সাংবাদিক থেকে সাধারণ মানুষ: সবার জীবন ঝুঁকিতে
Published: 8th, August 2025 GMT
আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা এমন এক নির্মম পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে সত্য বলা মানেই নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা। সত্য বলার অপরাধ এতটাই বড় যে, প্রথম পুরস্কার এখন শবদেহ-অর্থাৎ প্রাণহানি।
কণ্ঠ তুলে প্রতিবাদ করার সাহস দেখানো মানে মৃত্যুর মঞ্চে পা রাখা। যারা সাহস করেন, তাদের শাস্তি কোনো আদালতের দণ্ড নয়, বরং রাস্তার বীভৎস সন্ত্রাসী নৃশংসতা।
গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় ৭ আগস্ট সন্ধ্যা ৮টায় ঘটে যাওয়া বর্বর ঘটনা এ কথার এক নির্মম প্রমাণ। মসজিদ মার্কেটের সামনে, গণমানুষের সামনে, সবার চোখের সামনে, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে নির্মমভাবে ছুরিকাঘাত করা হয়, তারপর গলা কেটে তাঁর প্রাণ দগ্ধ করা হয়।
এই হত্যাকাণ্ড শুধু একজন নির্দোষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়নি; এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত হুঁশিয়ারি, যা চরম সাহসী সাংবাদিক ও সত্যভক্তদের জন্য রক্তাক্ত সংকেত।
তুহিনের পেছনে দাঁড়িয়েছিল না কোনো বড় মিডিয়ার শক্ত ঘাঁটি, ছিল না কোনো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পাহারা। ছিল শুধুমাত্র সত্য বলার অটল মনোবল, সাহসের দীপ্ত আলো। আর সেই সাহসই তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ালো—তার মূল্য দিতে হলো রক্তের বিনিময়ে।
সেদিন বিকেলে লাইভে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তুহিনের কথা বলাই হয়ে উঠল তাঁর মৃত্যুর কারিগরি কারণ। এভাবে প্রকাশ্যে গলা কেটে দেওয়া, এই বর্বরতা জনগণের মাঝে ভয় ও দমনের বার্তা পৌঁছে দিতে চায়।
এটি শুধু সাংবাদিকদের নয়, দেশের প্রতিটি স্বাধীন কণ্ঠের উপর এক ভয়ানক হামলা। সত্যকে স্তব্ধ করতে চাইলে তারা রক্তের ভাষায় কথা বলে; কিন্তু জানুক তারা, এই জবাইখানার গন্ধ যত বাড়বে, ততই সত্যের অশ্রু ও প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠবে।
বাংলাদেশে ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ৯ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১২০ জনের বেশি—তাদের অধিকাংশ চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, মাদক সিন্ডিকেট বা রাজনৈতিক অপরাধ নিয়ে রিপোর্ট করছিলেন।
এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়, প্রতিটি ঘটনার পেছনে রয়েছে একেকটি নিভে যাওয়া কণ্ঠস্বর, কলমের কালির বদলে রক্তে ভিজে যাওয়া কাগজ, এবং শোকাহত পরিবার। এর চেয়েও ভয়াবহ হলো-প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরপরই একই দৃশ্যপট দেখা যায়, স্থানীয় প্রশাসনের ‘তদন্ত’ নাটক, রাজনৈতিক নেতাদের শোক প্রকাশ, কয়েক দিনের মিডিয়া হৈচৈ, তারপর সব কিছু চুপ।
এই চক্র এমনভাবে পুনরাবৃত্তি হয় যে, সাংবাদিক সমাজের মধ্যে এক ধরনের নীরব আতঙ্ক জন্মেছে—কোনো খবর করা আগে ভাবতে হচ্ছে, জীবন কি এর চেয়ে বেশি দামী নয়?
সত্য বললে, প্রতিবাদ করলে, কলম ধরলেই কফিন। ‘খুনের তালিকায়’ নাম উঠছে। সাংবাদিকরা একা নন-নিরাপত্তাহীনতার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষও। চাঁদা না দেওয়ায় ব্যবসায়ী খুন, রাজনৈতিক প্রতিশোধে গৃহবধূকে নির্যাতন করে হত্যা, ছিনতাইয়ে কলেজ ছাত্রের মৃত্যু-প্রতিদিন এমন খবর ছাপা হচ্ছে।
দেশে সম্প্রতি প্রকাশ্যে নির্মমভাবে খুন করার ঘটনা বেড়েছে। মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই (জুন পর্যন্ত) খুন হয়েছেন প্রায় ২৭০০+ সাধারণ মানুষ। এই সংখ্যা প্রতিদিনের গড় হিসেবে ভয়াবহ-প্রায় ১৫ জন নাগরিক প্রতিদিন নিহত হচ্ছেন।
আরও উদ্বেগজনক হলো-এসব খুনের অনেকগুলোই পুলিশের নথিতে ‘অপরিচিত হামলাকারী’ বা ‘পারিবারিক বিরোধ’ হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়, যাতে মূল অপরাধীরা আড়াল পায়। এর ফলে জনগণ বুঝে গেছে-এই দেশে হত্যা শুধু সম্ভব নয়, বরং তা করে রেহাই পাওয়াও সম্ভব। সত্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কারিগর কারা?
সত্যের সবচেয়ে বড় শত্রু কেবল প্রকাশ্য অপরাধী নয়-প্রকৃত বিপদ লুকিয়ে থাকে রাজনৈতিক দলের নেতা আর ক্ষমতার অন্ধকার গলিতে। এখানে রয়েছে সেই চক্র, যারা চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যের জাল বুনে সমাজের ওপর আধিপত্য কায়েম করেছে।
এরা জানে, একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের হাতে যদি তাদের অপরাধের দলিল-প্রমাণ চলে আসে এবং তা প্রকাশ্যে আসে, তবে তাদের ক্ষমতার সাম্রাজ্য মুহূর্তেই ভেঙে পড়তে পারে। তাই তারা সবসময় ভয় দেখানো, অপপ্রচার, শারীরিক আক্রমণ, এমনকি হত্যাকাণ্ড পর্যন্তকে বৈধ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
আরও ভয়ংকর হলো-এই চক্রের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, এমনকি প্রশাসনের কিছু দুর্বৃত্ত সদস্যেরও আঁতাত থাকে। ফলে একজন সাংবাদিক খুন হওয়ার পরও প্রকৃত অপরাধীদের হাত ধরা যায় না; প্রমাণ গায়েব হয়ে যায়, সাক্ষীরা অদৃশ্য হয়ে যায়, আর মামলা বছরের পর বছর ধুলায় ঢেকে পড়ে থাকে।
এতে গোটা সাংবাদিক সমাজ ও সাধারণ মানুষ একটি ভয়ঙ্কর বার্তা পায়-‘আমরা শুধু ক্ষমতাধরই নই, আমরা আইনের চেয়েও শক্তিশালী।’ এমন পরিস্থিতি কেবল মুক্ত সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধই করে না, রাষ্ট্রের ন্যায়বিচারের ভিত্তিকেও ভেঙে দেয়।
বিচারহীনতার বিষবৃক্ষ সাংবাদিকতার অন্তরায়। বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৯০% মামলাই বিচারহীন থেকে যায়। এ এক ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান, যা শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাই নয়, রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার অভাবকেও প্রকাশ করে।
অপরাধের পরপরই মামলার নথি হারিয়ে যাওয়া, প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাওয়া, সাক্ষীদের ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে দেওয়া-এসব যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি এক অদৃশ্য কিন্তু গভীর শেকড় বিস্তার করেছে। ফলে অপরাধীরা নিশ্চিত হয়ে যায় তারা যাই করুক, শেষ পর্যন্ত তাদের সাজা হবে না।
নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা এ থেকে ভয়ঙ্কর শিক্ষা পাচ্ছেন-‘খুন হলেও হয়তো পত্রিকার শিরোনাম হব, কিন্তু ন্যায়বিচার পাব না।’ এই মানসিকতা কেবল সাংবাদিক সমাজকে নয়, গোটা রাষ্ট্রের আইনি ও নৈতিক ভিত্তিকে ক্ষয় করে দেয়। যখন একটি সমাজে বিচারহীনতা স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন সেখানে অপরাধের বিস্তার রোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সাংবাদিকদের পেশাগত অনিরাপত্তায় তারা আজ বড় একা ও অসহায়। বাংলাদেশে অনেক সাংবাদিক চুক্তিভিত্তিক বা ফ্রিল্যান্স হিসেবে কাজ করেন। তাদের চাকরির কোনো স্থায়িত্ব নেই, মাসের পর মাস বেতন বকেয়া থাকে, স্বাস্থ্যবিমা নেই, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই।
খুন বা হামলার শিকার হলে তাদের পরিবার কোনো ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পায় না; অনেক সময় মৃত সাংবাদিকের সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, সংসার ভেঙে পড়ে। এই আর্থিক ও সামাজিক অনিরাপত্তা সাংবাদিকদের ভঙ্গুর করে তুলছে।
যখন একজন সাংবাদিক জানেন—তার জীবন ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ দায় নেবে না- তখন তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ভয় কাজ করে। ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়, যা গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ সংকেত।
প্রতিটি সাংবাদিক হত্যার পর সরকার শোকবার্তা দেয়, তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু এগুলো যেন এক ধরনের ‘রুটিন প্রক্রিয়া’, যার ফলাফল প্রায় শূন্য। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দেয় না, দিলেও তা প্রকাশ পায় না। অপরাধী ধরা পড়লেও প্রভাবশালী হলে জামিন পেয়ে মুক্ত হয়ে যায়, আবার ক্ষমতার ছায়ায় ফিরে আসে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই এখানে মূল সমস্যা। শাসক দল মনে করে-প্রভাবশালী অপরাধীর বিচার করলে রাজনৈতিক সমীকরণ নষ্ট হতে পারে। ফলে তদন্ত শুরু হয় ঢাকঢোল পিটিয়ে, কিন্তু শেষ হয় নীরবে। এই চিত্র শুধু সাংবাদিকদের নয়, সাধারণ নাগরিকদের আস্থাকেও ভেঙে দিচ্ছে। মানুষ বুঝে যাচ্ছে-রাষ্ট্র তাদের রক্ষা করবে না, বরং হয়তো নীরবে অপরাধীদের পক্ষ নেবে।
আজ চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করলেই হত্যা হতে পারে, কাল রাস্তার দুর্নীতি তুলে ধরলেই মৃত্যু আসতে পারে-এই ভয় সমাজে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে মানুষ ধীরে ধীরে নীরব হয়ে যাচ্ছে। এই নীরবতা একসময় স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় পরিণত হয়, যেখানে মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস হারিয়ে ফেলে। এটি একটি জাতির জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ।
কারণ ভয় ও নীরবতা মিলে সমাজে এক ধরনের অন্ধকারের সংস্কৃতি তৈরি করে, যেখানে অপরাধীই হয়ে ওঠে নিয়ম প্রণেতা। এই সংস্কৃতি যতদিন চলবে, ততদিন অত্যাচারীরা আরও শক্তিশালী হবে, আর সাধারণ মানুষ তাদের দাসে পরিণত হবে। দেশে বিভক্ত গণমাধ্যম ও দুর্বল প্রতিবাদ সাংবাদিক নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন রাজনৈতিক বিভাজনে আক্রান্ত। কোনো সাংবাদিক নিহত হলে সব মাধ্যম একজোট হয়ে প্রতিবাদ করার বদলে কেউ কেউ দলীয় স্বার্থ দেখে নীরব থাকে। এতে সাংবাদিক সমাজের ঐক্য নষ্ট হয়, প্রতিবাদের শক্তি ক্ষয় হয়ে যায়। একটি স্বাধীন গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ঐক্য।
যখন সেই ঐক্য ভেঙে যায়, তখন ক্ষমতাসীনরা বুঝে যায়-তাদের বিরোধিতা করার মতো কোনো শক্তিশালী ফ্রন্ট নেই। আর ঐক্যে ফাটল ধরাতে প্রায়সই রাজনৈতিক দলের নেতারা কাজ করে থাকেন। ফলে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ বাড়তে থাকে, কারণ অপরাধীরা জানে, তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে উঠবে না।
সাংবাদিকদের সুরক্ষায় শুধু আবেগ নয়, কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, যাতে সাংবাদিকের নিরাপত্তা, বেতন, ক্ষতিপূরণ, এবং হুমকির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বাধ্যতামূলক হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিক হত্যা বা নির্যাতনের মামলাগুলো দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় এনে ৬ মাসের মধ্যে রায় ঘোষণা।
তথ্যপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। ডিএসএ বা অন্য কোনো আইনের অপব্যবহার রোধ করে সাংবাদিকদের মুক্তভাবে কাজের সুযোগ দেওয়া। রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রদর্শন করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলকে প্রমাণ করতে হবে-অপরাধী যেই হোক, বিচার হবে।
প্রতিচি ঘটনায় সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তার জন্য একক মঞ্চ তৈরি করা এবং প্রতিটি ঘটনার শক্ত প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হেেব।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম,
সাংবাদিক, সমাজ গবেষক,
মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।
www.
উৎস: Narayanganj Times
কীওয়ার্ড: ন র য়ণগঞ জ
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনৈতিক ‘অস্ত্র’ না হয়ে প্রভাবমুক্ত হোক পুলিশ
ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা—এই প্রবণতা স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা গেছে। যখন যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা নিজেদের স্বার্থে পুলিশকে কাজে লাগিয়েছে। অন্যদিকে পুলিশের অনেক সদস্য রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে জড়িয়েছেন। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে দেশে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত পুলিশ কমিশন গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
‘পুলিশ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা: নাগরিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ গঠনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত এই বৈঠকে আলোচকদের মধ্যে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি পুলিশের বর্তমান ও সাবেক আইজিপি, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আইনজীবীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ছিলেন। গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মতিউর রহমান শেখ। তিনি বলেন, পুলিশের নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত পুলিশ কমিশন প্রতিষ্ঠা করা উচিত। সাবেক ও বর্তমান বিচারপতি, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৯-১১ সদস্যের এই কমিশন হতে পারে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, চীন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে এমন কমিশন আছে।
সাবেক এই অতিরিক্ত আইজিপি বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ৪০০ মানুষের বিপরীতে একজন পুলিশ থাকার কথা। বাংলাদেশে ৮৪৩ জনের বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এমনকি এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়েও বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। ভারতে ৬৬৭ জনের বিপরীতে একজন, পাকিস্তানে ৫৫২, থাইল্যান্ডে ২৯৭ এবং মালয়েশিয়ায় ৩১৩ জনের বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য আছেন।
বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম। তিনি বলেন, সব প্রতিষ্ঠানের আগে পুলিশ সংস্কার প্রয়োজন। রাষ্ট্রের উপস্থিতি প্রথমেই পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে শুরু হয়। অথচ যুগ যুগ ধরে পুলিশকে অপব্যবহার করা হয়েছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় এই বাহিনীর যে ভূমিকা দেখা গেছে, সেটিও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণেই ঘটেছে। দেশ পরিচালনার অংশ না হয়ে পুলিশ দল চালানোর জন্য কাজ করেছে। তখন যে দল ক্ষমতাসীন ছিল, তারা মনে করত পুলিশ তাদের দলেরই একটি বর্ধিত অংশ।
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে পুলিশকে। রাজনৈতিক কারণে পুলিশকে যেন অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা না যায়, সেই সংস্কার করতে হবে। এ জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে পুলিশকে ব্যবহারবিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে যারাই সরকারের এসেছি, তারাই এই পুলিশকে বিনষ্ট করেছি। সবাই রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত বা শক্তিশালী করতে অথবা পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পুলিশকে ব্যবহার করেছি। এতে কমবেশি অসত্য কিছু নেই। কিন্তু পুলিশ ব্যবহৃত হয়েছে, এটাও সত্য। নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি পর্যন্ত সব জায়গায় যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে, সেই পুলিশ দিয়ে কী আশা করা যায়?’
জনমুখী পুলিশ করতে চাইলে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা দিতে হবে। বাহারুল আলম, পুলিশের মহাপরিদর্শকবিএনপির এই নেতা বলেন, ‘৫ আগস্টের পর যত মামলা হয়েছে এবং মব ক্রাইসিস হয়েছে, এই দুটো জিনিস এই সরকার এবং জনগণের সবচেয়ে বেশি ড্যামেজ করেছে। একটি মামলায় দুই হাজার, পাঁচ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলো নিয়েছে পুলিশ।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা বুঝতে পেরেছি, যারাই সরকারে যাক, তাদের মধ্যে যেন এমন বদ্ধমূল ধারণা না থেকে যে আগামীবার তারা বিরোধী দলে যাবে না। বিরোধী দলে যাওয়ার মানসিকতা থাকলে রাষ্ট্রে সুশাসন জারি হবে। তাহলেই পুলিশ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হবে না। প্রশাসন স্বচ্ছভাবে কাজ করতে পারবে।’
পুলিশকে নির্যাতকের ভূমিকায় মানুষ আর দেখতে চায় না বলে বৈঠকে উল্লেখ করেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মো. মোবারক হোসাইন। তিনি বলেন, জনবান্ধব করতে পুলিশকে নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের সময় পুলিশের কাছে প্রাণঘাতী অস্ত্র থাকা উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকারবৈঠকে হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, মামলার তদন্তে বিলম্বের অন্যতম কারণ ক্ষমতাসীনদের নির্দেশ পুলিশ পরিচালিত হয়। ধীরে চলার নির্দেশনা এলে পুলিশের তদন্তের গতিও কমে যায়। রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপের বাইরে আসতে হবে পুলিশকে। একই সঙ্গে পুলিশের নিয়োগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার পাশাপাশি স্বচ্ছ হতে হবে।
স্বাধীন পুলিশ কমিশনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিরোধিতা করা হয়েছে বলে বৈঠকে উল্লেখ করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে কোনো কিছুই কার্যত কাজে আসবে না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আরেকজন সদস্য ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিগত সময়ে পুলিশের মূল কর্তৃত্বের অধিকারী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন কোনো অপরাধ বাকি রাখেননি, যেটা অপরাধ বইয়ে নেই। এটা কেবল রাজনৈতিক কারণে হয়েছে—এমন ন্যায্যতা দেওয়ার সুযোগ নেই।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন শেষ সময় পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনে আলোচিত হয়নি। এর কারণ পরিষ্কার। রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক এবং পুলিশ নিজেই সেটি হতে দেয়নি। ক্ষমতাকে জবাবদিহির জায়গায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক শক্তি যেমন চায় না, তেমনি আমলাতন্ত্র এবং পুলিশও চায় না।
ক্ষমতা ধরে রাখার মানসিকতাপুলিশ সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি দরকার বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বৈঠকে বলেন, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন পরিবর্তন করতে হবে। এই আইন পরিবর্তন হয় না ক্ষমতা ধরে রাখার মানসিকতা থেকে। যতগুলো পুলিশ কমিশন হয়েছে, এর মধ্যে এবারের কমিশন সবচেয়ে আশাহীন এবং অকার্যকর কমিশন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
‘আমরা ভালো হতে চাই’বৈঠকে পুলিশের বর্তমান আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, ‘পুলিশের তরফ থেকে ২০০৬-০৭ সাল থেকেই বলছিলাম, আমাদের সংস্কার হোক। আমরা ভালো হতে চাই। প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করেন। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন পরিবর্তন করতে বলেছিলাম। কিন্তু ২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আমাদের দেওয়া সেই প্রস্তাবনা ঘুমন্ত অবস্থাতেই আছে।’
বাহারুল আলম বলেন, জনমুখী পুলিশ করতে চাইলে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা দিতে হবে। পুলিশকে মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে হবে। পুলিশ একটি স্বাধীন সংস্থার কাছে থাকুক। তিনি বলেন, মামলায় কাকে গ্রেপ্তার করা হবে, কার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে—সেটা যেন কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাপিয়ে দিতে না পারে। এই জায়গাটা পুলিশ চেয়েছে।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে পুলিশ অনেক কাজ সঠিকভাবে করতে পারছে না বলে বৈঠকে উল্লেখ করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান মো. ছিবগাত উল্লাহ।
বৈঠকে বক্তব্য দেন সাবেক পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ ইকবাল, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিজওয়ানুল ইসলাম, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজির (প্রশাসন) দায়িত্বে থাকা কাজী মো. ফজলুল করিম, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও ফাহমিদা আক্তার, এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন প্রমুখ।