বাতের ব্যথায় নাজেহাল বাদ দিন ৫ খাবার
Published: 23rd, June 2025 GMT
রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে মানবদেহে রয়েছে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তথা ইমিউন সিস্টেম। শরীরকে পাহারা দেওয়া এর কাজ। তবে কখনও এই ইমিউন সিস্টেমই শরীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখন শরীরের গিঁট, মাংসপেশিসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যথা হয়।
অনেকের ধারণা, বাতজাতীয় রোগগুলো শুধু বৃদ্ধকালে হবে। এটি ভুল। শিশু থেকে ৬০-৭৫ বছর বয়সী মানুষের বাত হতে পারে।এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি ঠিক কী কারণে ইমিউন সিস্টেম শরীরকে উল্টো আক্রমণ করে বসে। আবার কারা এ বাতে আক্রান্ত হবেন সেটিও আগাম বলা যায় না। তবে কিছু কারণ বের হয়েছে অনেক দিনের গবেষণায়।
কোমরে যন্ত্রণা, হাঁটুর ব্যথায় ভুগতে দেখা যায় অনেককেই। বয়স বাড়লে এসব সমস্যা বেশি হয়। তবে এখন আর্থ্রাইটিসের মতো রোগ কম বয়সেও হানা দিচ্ছে শরীরে। আর্থ্রাইটিসের মূলত দুটি ভাগ। অস্টিও আর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। অনেকেরই ধারণা, আর্থ্রাইটিসের সমস্যা কখনও সঙ্গ ছাড়ে না। চিকিৎসা ও সঠিক খাওয়াদাওয়ার মাধ্যমে ব্যথা কমানো সম্ভব। কয়েকটি খাবার আছে, যা খেলে আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর্থ্রাইটিসে ভুগলে রোজের ডায়েটে কোন খাবারগুলো এড়িয়ে চলবেন?
l বাতের ব্যথা থাকলে প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন– সসেজ, বেকন ও হ্যাম খাওয়া যাবে না। এ ছাড়া চিপস, চিজ, পপকর্নের মতো প্যাকেটবন্দি খাবারও আর্থ্রাইটিসের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর।
lপ্রক্রিয়াজাত মাংস ও লাল মাংস প্রদাহ বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে বাড়তে পারে বাতের ব্যথা। এই ধরনের মাংসে ইন্টারলিউকিন, সি-রিঅ্যাক্টিভ প্রোটিন ও হোমোসিস্টেইনের মতো উপাদান থাকে, যা প্রদাহ বাড়াতে পারে।
l ওমেগা-৬ যুক্ত খাবার যেমন– সয়াবিন, মাংস, বাদাম ও ভুট্টা হাড়ের ব্যথা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এড়িয়ে চলাই ভালো।
l আর্থ্রাইটিসে কাঁচা নুন খাওয়ার অভ্যাস খুবই ক্ষতিকর। কাঁচা নুনে সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে, যা আর্থ্রাইটিসের ব্যথা স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ করতে সক্ষম।
l চিনি দেওয়া শরবত, নরম পানীয়, সোডা দেওয়া ফলের রস আর্থ্রাইটিসের রোগীদের পক্ষে একেবারেই উপকারী নয়। এগুলো ছাড়াও ভাজাভুজি, তেল-ঝাল-মসলাদার খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
এক অকুতোভয় বুদ্ধিজীবীর ৯০তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি
বাংলাদেশের প্রগতিশীল চিন্তার জগতে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। মার্কসীয় দর্শন, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আলোকে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও সাহিত্যের গভীর বিশ্লেষণ করে গেছেন আজীবন। আজ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ৯০তম জন্মদিনে পদার্পণ করছেন। এই দিনে একজন বরেণ্য জ্ঞানতাপসের প্রতিচ্ছবি আমাদের মনে গভীর শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলে, যিনি দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিকে বুঝতে আমাদের পথ দেখিয়েছেন। আমাদের অনেকের কাছে, বিশেষ করে যারা ১৯৮০-এর দশকে বেড়ে উঠেছি, তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল এক স্পষ্ট এবং সমালোচনামূলক চিন্তার বাতিঘর।
ব্যক্তি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয়ের অনেক আগে পরিচয় হয় তাঁর তৎকালীন জনপ্রিয় কলামিস্ট ‘গাছ পাথর’-এর সঙ্গে। তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। আমার কোনো ধারণা ছিল না যে কে এই কলাম লেখেন। দৈনিক সংবাদে ছাপা হওয়া আশির দশকে এই কলাম যেন মধ্যবিত্ত সমাজের মুখপত্র হয়ে উঠেছিল। তাঁর প্রথম বই পড়ি ‘বেকনের মৌমাছিরা’। একগুচ্ছ প্রবন্ধ। সবে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ করেছি। হাতে বেশ সময়। যা পাচ্ছি তাই পড়ার চেষ্টা করেছি। এ রকম সময়ে বন্ধু মাযহার-এর কাছ থেকে পেলাম বইটা। মফঃস্বলে বড় হয়েছি। ফ্রান্সিস বেকন কে জানতাম না। সে কারণে বইটার টাইটেল প্রথম বুঝতে পারিনি। অবশ্য তাতে এই সুপাঠ্য বইটা পড়তে একটুও আটকায়নি। অনেক বক্তব্য তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। কিন্তু সেই অজ্ঞতাই আমাকে আরও গভীরে যেতে শিখিয়েছিল।
খেয়াল করলে দেখা যাবে তাঁর চিন্তা এবং বিশ্লেষণের ভিত্তি অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানতত্ত্ব ও মার্কসীয় পদ্ধতি। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কেবল একজন লেখক নন; তিনি একজন জনবুদ্ধিজীবী, যার সমগ্র পাণ্ডিত্যপূর্ণ জীবন বাংলাদেশের সমাজের জটিলতা এবং রাজনীতির ব্যবচ্ছেদেই উৎসর্গীকৃত। তাঁর কাজ মার্কসবাদী বিশ্লেষণের সুগভীর প্রয়োগ দ্বারা চিহ্নিত, যেখানে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে ব্যবহার করে তিনি সমাজের শ্রেণিসংগ্রাম, রাষ্ট্রের প্রকৃতি, বাংলার মধ্যবিত্তের দ্বিধাদ্বন্দ্ব– সবকিছুই তিনি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। জাতির যাত্রাপথকে রূপদানকারী শক্তিগুলোকে উন্মোচন করেছেন। যদিও তাঁর চিন্তাধারা কখনও কখনও একমুখী মনে হয়েছে; কিন্তু সত্য উন্মোচনের প্রশ্নে তাঁকে আপস করতে দেখা যায় না। তবে বেকনের নিজস্ব অভিজ্ঞতামূলক অনুসন্ধানের প্রতি নিবেদনের মতোই, সত্যের প্রতি তাঁর এই নিবদ্ধ এবং অবিচল অনুসন্ধানই তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক সততাকে সংজ্ঞায়িত করে। মাতৃভূমির সেবায় তাঁর অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি তাঁর নীতিকে কখনও বিসর্জন দেননি। পক্ষপাতিত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে সত্যকে তুলে ধরার তাঁর অটল অঙ্গীকার তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে, তা যতই অস্বস্তিকর বা কঠিন হোক না কেন।
সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে গভীর অবদানগুলোর মধ্যে একটি হলো বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি সম্পর্কে অতুলনীয় বোঝাপড়া। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজেই বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের এক প্রতিনিধি। তাই এই শ্রেণির আকাঙ্ক্ষা, স্ববিরোধিতা, ভণ্ডামি, আত্মসংকট ও প্রগতিশীল সম্ভাবনা– সবই তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে অবিচ্ছেদ্য স্বাচ্ছন্দ্যে। তাঁর বিশ্লেষণে মধ্যবিত্তের ‘দোদুল্যমানতা’ কেবল একটি সমাজতাত্ত্বিক ধারণা নয়, বরং এক জীবন্ত বাস্তবতা।
শুধু তত্ত্ব নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তিনি লালন করেছেন আজীবন। স্বাধীনতার পরের রাষ্ট্রযন্ত্র, সামরিক শাসনের কালো অধ্যায়, গণতন্ত্রের সংগ্রাম– সবই তাঁর লেখনীতে উঠে এসেছে স্পষ্টবাদিতার সঙ্গে। তিনি শুধু বুদ্ধিজীবীই নন, একজন সক্রিয় রাজনৈতিক মানুষ, যার কলম কখনও নতি স্বীকার করেনি।
আমাদের মতো অনেকেরই চিন্তার জগৎ প্রভাবিত হয়েছে তাঁর লেখা দিয়ে। জুলাই অভ্যুথান-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুনভাবে জাতির পরিচয়, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদের ধারণাগুলোর নতুন বয়ান নির্মাণের বহুমুখী প্রচেষ্টা সামনে আসছে তখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দৃঢ় কণ্ঠস্বর আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের শেখায়– সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস কখনও অপ্রয়োজনীয় নয়।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শুধু আমাদের সমাজকে পর্যবেক্ষণ করেননি; তিনি তাঁর তীক্ষ্ণ সমালোচনা এবং সুচিন্তিত প্রস্তাবনার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর উত্তরাধিকার অবিচল বুদ্ধিবৃত্তিক সততা, সত্যের নিরন্তর অনুসন্ধান এবং তাঁর দেশ ও মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা দ্বারা চিহ্নিত। তাঁর ৯০তম জন্মদিনে আমরা কেবল একজন বিশাল পণ্ডিত এবং নির্ভীক জনবুদ্ধিজীবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি না, বরং এমন একটি মনের স্থায়ী প্রভাবকেও স্বীকার করছি যা আমাদের ক্রমাগত ভাবতে, প্রশ্ন করতে এবং একটি উন্নত বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম করতে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর ‘গাছ পাথর’ হয়তো একটি ছদ্মনাম ছিল; কিন্তু তাঁর জ্ঞান সর্বদা স্পষ্ট, শক্তিশালী এবং নিঃসন্দেহে তাঁর নিজস্ব।
অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক