গাইবান্ধায় আলোচিত ধর্মীয় সভার নামে ২২ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় সাবেক দুই সংসদ সদস্যসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রায় পাঁচ বছর চার দফায় তদন্ত শেষে সম্প্রতি এ অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রের ওপর শুনানির জন্য ১৩ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন গাইবান্ধার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালত। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) আবদুল হালিম।

ধর্মীয় সভার নামে ২২ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দুদকের রংপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সাবেক সহকারী পরিচালক (বর্তমানে প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক) হোসাইন শরীফ বাদী হয়ে ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট একটি মামলা করেন। এতে সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধান, পিআইওসহ ১৯ জনকে আসামি করা হয়। এ নিয়ে ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে ‘ধর্মীয় সভার নামে ২২ কোটি টাকা আত্মসাৎ, মামলা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

মামলার ১৯ আসামির মধ্যে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, পিআইওসহ ১০ জনের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এজাহারনামীয় ৯ জন এবং তদন্তকালে আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত থাকায় সাবেক দুই সংসদ সদস্যসহ নতুন সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুদকের রংপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সাবেক সহকারী পরিচালক (বর্তমানে প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক) হোসাইন শরীফ এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দুই হাজার ২৫৩টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, লিল্লাহ বোর্ডিং, শিশুসদন, অনাথাশ্রমে আগত মুসল্লিদের আহার্য বাবদ ৫ হাজার ৮২৩ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ আসে। কিন্তু গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের যোগসাজশে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও পৌর কাউন্সিলর এসব চাল আত্মসাৎ করেন।

৪ বছর ১১ মাস ১২ দিনের তদন্ত শেষে ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছেন এজাহারনামীয় ৯ জন ও নতুন ৭ জন। এজাহারনামীয় হলেন উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আকতারা বেগম, সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাকিল আহম্মেদ, দরবস্ত ইউপির চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম, তালুককানুপুর ইউপির চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান, নাকাই ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল কাদের প্রধান, ফুলবাড়ি ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান মোল্লা, গুমানীগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান শরীফ মোস্তফা জগলুল রশিদ, কামারদহ ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম এবং শিবপুর ইউপির চেয়ারম্যান সেকেন্দার আলী।

মামলার তদন্তকালে ঘটনায় জড়িত থাকায় সাবেক দুই সংসদ সদস্যসহ নতুন সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, গাইবান্ধা-৩ (পলাশবাড়ী-সাদুল্যাপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম, স্থানীয় খাদ্য ব্যবসায়ী ফয়জুল ইসলাম, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাবেক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুল আহাদ, গোলাপবাগ খাদ্য গুদামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক, কামদিয়া খাদ্য গুদামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেমন্ত কুমার বর্মণ এবং মহিমাগঞ্জ খাদ্য গুদামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী আরজুমান নাহার।

মামলার অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া ১০ জন হলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধান, পিআইও জহিরুল ইসলাম, কামদিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মোশাহেদ হোসেন চৌধুরী, কাটাবাড়ি ইউপির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম, শাখাহার ইউপির চেয়ারম্যান তাহাজুল ইসলাম, রাজাহার ইউপির চেয়ারম্যান লতিফ সরকার, রাখালবুরুজ ইউপির চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন, কোচাশহর ইউপির চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন, শালমারা ইউপির চেয়ারম্যান আমির হোসেন, গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর গোলাপী বেগম।

মামলার বাদী হোসাইন শরিফ বলেন, যাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ওই ঘটনায় জড়িত নয় মর্মে কমিশনে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। এরপর মামলাটি চার দফায় তদন্ত করা হয়েছে। সেখানে তাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। পরে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ ব ন দগঞ জ র ইউপ র চ য কর মকর ত ল ইসল ম র চ লক ২২ ক ট তদন ত উপজ ল ঘটন য়

এছাড়াও পড়ুন:

এ গ্যাদা, এবার আমার সিরিয়াল

সপ্তাহের রোববার ও বুধবার আমাদের স্কুলের মাঠে হাট বসে। দুপুর গড়িয়ে গেলেই শুরু হতো কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক। সময়ের সঙ্গে স্কুল মাঠে ব্যস্ততা বাড়ত। দুই হাটের দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পাঠদান চলত। জানুয়ারি মাসের এমন এক রোববারের হাটের দিন আমার  জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো।  

মাত্র কদিন হলো উচ্চমাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পা রেখেছি। পাঠ্যবই, শিক্ষকদের নিয়ে নতুন কৌতূহল। নতুন বইয়ের গন্ধ তখনো মনোমুগ্ধকর। এমন এক সকালে আমাদের গণিত শিক্ষক ইয়াকুব আলী স্যার হঠাৎ এলেন ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস নিতে। উত্তম কুমার স্যার সেদিন আসেননি। যে কারণে ইয়াকুব স্যারের আগমন। এখন মনে পড়লে বুঝি, ভাগ্যিস সেদিন উত্তম স্যার আসেননি। কেন সেই ঘটনা বলছি।

ইয়াকুব স্যার এসেই জানতে চাইলেন, ‘আজকে রুটিনে কী পড়ানো হবে?’ আমরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠলাম, স্যার, আজ প্যারাগ্রাফ পড়ানোর দিন। সিলেবাসে অনুযায়ী সেদিন ছিল ‘দ্য নিউজপেপার’ প্যারাগ্রাফ বা অনুচ্ছেদ। স্যার শুরুতেই বললেন, ‘তোমরা কে কে খবরের কাগজ পড়ো?’ দেখা গেল একজন বাদে সবাই না সূচক মাথা নাড়ল। পত্রিকা, আমাদের বাজারের বেশ কয়েকজনকে মাঝেমধ্যে পড়তে দেখলেও তখনো আমি কোনো পত্রিকা সেই অর্থে পড়িনি। অতটা গুরুত্ব দিইনি। কখনো পত্রিকায় নায়িকাদের ছবি ছাপা হলে সেটা দেখতাম, এই যা। পারিবারিকভাবেও পত্রিকা পড়ার চল খুব একটা ছিল না। সময়টা ২০০০ সাল।

তখন স্যার পত্রিকা পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বললেন। কেন জীবনে বড় হওয়ার জন্য নিয়মিত পত্রিকা পড়া দরকার, সেটা বোঝালেন। জীবনের ভালো কিছু করার কৌতূহল ছিল। যে কারণে আমার কাছে সেদিনই মনে হলো পত্রিকা তাহলে পড়তে হবে। এবার স্যার জানালেন, পারলে প্রথম আলো পত্রিকা পড়তে পারো। এই পত্রিকায় দেশ–বিদেশের সবচেয়ে ভালো, নির্ভরযোগ্য খবর ছাপায়। সেই প্রথম শুনলাম প্রথম আলো পত্রিকার নাম। অজপাড়াগাঁয়ের কে এই পত্রিকাটি পড়েন, খোঁজা শুরু করি।

আমার গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার আটঘড়িয়া থানার একদন্ত বাড়ইপাড়া গ্রামে। আমার স্কুলের নাম আশরাফ উচ্চবিদ্যালয়। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। যেতে হয় বেশির ভাগ কাঁচা পথ পেরিয়ে। সেই শহর থেকে একজন বয়স্ক হকার সাইকেল চালিয়ে আসতেন গ্রামে পত্রিকা দিতে। বিভিন্ন এলাকায় পত্রিকা দিয়ে বিকেল চারটার দিকে আসতেন আমাদের শিবপুর বাজারে। সেখানে বেশির ভাগই চলত করতোয়া নামে একটি পত্রিকা। কিন্তু প্রথম আলো তখনো কেউ রাখেন না। অবশেষে সেই হকারের কাছে একদিন জানতে চাইলাম, প্রথম আলো পত্রিকা কে রাখেন? শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। জানতে চাইলেন, ‘তুমি প্রথম আলো পড়তে চাও।’ আমি তাঁকে আগ্রহের কথা জানালাম। তিনি আমাকে পত্রিকার একটি কপি হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটাই প্রথম আলো। তুমি পড়তে থাকো। আর আমার সাইকেল দেখে রেখো। আমি বিএসসি স্যারকে একটি পত্রিকা দিয়ে আসি।’ শাহাবুদ্দিন বিএসসি স্যার আমাদের গণিতের শিক্ষক ছিলেন। তিনিও পাবনার আঞ্চলিক একটি পত্রিকা পড়তেন। নাম আজ আর মনে নেই।

সেই প্রথম আমার প্রথম আলো পত্রিকা দেখা ও পড়া। তারপর হকারের সঙ্গে বেশ খাতির জমে গেল। কিন্তু সমস্যা একটাই, পত্রিকাটি পড়ার জন্য ১০ মিনিট সময় পাওয়া যায়। এতে মন ভরে না। এর মধ্যেই একদিন খুশির খবর শোনালেন। জানালেন, আমাদের বাজারের এক পাশে এখন থেকে নিয়মিত প্রথম আলো পত্রিকা রাখা হচ্ছে। কোনো একটি উদ্যোগে সেখানে বেশ কটি পত্রিকা রাখা হতো। হাতের কাছে প্রথম আলো পাওয়া যাবে ভেবে মনটা আনন্দ নেচে উঠল।

আমাদের বাজারের ইছামতি নদী ঘেঁষে একটি ছোট দোকানের পাশে পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা হলো। সেখানে নিয়মিত পত্রিকা দেখি। কিন্তু সমস্যা একটাই। আমি ছিলাম পত্রিকা পড়ার দলে বলা যায় সবার ছোট। যে কারণে প্রথম আলো হাতে নিলেই দেখা যেত বয়সে বড়রা এসে বলতেন, ‘প্রথম আলোটা কার কাছে দেখি’—এই বলে নিয়ে নিতেন।

একসময় প্রথম আলো পড়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু সিরিয়াল ধরে পড়ার সময় মেলানো কঠিন হয়ে যায়। কারণ, চারটার পরে পত্রিকা দিয়ে যেতেন। সেই সময়ে অনেকেই আমার মতো অপেক্ষায় বসে থাকতেন। অপেক্ষায় থাকতে হতো কখন আমার পত্রিকা পড়ার পালা আসে। এভাবে কখনো কখনো সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। তখনো ছোট দেখে অনেকে বলতেন, ‘গ্যাদা, বাড়ি যাও। রাত হয়ে গেছে।’ সবাই জানত আমাদের বাড়ি অনেকটা দূরে। ঝোপঝাড় পেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমার কাছে এটাই মনে হতো, পত্রিকা আমাকে পড়তেই হবে। প্রথম আলো না পড়লে আমি জীবনে বড় কিছু হতে পারব না।

যে কারণে ভয় উপেক্ষা করে কখনো কখনো সন্ধ্যার পরও অপেক্ষা করতাম পত্রিকা পড়তে। তারপরই পথচারি খুঁজে তার পিছু নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতাম। কখনো কাউকে না পেলে ভয় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হতো। তখন বাড়ি এসে লবণ দিয়ে পানি খেয়েছি এমন ঘটনাও বহুবার ঘটেছে। বাজারে বাবার দোকান ছিল, কখনো বাবার সঙ্গেও আসা হতো। কিন্তু বাবার সঙ্গে আসার অপেক্ষায় থাকলে অনেক রাত হতো। যে কারণে বহুবার পত্রিকা পড়ার জন্য সিরিয়াল ব্রেক করেছি। দেখা গেল কেউ একজন পড়া শেষ করলেই দ্রুত প্রথম আলো হাতে নিয়ে পড়া শুরু করতাম। তবে বেশির ভাগই শুনতে হতো, ‘এ গ্যাদা, এবার আমার সিরিয়াল।’ তখন মুখ কালো করে পত্রিকাটি দিয়ে দিতে হতো। প্রথম আলোর শুরু থেকে সবচেয়ে ভালো লাগত তারকাখচিত বিনোদন পাতা। এখন ভাবতে বেশ গর্ব লাগে। সেই বিনোদন পাতার একজন কর্মী আমি।

মো. মনজুরুল আলম, নিজস্ব প্রতিবেদক, কালচার অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট

সম্পর্কিত নিবন্ধ