রাষ্ট্রের বি‍ভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এটি কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা। এর আগে প্রথম পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে দুই মাস সময় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেছিল কমিশন। প্রথম পর্বে যেসব মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য হয়নি সেগুলোর বিষয়ে এই পর্বে সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

দ্বিতীয় পর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের এখন পর্যন্ত পাঁচ দিন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হয়েছে। এর আগের পাঁচ দিনে আলোচনা হয়েছে ৯টি বিষয়ে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। আগামীকাল বুধবার আবার আলোচনা হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, দ্বিতীয় পর্বে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দলগুলোর সঙ্গে মোট ২০টির মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করার প্রস্তুতি আছে। তবে কমিশন এই সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। আলোচনায় অগ্রগতি সাপেক্ষে প্রয়োজনে আরও বিষয় যুক্ত করা হবে।

গত পাঁচ দিনে নয়টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেগুলো হলো— সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা, ১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোট, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল (এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ কত সময় প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন) এবং সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি।

এর মধ্যে প্রথম দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এর বাইরে কিছু ক্ষেত্রে আংশিক ঐকমত্য হয়েছে। তবে বাকি বিষয়গুলো আলোচনার টেবিল থেকে এখনো বাদ দেওয়া হয়নি। সেগুলো নিয়েও ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা অব্যাহত আছে, আরও আলোচনা হবে। এই আলোচনা কত দিন চলবে তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করার লক্ষ্য রয়েছে কমিশনের। অবশ্য ইতিমধ্যে কোনো কোনো দলের মুখে এই আলোচনা নিয়ে হতাশা ফুটে উঠেছে।

‘আশা করছি আগামীতে জাতীয় স্বার্থে দলগুলো প্রয়োজনে কিছুটা ছাড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে এবং দ্রুত একাধিক বিষয়ে ঐকমত্য হবে।’অধ্যাপক আলী রীয়াজসহসভাপতি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশান ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয়। পরে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই ছয়টি কমিশনের প্রধানদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন সংস্কারের ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর কাছ থেকে ছক আকারে মত নেয়। এরপর ২০ মার্চ থেকে শুরু হয় দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনা। এটি চলে ১৯ মে পর্যন্ত। গত ২ জুন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার উদ্বোধন করেন।

যে দুই বিষয়ে ঐকমত্য

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, কিছু সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে করার প্রস্তাবে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। দুই দিন আলোচনার পর এ দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়।

৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন সংসদ সদস্যরা।

দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা (এমপি) পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন বা স্বাধীন থাকবেন।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের আরেকটি প্রস্তাব ছিল, সবগুলো সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে করা হবে। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, সরকারি হিসাব, অনুমিত হিসাব, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ অধিকার–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি—এই চারটিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ আসনের সংখ্যানুপাতে বিরোধী দলের মধ্য থেকে দেওয়া হবে। অর্থাৎ বিরোধী দলগুলো সংসদে যে কটি আসন পাবে, তার অনুপাতে সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ পাবে।

এনসিসি নিয়ে জোর আপত্তি বিএনপির

ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে এবং এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা যাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে না যায়, সে জন্য সংবিধানে যেসব সংস্কার আনার প্রস্তাব করা হয়েছে, তার একটি হলো জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন। প্রস্তাব অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ—রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এনসিসি গঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি), পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ (পিএসসি) বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের নিয়োগের জন্য এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ দেবেন।

বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়। এনসিসি গঠন করা হলে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমবে।

জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ অনেক দল নীতিগতভাবে এ প্রস্তাবকে সমর্থন করে। তবে এনসিসির গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা আছে।

অন্যদিকে বিএনপি, সিপিবি, গণফোরাম, বাসদসহ কিছু দল এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত নয়। বিশেষত এনসিসি নিয়ে বিএনপির জোরালো আপত্তি আছে। তারা মনে করে, এনসিসি গঠন করা হলে প্রধানমন্ত্রী পদের গুরুত্ব কমে যাবে। সরকার হবে দুর্বল।

প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ

সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আলোচনায় নতুন প্রস্তাব আসে। তা হলো—এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন। এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ বেশির ভাগ দল একমত। তবে বিএনপি, বিএলডিপি ও এনডিএমের আপত্তি আছে। এটি নিয়ে আরও আলোচনা হবে।

অবশ্য এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি কত দিন থাকবেন তার একটি সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। তবে বিএনপি মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্ধারণ করে দেওয়ার সঙ্গে এনসিসি গঠন হচ্ছে কি না, সংসদের উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কী হবে—এসব বিষয়ও সম্পর্কিত। তাই সবগুলো প্রস্তাব একসঙ্গে প্যাকেজ আকারে আলোচনা করার পক্ষে দলটি।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ

সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সংসদ বা আইনসভাকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাব করেছে। এ ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষে ভোট হবে বিদ্যমান পদ্ধতিতে। আর উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসনের। নিম্নকক্ষে একটি দল সারা দেশে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে।

সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করা এবং উচ্চকক্ষে ১০০ টি আসন করার বিষয়ে বেশিরভাগ দল একমত। তবে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে অনেক মতভিন্নতা আছে। এনসিপি উচ্চকক্ষের প্রস্তাবিত নির্বাচনপদ্ধতির সঙ্গে একমত। তারা চায় উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা আগেই প্রকাশ করা হোক। অন্যদিকে বিএনপি চায় নিম্নকক্ষে একটি দল যতগুলো আসন পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে। আর জামায়াতে ইসলামী সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচন আনুপাতিক পদ্ধতিতে করার পক্ষে।

অবশ্য কোনো কোনো দল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করার বিপক্ষে। তারা মনে করে এতে ‘মাথাভারী’ হবে।

আরও পড়ুনপ্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর, আলোচনায় ঐকমত্য হয়নি ২২ জুন ২০২৫

অন্যান্য প্রস্তাবেও মতভিন্নতা

সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ১০০টি করা এবং এসব আসনে সরাসরি ভোট দেওয়ার প্রস্তাব করেছে সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। দুই দফা আলোচনায় আসন ১০০টি করার বিষয়ে মোটামুটি ঐকমত্য হলেও নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এখনো মতভিন্নতা আছে।

প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তন করার বিষয়ে ঐকমত্য আছে। তবে নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছুটা মতভিন্নতা আছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার প্রস্তাব করেছে। দলগুলো এখানে বিকল্প রাখার (জ্যেষ্ঠ দুই বা তিনজন থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি করা) পক্ষে।

রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন নিয়েও এখনো ঐকমত্য হয়নি। সংসদ উভয় কক্ষের সদস্যের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরাও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন—সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবের সঙ্গে অনেক দল একমত নয়।

সংবিধানের মূলনীতি প্রশ্নেও মতভিন্নতা রয়েছে। এখানে মোটাদাগে বামপন্থী দলগুলো একদিকে আর ধর্মভিত্তিক দলগুলো আরেক দিকে।

আরও পড়ুনঅর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া সংসদে স্বাধীন এমপিরা১৮ জুন ২০২৫

আলোচনার ফল নিয়ে সংশয়ও

যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, তাতে কতটা ঐকমত্য হবে তা নিয়েও সংশয়ের কথা এসেছে। গত রোববার গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেকগুলো বিষয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে একমত হচ্ছি আমরা। কিন্তু এখানে কিছু কিছু দল একবারে নিজেদের অবস্থানে অনড়। যদি এভাবে চলতে থাকে কেয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্যের সম্ভাবনা দেখি না।’

আবার ঘুরেফিরে একই বিষয় একাধিকবার আলোচনায় আসছে। গত রোববারের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, এখন পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ছয়টি বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। ঘুরেফিরে একই আলোচনা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, কতটি দল কোনো বিষয়ে একমত হলে সেটা ঐকমত্য হবে। তাঁরা আলোচনায় সময় দেবেন, কিন্তু এর একটা ফল থাকতে হবে, একটা সময় নির্ধারিত থাকতে হবে।

অনেকে মনে করছেন দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা হলেও সে অনুযায়ী ফল আসছে না। যেমন গত বৃহস্পতিবার আলোচনা শেষে এবি পার্টি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু সাংবাদিকদের বলেন, তিন দিন ধরে ব্যাপক আলোচনা-বিশ্লেষণ চলছে, কিন্তু কোনো বিষয়েই ঐকমত্য হচ্ছে না।

আরও পড়ুনব‍্যাপক আলোচনা চললেও কোনো বিষয়েই ঐকমত‍্য হচ্ছে না: এবি পার্টি১৯ জুন ২০২৫

আশাবাদী কমিশন

এই নয়টি বিষয়ের বাইরে আরও যেসব বিষয়ে আলোচনা হবে সেগুলোর মধ্যে আছে—নির্বাচনী এলকার সীমানা নির্ধারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি, জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রক্রিয়া, স্থানীয় সরকারে নারী প্রতিনিধিত্ব, উচ্চকক্ষের নির্বাচনপদ্ধতি, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল গঠন ইত্যাদি।

এখন পর্যন্ত যত সময় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার তুলনায় ফল কম হলেও ঐকমত্য কমিশন আশাবাদী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত আলোচনায় যে অগ্রগতি, কমিশন আরেকটু বেশি অগ্রগতি হবে এবং দলগুলো আরেকটু বেশি ছাড় দেবে বলে আশা করেছিল। কিছু কিছু বিষয়ে দু–একটি দল মতভিন্নতা দেখাচ্ছে। কিন্তু বড়মাপে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা আছে, আলোচনায় সবাই সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে অংশ নিচ্ছেন, ক্ষেত্রবিশেষে দলীয় অবস্থান নমনীয় করছেন, এটা ইতিবাচক। তিনি বলেন, ‘আগামীতে জাতীয় স্বার্থে দলগুলো প্রয়োজনে কিছুটা ছাড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে এবং দ্রুত একাধিক বিষয়ে ঐকমত্য হবে বলে আশা করছি।’

আরও পড়ুনএভাবে চলতে থাকলে কেয়ামত পর্যন্ত ঐক্যের সম্ভাবনা নেই : নুরুল হক নুর২২ জুন ২০২৫আরও পড়ুনলন্ডন বৈঠকের পর এখন বিএনপির দৃষ্টি নির্বাচনে , কী ভাবছে অন্য দলগুলো ১৫ জুন ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ ব ত য় পর ব র র প রস ত র ষ ট রপত ত ক দলগ ল ক উন স ল র লক ষ য প রক র য় অন য য় কর র ব র জন য ব এনপ সরক র অবস থ ইসল ম ক ষমত সময় ন এনস স প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন

১৯৭২ সালে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫টি। পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে ২০১১ সালে এসে এই সংখ্যা ৫০–এ উন্নীত হয়। ১৫ থেকে ৫০-এ আসতে প্রায় ৩৯ বছর লেগেছে। অথচ বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী।

স্বাধীনতার পর শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত অনেক নারী এখনো ঠিকমতো মজুরিই পান না, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি তো দূরের কথা। স্বাস্থ্য উন্নয়নের ডামাডোলে সবচেয়ে নিচে চাপা পড়ে থাকে নারীর শিক্ষা।

এর মধ্যেই লড়াই করছেন নারীরা। লড়াই করতে গিয়ে সম্মুখসারিতে থাকছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পরিসরে এসে পেছনের আসনে বসতে বাধ্য হচ্ছেন।

এত দিনের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট যে রাজনৈতিক দলগুলোর সংসদে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে নারী আসন বণ্টন করা হলে রাজনৈতিক নেতাদের স্ত্রী, কন্যা বা আশীর্বাদপুষ্টরা মনোনীত হন। অনেক ক্ষেত্রে মনোনয়ন পেতে মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন ঘটে। এর মধ্য দিয়ে সংসদে নারীর প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না। তাই সরাসরি নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণের দরকার রয়েছে।

কিন্তু বিদ্যমান অসম সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে হুট করে পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে নারীদের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে না। তাই প্রথমে কতগুলো সংরক্ষিত আসনে নারীদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের পথ সুগম হবে। ফলে ধীরে ধীরে সংরক্ষিত আসনের বাইরে সাধারণ আসনগুলোতেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং একসময় আর সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন হবে না।

গণ-অভ্যুত্থানে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের পর অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণ নিয়ে দেশব্যাপী নারীদের সোচ্চার হতে দেখা গেছে। আবার একের পর এক নারীদের রাজনীতির ময়দান ছেড়ে দিতেও দেখা যাচ্ছে। তাঁদের রাজনীতির ময়দান ছেড়ে দেওয়ার গল্পগুলো যেমন আমাদের নিরাশ করে, তেমনি নারীকে সামাজিকভাবে হেয় করাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করাটা ক্ষুব্ধও করে। এমন একটি সময়ে আমরা দেখলাম, ঐকমত্য কমিশন নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় একমত হতে পারেনি।

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার পর গত ৩১ জুলাই ঐকমত্য কমিশন জানায়, ১০০ আসনে উন্নীত করার ব্যাপারে বেশির ভাগ দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) জানিয়েছে। তাই সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা ৫০ রাখা এবং ৩০০ আসনের মধ্যে ন্যূনতম ৫ শতাংশ আসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে নারী প্রার্থী মনোনীত করার আহ্বান জানায় কমিশন।

এখন দেখা যাক, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে তিনটি ভিন্ন সংস্কার কমিশন কী কী প্রস্তাব দিয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, ৪০০ আসন নিয়ে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে। ৩০০ জন সদস্য একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি নির্বাচিত হবেন। আরও ১০০ নারী সদস্য সারা দেশের নির্ধারিত ১০০টি নির্বাচনী এলাকা থেকে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচিত হবেন।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে উল্লেখ আছে, সংসদের (নিম্নকক্ষ) আসনসংখ্যা ১০০ বাড়িয়ে মোট সংখ্যা ৪০০ করা হোক। এই ৪০০ আসনের মধ্যে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০০ আসন ঘূর্ণমাণ পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিধান করা হোক, যাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট আসন থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের অবসান হয়।

আর নারী সংস্কার কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে, সংসদ নির্বাচনে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সংসদীয় আসনসংখ্যা ৬০০-তে উন্নীত করা, যেখানে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একটি সাধারণ আসন এবং নারীদের জন্য একটি সরাসরি নির্বাচিত সংরক্ষিত আসন থাকবে। জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ করার সিদ্ধান্ত হলে সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করা হবে, যেখানে নারী-পুরুষ মনোনয়ন পর্যায়ক্রমে জিপার পদ্ধতিতে দেওয়া হবে।

জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে নারী আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বের জন্য কমপক্ষে পাঁচটি আসন সংরক্ষণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের বিধান না মানলে দল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা হারাবে, এমন বিধান রাখতে হবে।

লক্ষণীয় হলো, পুরুষপ্রধান সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নারীর জন্য সংরক্ষিত ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন এই ১০০টি এলাকায় পর্যায়ক্রমে ঘূর্ণমাণ পদ্ধতিতে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের কথা বলেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ১০০টি নির্ধারিত এলাকা থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের কথা বললেও এলাকাগুলো কীভাবে নির্ধারিত হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেনি।

আর নারী সংস্কার কমিশন নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব রেখেছে। এরপর এই প্রস্তাবগুলো বিবেচনার জন্য আনা হলো। নারী সংস্কার কমিশন আর ঐকমত্য কমিশনে রইল না। আমরা ঐকমত্য কমিশনে একটা ‘বয়েজ ক্লাব’ পেলাম। যে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রধানকে নিয়ে ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেখানে কোনো নারী নেই। যদিও যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হয়তো নারীর প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন, তবু এটাই সত্য যে সেখানে নারীদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কোনো নারী ছিলেন না। অন্যদিকে যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁরা বসেছেন, সেখানেও নারীর উপস্থিতি ছিল খুবই কম।

ঐকমত্য কমিশন তিন ধরনের প্রস্তাব দিয়ে আলাপ শুরু করেছে, যেখানে আগেই মতৈক্য ছিল না। এরপর যুক্ত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দলের নিজ নিজ স্বার্থ। এখানে এসে আলোচনা হয়েছে বাস্তবায়ন কীভাবে হবে। সব দল নিজ সমস্যা নিয়ে এসেছে। ফলে ঐকমত্য না হওয়ারই তো কথা। আসনসংখ্যা বাড়ানো, সরাসরি নির্বাচন, রাজনৈতিক দলের নারী প্রার্থী মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা নিয়ে একেক দলের একেক অবস্থান থেকে সরে না আসার প্রবণতা দেখা গেছে। এই প্রবণতা থাকবে ধরে নিয়ে কিছু বিষয় শুধু রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে না করে বরং জনসংখ্যার অনুপাতে নারীর প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে হওয়া প্রয়োজন ছিল।

ড. মোশাহিদা সুলতানা: সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাজনীতিতে পরিবর্তন ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আগামী সপ্তাহে আবার আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন
  • জুলাই ঘোষণাপত্রে ব্যক্ত আকাঙ্ক্ষাকে জাতীয় সনদে রূপ দিতে হবে: জেএসডি
  • জুলাই ঘোষণাপত্রে আবারও বিজয় বেহাত হওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট: রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন
  • এক বছরে গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হলো
  • জুলাই সনদের ভিত্তিতে হতে হবে আগামী নির্বাচন: জামায়াত
  • নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন