব্যস্ততা থাকায় সব সময় ‘না’ বলতে পারতেন না। ১৯৭৭ সালে রানি পালন করেছিলেন রজতজয়ন্তী (সিংহাসনে আরোহণের ২৫ বছর পূর্তি)। এ উপলক্ষে তিনি দেশভ্রমণের পরিকল্পনা করেন। হার্ডম্যান জানান, বিকল্প না থাকায় রানিকে প্রথমে ব্রিটিশ রণতরিতে ওঠানো হয়। সেখান থেকে প্রথমবারের মতো তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন অংশে ঘুরে জয়ন্তী উদ্‌যাপন করেন।

এরপরও তাঁর হেলিকপ্টার-ভীতি কাটেনি। এমনকি জীবনের শেষ দিকেও খারাপ আবহাওয়া ও বর্ষাকালে এ উড়োযানে তাঁর মন সায় দিত না।

আরও পড়ুনরানি ভিক্টোরিয়াও ছিলেন এই রোগের বাহক, জেনে নিন উপসর্গগুলো ১৭ এপ্রিল ২০২৩পরিবারের সদস্যদের হেলিকপ্টার ব্যবহারে রানির ফরমান

সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও পরিবারের সদস্যরা এই যান ব্যবহার করলে রানি তা পছন্দ করতেন না। মজার ব্যাপার হলো, চার্লস, এডওয়ার্ড ও অ্যান্ড্রু—অর্থাৎ তাঁর তিন ছেলেই ছিলেন সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার পাইলট। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন তাঁর নাতি উইলিয়াম ও হ্যারিও। এমনকি প্রিন্স হ্যারি হেলিকপ্টার উড়িয়েছেন আফগানিস্তানেও। সিংহাসনের উত্তরাধিকার হওয়ায় প্রিন্স উইলিয়ামের যুদ্ধে যাওয়া ছিল বারণ। তবে তিনি উদ্ধারকারী হেলিকপ্টারের পাইলট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

অভিজ্ঞ পাইলট প্রিন্স উইলিয়াম একবার রানির অনুরোধ অমান্য করে তাঁর (প্রিন্স) পরিবারকে নিয়ে হেলিকপ্টারে ওঠেন। নিজে চালিয়ে পাড়ি দেন কেনসিংটন প্রাসাদ থেকে নরফোকের আনমার হল, অর্থাৎ নিজের বাড়ি পর্যন্ত ১১৫ মাইল দূরের পথ। এতে রানি বেজায় বিরক্ত হন।

রাজপরিবারের জীবনীকার, লেখক ও সাংবাদিক রবার্ট জবসন তাঁর বই ‘ক্যাথরিন, দ্য প্রিন্সেস অব ওয়েলস: আ বায়োগ্রাফি অব দ্য ফিউচার কুইন’-এ একজন সহকারীর বরাত দিয়ে লিখেছেন, ১৯৬৭ সালের দুর্ঘটনা রানিকে সব সময় তাড়া করে বেড়াত। পরে রাজা চার্লসও রানির এই দুশ্চিন্তার বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রিন্স উইলিয়াম যখন পারিবারিক হেলিকপ্টার-যাত্রা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান, তখন ঝুঁকি স্বীকার করে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায়ভার নেওয়ার ব্যাপারে একটি নথিতে স্বাক্ষর করতে তাঁকে বাধ্য করেন বর্তমান রাজা।

আরও পড়ুনরানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সম্পর্কে এসব তথ্য জানতেন কি?০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২একসঙ্গে ভ্রমণের ব্যাপারে রাজপরিবারে নিয়ম যেমন

ভবিষ্যতে রাজসিংহাসনে বসার দাবিদার, এমন দুজন অর্থাৎ রাজা বা রানির দুজন উত্তরসূরি কখনো একসঙ্গে একই বিমান বা হেলিকপ্টারে ভ্রমণ করতে পারেন না। যেকোনো দুর্ঘটনার পরও যেন রাজতন্ত্র বজায় থাকে, তাই এ নিয়ম। রাজপরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হয় ১২ বছর বয়স থেকে। এর মানে, এ বছর জুলাই থেকেই হয়তো প্রিন্স জর্জ তার বাবা উইলিয়ামের সঙ্গে আর আকাশপথে ভ্রমণ করতে পারবে না। তবে নিয়ম বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নির্ভর করছে প্রিন্স উইলিয়াম ও কেটের ওপর। আবার রাজা চার্লস চাইলেও পরিবর্তন আসতে পারে এসব নিয়মকানুনে। সামনের গ্রীষ্মের ছুটিতে সদ্য ১২ পেরোনো জর্জ তার মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট

আরও পড়ুনপ্রিন্সেস ডায়ানা সম্পর্কে সাবেক প্রেমিক এমন কিছু তথ্য ফাঁস করলেন, যা বিশ্ব আগে জানত না১০ মার্চ ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জপর ব র র প র ন স উইল এল জ ব থ পর ব র র দ র ঘটন উইল য় ম কর ছ ন ভ রমণ

এছাড়াও পড়ুন:

জামদানির ‘মিথ’ ভাঙলেন ফরিদপুরের মোস্তাফিজুর

৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১০ ফুট প্রস্থের একটি টিনের ঘর। এর মধ্যে সারিবদ্ধভাবে সাজানো ছয়টি তাঁত। প্রতিটি তাঁতে দুজন করে বসে একসঙ্গে কাজ করছেন ১২ জন। রেশম সুতা, বাইনা সুতা ও জরির বুননে তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য জামদানি শাড়ি।

এভাবেই মোস্তাফিজুর রহমানের ছোট্ট টিনের ঘরে মাসে ২২ থেকে ২৫টি জামদানি শাড়ি তৈরি হচ্ছে। সেগুলো বিক্রিও হয়ে যাচ্ছে। তাঁর এই কারখানার অবস্থান ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল গ্রামে।

অজপাড়াগাঁয় বসেই বাংলাদেশের প্রথম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া জামদানি বুনছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, ‘অনেকে বলেন শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে তৈরি জামদানি শাড়ির মান ভালো। এ মিথ আমি ভেঙে দিয়েছি। সঠিক উপকরণের সঠিক ব্যবহার করলে এবং কাজের প্রতি মমত্ববোধ ও একাগ্রতা থাকলে দেশের যেকোনো জায়গা থেকেই ভালো মানের জামদানি শাড়ি প্রস্তুত করা সম্ভব।’

মোস্তাফিজুরের শাড়ির মান ভালো হওয়ার কারণে ক্রেতারা বাড়িতে এসে কিনে নেন। আবার বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে আগে থেকেও তাঁকে শাড়ির ফরমাশ দিয়ে রাখেন অনেকে। আবার অনেক সময় রূপগঞ্জের বিসিক শিল্পনগরীতেও পাঠান তাঁর শাড়ি।

প্রথমে শিখেছেন, এখন শেখাচ্ছেন

জামদানির নকশা সুচিকর্মে ফুটিয়ে তোলা হয় না, ছাপাও হয় না। এর বুনন এক বিস্ময়কর বয়নকৌশল। বাবা থেকে ছেলে, ওস্তাদ থেকে শাগরেদ—শ্রুতি ইতিহাস আর হাতে–কলমে শেখার মধ্য দিয়ে পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে এই বয়নশিল্প।

অভাবের সংসারে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি মোস্তাফিজুর রহমানের। এ কারণে শৈশব থেকেই জীবিকার সন্ধানে নিয়োজিত করেন নিজেকে। ১৬ বছর বয়সে ২০০৭ সালে তিনি চলে যান নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার জামদানিপল্লিতে। সেখানেই তিনি জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ শেখেন। এরপর রূপগঞ্জেই একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। সেখানে কাটিয়ে দেন ১৪ বছর।

একসময় মন চায় নিজ এলাকায় ফিরতে। ২০২১ সালে তিনি ফিরে আসেন ফরিদপুরের পানাইল গ্রামের নিজ বাড়িতে। সেখানেই একটি তাঁত বসিয়ে জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। আগ্রহী অন্যদেরও বুননের কাজ শেখাতে থাকেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাঁত ও কারিগরের সংখ্যা। এখন তাঁর মোট ছয়টি তাঁত। এতে কাজ করছেন তিনিসহ ১২ জন। ইতিমধ্যে স্ত্রী নিলা বেগম তাঁতের কাজ শিখে নিয়েছেন। তিনিও সংসারের কাজের ফাঁকে স্বামীর সঙ্গে জামদানি বোনায় হাত লাগান।

নিজের কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নেই মোস্তাফিজুরের। শাড়ি বিপণনের জন্য তিনি একটি নামও দিয়েছেন—‘মুসলিম জামদানি ঘর’। যদিও বাড়ির কোথাও এ নামে কোনো সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়নি। মোস্তাফিজুর রহমান জানান, শাড়ি উৎপাদনে এখন পর্যন্ত তিনি পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। একটা শাড়িতে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ রেশমি সুতা থাকে। রেশমি সুতা কেনা হয় রাজশাহী থেকে। একটি শাড়িতে সুতা বাবদ ব্যয় হয় অন্তত দুই হাজার টাকা। সুতা কেনা থেকে শুরু করে কারিগরদের বেতন দেওয়ার পরও প্রতি মাসে তাঁর ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ থাকে।

মোস্তাফিজুর রহমানের মোট ছয়টি তাঁত। এতে কাজ করেন তিনিসহ ১২ জন

সম্পর্কিত নিবন্ধ